এবার যে দুটি ঘটনার কথা বলব ভয়াবহতা আর হাড় হিম করা নৃশংসতায় তা হার মানাবে যে-কোনও বলিউডি ক্রাইম থ্রিলার সিনেমাকে। সেটাও আশির দশক। গোষ্ঠী সংঘর্ষে আহত হয়ে হাওড়া জেনারেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে গোরা মিত্তির। সে সময় হাওড়ায় ত্রাস সঞ্চারকারী নাম। বেডের সঙ্গে হাতকড়া দিয়ে বাঁধা বাঁ হাত। পাশে বসা একজন পাহারাদার কনস্টেবল। দুপুরবেলা। ওয়ার্ড মোটামুটি ফাঁকা। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতে অনেক দেরি। একটু ঢিলেঢালা ভাব চারদিকে। ঠিক এই সময় কয়েকজন যুবক। হাতে হাতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। ওয়ার্ডে ঢুকেই দ্রুত চলে এল বেডের সামনে। মুহূর্তের মধ্যে গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল গোরার দেহ। হাত বাঁধা থাকায় পালানোর চেষ্টাটুকুও করতে পারেনি। গার্ড কনস্টেবলও এই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। কারা মারল গোরাকে? কেনই বা মারল? এর উত্তর পেতে পিছিয়ে যেতে হবে খানিকটা। হাওড়া, যাকে ইংরেজরা বলত—‘শেফিল্ড অফ ইন্ডিয়া।’ শেফিল্ড ইংল্যান্ডের শিল্প নগরী, হাওড়াও তাই। শুধু দেশটা অন্য। অসংখ্য লোহালক্করের কারখানা থেকে বেরোনো লোহার ছাঁট বা স্ক্র্যাপ। চালু ভাষায় ‘বাবরি’। এর দখল নিয়ে মারামারি দু’দলে। একদলের পান্ডা গোরা মিত্তির। অপর দলের নেতৃত্বে নব পাঁজা। সে সময় গোটা হাওড়ার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা জল নেমে যেত এ দুটো নাম শুনলে। স্ক্র্যাপের ধান্দা থেকে ক্রমে ক্রমে রেলের টেন্ডার বা নিলামে ছড়িয়ে পড়ে এই দু’দলের প্রভাব। এদের কমিশন না দিয়ে কোনও ব্যবসায়ীর ঘাড়ে দুটো মাথা ছিল না স্বাধীনভাবে নিলামে অংশগ্রহণ করে। বাবরি আর টেন্ডার। এই দুয়ের দখল নিয়ে দুটো দলের মধ্যে চলতে থাকা নিরন্তর গ্যাংওয়ারের পরিণতি ঘটে গোরার মৃত্যুতে। এর বছরকয়েক পর নবও খুন হয়ে যায়। সেই নব পাঁজা। এক্স মিলিটারি পার্সোনেল। সত্তর একাত্তরে প্রবল পরাক্রান্ত নকশালরা বার বার এলাকা আক্রমণ করেও যাকে বাগে আনতে পারেনি। সেই নবকে কিনা খুন হতে হল অপরাধজগতে সদ্য পা রাখা এক নবাগতের কাছে। শিকারি। সামান্য রিকশাচালক থেকে হয়ে ওঠা পেশাদার খুনি। এই নামটাই উঠে এসেছিল বারবার পুলিশের কাছে। সাময়িক গ্রেফতার হলেও প্রমাণাভাবে ছাড়া পেয়ে যায় শিকারি।
সকাল দশটা সাড়ে দশটার টিকিয়াপাড়া রেল ইয়ার্ড। লাইনের ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে একটা ছেলে। বয়স বছর কুড়ি বাইশ। হাতে খোলা স্টেইনগান। পিছনে ধাবমান বিশাল পুলিশ বাহিনী। চলছে গুলির লড়াই। চালাচ্ছে দু’পক্ষই।
অবশেষে লড়াই থামল। পরপর ছুটে আসা বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তত্কালীন হাওড়ার আতঙ্ক হুলাই। প্রতিপক্ষের একজনকে খুন করে পালানোর সময় পুলিশের ঘেরাওয়ে পড়ে যায়। ফল এনকাউন্টারে মৃত্যু। রেললাইনের ওপর নিস্পন্দ স্থির হুলাইয়ের দেহ। পাশে শোয়ানো নীরব স্টেনগান… এ ছবিটা ছাপা হয়েছিল প্রায় সবক’টি দৈনিক সংবাদপত্রের ফ্রন্ট পেজে। কভার স্টোরি হয়েছিল একাধিক। আলোচনা বুড়বুড়ি কেটেছিল ক’দিন ধরে। তারপর সব চুপচাপ। পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি একটুও। এরপরেও হাওড়ার অন্ধকার জগতে উঠে এসেছে একের পর এক নাম। আপেল-গাম-টুলে, প্রভাত, রাখাল ডেভিড, অমিত, চাল শঙ্কর, মাছ শঙ্কর…। সব মিলিয়ে সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। হু হু করে উঠে আসা অন্ধকার জগতে। গলায় মোটা সোনার চেন। নামী কোম্পানির টি শার্ট-জিন্স-পারফিউম। অ্যান্টিকুইটি, স্মিরনফ অথবা ব্লেনডারস প্রাইড, নারীসঙ্গ, দামি মোটরবাইক আর সেলফোন, কোমরে গোঁজা কালো ঘাতক, নেতাদের সঙ্গে গা ঘষাঘষি, তারপর একদিন…গরাদের পিছনে নয়তো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কানাগলির মোড়ে, রেললাইনের পাশে, নর্দমার ধারে, আবর্জনার ভ্যাটে অথবা চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা পানাপুকুরের পচা জলে। পাল্টায়নি এ ছবিটাও। বোধহয় পাল্টাবেও না কোনও দিন।
সাতাত্তরের নির্বাচনে রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ দুনিয়ার ক্যানভাসেও দু’-চারটি পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগতে থাকল। বিধান রায় থেকে সিদ্ধার্থবাবু— এদেশ শাসনকালে রাজনীতির সঙ্গে পেশিশক্তির সম্পর্ক থাকলেও গুন্ডা মস্তানরা পার্টি অফিসের দরজাটা টপকাতে পারেনি কখনওই। রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রয়োজনে মাস্লম্যানদের ব্যবহার করেছেন ঠিকই, কিন্তু তারা কখনওই নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-নির্ণায়ক কোনওটাই হয়ে উঠতে পারেনি। সাতাত্তর পরবর্তী সময়ে এই সীমারেখাটা মুছে যায়।
দ্বিতীয় যে সমস্যাটি গুরুতর হয়ে দাঁড়াল তত্কালীন শাসকদলের কাছে, সেটা শিক্ষিত এবং লড়াকু জঙ্গি ক্যাডারের আকাল। যারা সারা রাত জেগে পোস্টার মারবে, দেয়াল লিখবে, চে গুয়েভারার ডায়েরি পড়বে, কোট করবে ‘রেড বুক’ বা লেনিনের ‘পার্লামেন্ট অ্যান্ড প্র্যাকটিস’ থেকে। স্ট্রিট কর্নারে উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠবে ‘ইন্টারন্যাশনাল’, আবার প্রয়োজনে বোমা-পাইপগান হাতে রাস্তায়ও নামবে। নচিকেতার গানের সেইসব ‘অনিন্দ্য সেন’দের অনেকেই সত্তর একাত্তরে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে নিহত অথবা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছিলেন। বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন কেউ কেউ। যারা তখনও পুরনো দলে রয়ে গেছেন, আশির দশক শেষ হতে না হতেই তাদের একটা বৃহদংশ বীতশ্রদ্ধ হয়ে বসে গেলেন। নীতিতে না মেলার জন্য বহিষ্কারও করা হল অনেককে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন নেতা মন্ত্রী হলেন। গদি, ঝাঁ চকচকে পার্টি অফিস, এসি কামরা আর স্করপিও ছেড়ে তাদের পক্ষে আর রাস্তায় নামা সম্ভব নয়। ঠিক এই রন্ধ্রপথ দিয়েই প্রবেশ এবং উত্থান দুলাল-হাতকাটা আশিস-লালি-বুল্টন-পলাশ-হাতকাটা দিলীপ-গব্বর-হুব্বা শ্যামল-রশিদ খান বাহিনীর। পেটে ক্রেন নামালে ‘ক’ উঠবে না। আদর্শ— সেটা খায় না মাথায় মাখে জানা নেই। সাট্টার ঠেক চালাও, চুল্লু বেচো, পুকুর বোজাও, গাছ কাটো, জমি দখল করো, গায়ের জোরে গৃহনির্মাণ সংস্থা অথবা মধ্যবিত্ত গৃহস্থকে বাড়ি তোলার সময় নিম্নমানের ইট-বালি-সিমেন্ট সাপ্লাই করো, চমকে ভয় দেখিয়ে তোলা তোলো। নজরানা পৌঁছে দাও সঠিক সঠিক স্থানে নিয়মিত। তারপর বিন্দাস থাকো। শুধু দলের হয়ে ইলেকশনের সময় আর টুকটাক প্রয়োজনে একটু-আধটু রাস্তায় নামো। এই একটু-আধটু রাস্তায় নামাটা যে কী বিষম বস্তু, টের পেয়েছিলেন বউবাজারের মানুষ, আশির দশকের শেষ দিকে পুরসভার নির্বাচনে। মোটামুটিভাবে বিরোধী দল প্রভাবিত এলাকা। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে বিরোধী প্রার্থীর জয় প্রায় নিশ্চিত। হিসেবটা উলটে গেল ভোটের দিন। সকাল থেকেই হাতে খোলা সোর্ড, বোমা, রিভলবার নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল ‘ডোবারম্যান গ্যাং’। সব হিসেব গুলিয়ে দিয়ে জয়ী হলেন শাসক দলের প্রার্থী। বাহাত্তরের ইলেকশনে রিগিং প্রায় প্রবাদকথায় পরিণত। তাকেও বলে বলে দশ গোল মেরেছিল বউবাজারের পুরসভা নির্বাচন। রাস্তায় খোলা পিস্তল হাতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুর্বৃত্ত দল— এ ছবিও ছাপানো হয়েছিল প্রতিটি কাগজের সামনের পাতায়। কিন্তু মস্তানদের কারও টিকিটিও ছোঁয়া যায়নি। এই নব্য মস্তানবাহিনীর সঙ্গে পুরনো বাহুবলীদের ফারাক একটাই। তাঁরা ছিলেন পাড়ার স্বঘোষিত অভিভাবক। সাধারণ মানুষের ওপর অন্যায় জুলুম একেবারেই না পসন্দ ছিল ওদের। এলাকার মেয়েদের সম্মান ইজ্জত নিয়ে প্রচণ্ড সচেতন। আমার এক আত্মীয়া, শ্রীগোপাল মল্লিক লেনের বাসিন্দা (এখন বিয়ে হয়ে দিল্লিতে), তার কাছেই শুনেছিলাম গল্পটা। বাড়ি ফিরছেন একটু রাত করে। পাড়ার মোড়ে দলবল সমেত বসে আছেন গোপাল পাঁঠা। রক থেকেই বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার—‘কোথায় গিয়েছিলে মা?’ মিনমিনে গলার উত্তর— ‘মাস্টারমশাইয়ের কাছে পড়তে।’ আবার প্রশ্ন— ‘রাস্তায় কেউ বিরক্ত করেনি তো?’ নীরবে ঘাড় নাড়া কোনওমতে—‘না।’ ‘ঠিক আছে, বাড়ি যাও।’ সেখানে আজকালকার মস্তানবাহিনী। ন্যূনতম মূল্যবোধের বালাই নেই। যে-কোনও অপরাধ করতে কুণ্ঠা নেই বিন্দুমাত্র। শুধু টাকার অঙ্কটা ঠিকঠাক থাকতে হবে। ষাটের দশকের বাহুবলীরা যদি সামন্ততান্ত্রিক গ্রামপ্রধান হন সেখানে আধুনিক মস্তান বাহিনী—‘হাইলি প্রফেশনাল কর্পোরেট’! যেখানে সবটাই— ‘এন্ড অফ দ্য ডে মানি অ্যান্ড প্রফিট ম্যাটারস।’