মেরি-গো-রাউন্ড। নাগরদোলার পাশাপাশি তত্কালীন মেলার অন্যতম সেরা আকর্ষণ। মাথার ওপর গোল ছাতার মতো রঙিন চাঁদোয়া। নাগরদোলার মতো এটিও কাঠের তৈরি এবং সম্পূর্ণভাবে হস্তচালিত। বাহন হিসেবে রডে আটকানো কেশর ফোলানো কাঠের ঘোড়া এবং হাতি। একদম খুদেদের জন্য কাঠের বাক্স। হুবহু নাগরদোলার মতোই। তবে চাহিদার তুঙ্গে সবসময় হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা বাঘ। কয়েকপাক ঘুরে এসে থামলেই নতুন সওয়ারিদের মধ্যে রেষারেষি বেধে যেত বাঘের পিঠে কে সওয়ার হবে এই নিয়ে। তবে চালকদের মধ্যস্থতায় অধিকাংশ সময় মোটামুটি একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানই হত বলা চলে।
এই মেরি-গো রাউন্ডেরই আর একটা ক্ষুদ্র সংস্করণও আসত মেলায়। তলায় চাকা লাগানো মোটা লোহার পাইপের ওপর আঁটা গোল একটা লোহার রিং। রিঙের গায়ে ফিট করা চারটে ছোট ছোট চেয়ার। সবে মুখে বোল ফুটেছে অথবা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে এরকম খুদেদের জন্য। বেশি লোকজনের প্রয়োজন নেই। একজন চালকের হাতের টানেই ঘুরত রিংটা এবং বড় মেরি গো রাউন্ডের চেয়ে অনেক আস্তে। চড়বার দক্ষিণাও তুলনামূলকভাবে কম। ঘোরানোর সময় কট কট শব্দ হত একটা। তলায় চাকা লাগানো থাকায় ঠেলে নিয়ে যাওয়া যেত এদিক ওদিক। বিকেলের দিকে পাড়াগুলোতেও আসত মাঝে মাঝে। চোখে পড়া মাত্র বাপ-মায়ের ওপর বায়নায় হামলে পড়ত কচিকাঁচার দল। পরবর্তীতে গ্রামের মেলাগুলোয় কাঠের নাগরদোলা আর মেরি-গো-রাউন্ডের দেখা মাঝেমধ্যে মিললেও এই মোবাইল মিনিয়েচার মেরি-গো-রাউন্ড চোখে পড়েনি একটিবারের জন্যও। আপনাদের মধ্যে কারও পড়েছে কি? পড়ে থাকলে জানাবেন।
মৌলালি থেকে হাতের বাঁদিকে ঘুরেই রাস্তার দু’পাশে আর অধুনা বিলুপ্ত বুলেভার্ডের নীচে সার সার সস্তা ফার্নিচারের দোকান। সেগুন, বার্মা টিক বা মেহগনির বদলে কমদামি কাঁঠাল, পেয়ারা বা কেরোসিন কাঠের আলমারি, খাট, চেয়ার ড্রেসিং টেবিল, ঠাকুরের আসন… পুরনো সেই রথের মেলায় সেসময় নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মেলা থেকে কেনা সস্তা কাঠের আলমারি বা ড্রেসিং টেবিল হাতে টানা রিকশায় চাপিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছেন সদ্যবিবাহিত নিম্নবিত্ত দম্পতি— এ অতি পরিচিত দৃশ্য পঞ্চাশ-ষাট দশকের কলকাতায়। আসবাবপত্রের চত্বরটা টপকেই শুরু হয়ে যেত কাঠ, বেত আর লোহার জিনিসপত্রের বিশাল বাজার। হাঁড়ি, কড়াই, ছুরি, কাঁচি, দা, কোদাল, বেলচা, বেতের ধামা-কুলো-ঝুড়ি, কাঠের বারকোশ এমনকী লাঙলের ফাল, কী না পাওয়া যেত এখানে। সেসময় কারা এসব কিনত সেটা আজও এক অপরিসীম রহস্য আমার কাছে। মোটামুটি সত্তর দশকের প্রথমভাগ থেকেই গড়ে ওঠা ফ্লাইওভার, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং একই সঙ্গে ফুটপাত সংকোচন— এই ত্রিফলা আক্রমণের মুখে পড়ে ক্রমগত ছোট হয়ে যেতে থাকে বিশাল এই মেলার পরিসর। নব্বইয়ের গোড়াতেই সংকুচিত হতে হতে এসে ঠেকে যায় মৌলালির মোড়ে মাত্র মিটার ত্রিশেক জায়গায়। পরবর্তীতে প্রায় উঠে যেতে যেতে কোনওমতে টিকে গিয়ে স্থানান্তরিত হয় অদূরে রামলীলা পার্কে। মেলার পরিসর ছোট হয়ে গেলেও সময়টা একই আছে। প্রতিবছর রথের দিন শুরু হয়ে চলে টানা একমাস। তবে অতীতের সেই বৈচিত্র্য আর জৌলুস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি কোনওদিনই। নিজের ক্ষুদ্র সংস্করণকে রামলীলা ময়দানে বাঁচিয়ে রেখে বরাবরের মতো এ শহরকে আলবিদা জানিয়েছে কলকাতার সবচেয়ে বড় মেলা। শেয়ালদা রথের মেলা।
১৪. কলকাতার বিচিত্র পেশা
…কিছুই যায় না ফেলা
বেলা একটা, বাইপাস লাগোয়া কলোনি বাজারের একপাশে বাবলুর ‘ব্রয়লার চিকেন শপ,’ দোকানের বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো স্লেটে চক দিয়ে লেখা— ‘গোটা— ৯০’, ‘কাটা— ১৬০’, বড় লোহার খাঁচায় গোটা চারেক মুরগি। পাশে একটা কালো রঙের ড্রাম। জবাই হওয়া মুরগিদের ধড়ফড় করতে থাকা শেষ দু’-এক মিনিটের ঠিকানা। আজ এবেলার মতো বিক্রি বাট্টা শেষ। ছুরি চাকু ধুয়ে খাঁচার ওপর রাখা কাঠের ক্যাশবাক্সটা খুলে হিসেব মেলাচ্ছিল বাবলু। এমন সময় সাইকেলের ‘ক্রিং ক্রিং’। ঘণ্টার শব্দে চোখ তুলে তাকাল। দোকানের সামনে সাইকেল বসা মন্টু। এক পা প্যাডেলে, এক পা মাটিতে। সাইকেলের পিছনে ক্যারিয়ারের দু’দিকে আংটা দিয়ে ঝোলানো নীল রঙের দুটো প্লাস্টিকের ড্রাম, “কীরে? এত দেরি করলি?” ঈষৎ বিরক্তিমাখা গলায় প্রশ্ন করলো বাবলু। “আর বোলো না, মণ্ডলদার দোকানে অ্যায়সান দেরি করিয়ে দিল…” বলতে বলতে সাইকেল স্ট্যান্ড করিয়ে নেমে এল মন্টু। “আজ কতটা হল?” “কত আর হবে? ওই দশ বারো কেজি মতো… বিক্রিবাট্টার যা অবস্থা।” নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল বাবলু “কই দেখি,” বলে বাবলুর পাশ কাটিয়ে গিয়ে কালো ড্রামটার সামনে ঝুঁকে পড়ল মন্টু। ড্রামের একপাশে ডাঁই করে রাখা মুরগির বিষ্ঠা, নাড়িভুঁড়ি আর পালক। মন্টুর হাতে একটা বড় পলিপ্যাক। দ্রুতহাতে সমস্ত বর্জ্যটুকু পুরে ফেলল পলিপ্যাকটায়। পাশে রাখা ঝোলানো ওজনযন্ত্রটায় ঝুলিয়ে ওজন করে হাঁক ছাড়ল— “এগারো কেজি আটশো, বাবলুদা।” বলেই দোকান থেকে বেরিয়ে এসে পলিপ্যাকটা উপুড় করে দিল সাইকেলের ড্রামের মধ্যে। তারপর সাইকেলে বসে ফের হাঁক পড়ল—“আজ আসি বাবলুদা। সোমবার সব হিসেব-কিতেব কিলিয়ার (ক্লিয়ার) করে দেব।” “কাল একদম দেরি করবি না। তা হলে কিন্তু…।” বাবলুর কথায় হাসল মন্টু। “অ্যাকদম চিন্তা কোরো না। কাল ফাস (ফার্স্ট) তোমার একেনে, তারপর অন্য কথা…।” প্যাডেলে পায়ের চাপ। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল মন্টু।