এই তৃতীয় গোষ্ঠীটিতে এমনও অনেকে ছিল যাদের সরাসরি কোনও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নেই সে অর্থে। একেবারে পেশাদার অপরাধী। এক্ষেত্রে নাম আসবে কাঁকিনাড়া জগদ্দলের বাবু মিত্র আর হুগলির কালিপটলা। রাস্তার ইলেকট্রিক তার কাটা আর ট্রেন ডাকাতিকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল এই দু’জন। সাধারণ গুন্ডাদের কাছে যখন একটা ওয়ানশটার পাইপগান বা কান্ট্রিমেড রিভলবারই বিরাট ব্যাপার, তখন বাবু মিত্তিরের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল একটা মেশিন কারবাইন। পরবর্তীতে দু’জনেই গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘকাল কারাবাসের পর অপরাধ জগতের চালচিত্র থেকে মুছে যায়।
সত্তর দশকে নকশাল আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আর একটি দলেরও উত্থান ঘটে কলকাতার বুকে। এরাও বিশ্বাস করত সশস্ত্র বিপ্লবে। তবে মত ও পথ অনেকটাই নকশালদের থেকে ভিন্ন। দলটির নাম ‘ম্যান মানি গান।’ সংক্ষেপে এমএমজি। নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনখ্যাত অগ্নিযুগের বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ওরফে ‘মাস্টারমশাই’। এদের থিওরি হল, জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের তেমন একটা প্রয়োজন নেই। অত্যাধুনিক অস্ত্র চাই, চাই আদর্শবোধে উদ্বুদ্ধ একদল যুবক আর চাই টাকা, বিপ্লবের প্রয়োজনে অবশ্যই। টাকা আসবে কোথা থেকে? সোজা উত্তর— ডাকাতি করতে হবে। এই নীতির অনুসরণে কলকাতা জুড়ে ঘটে চলল একের পর এক ডাকাতির ঘটনা। আজ যারা মধ্য পঞ্চাশ বা তার বেশি, তাদের নিশ্চয়ই মনে থাকবে সদর স্ট্রিট পোস্টঅফিস ডাকাতি, পার্ক স্ট্রিট পোস্টঅফিস ডাকাতি এবং গ্রিন্ডলেজ ব্যাঙ্ক ডাকাতির কথা। এইসব ডাকাতির সূত্র ধরেই গোয়েন্দা অফিসারদের তালিকায় উঠে আসতে থাকে একাধিক নাম-বিপুল বাজপেয়ী, হিরণ্ময় গাঙ্গুলি ওরফে হেনা গাঙ্গুলি ওরফে ‘ঠান্ডাদা’। মেধাবী, উচ্চশিক্ষিত, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ আর অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। অসম্ভব ঠান্ডা মাথায় কাজ হাসিল করতে পারার জন্য দলের মধ্যে ‘ঠান্ডাদা’ নামে ডাকা হত ওকে। একবার পার্ক স্ট্রিটে ডাকাতি করে পালানোর সময় পিছু ধাওয়া করে পুলিশের গাড়ি। দু’-একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী বিপদ বুঝে একশো টাকার একটা বান্ডিল খুলে গাড়ির জানলা দিয়ে বেশ কিছু নোট বাতাসে উড়িয়ে দেন হিরণ্ময়। পথচারী মানুষজন টাকা কুড়োতে রাস্তায় নেমে পড়ে। ভিড়ে আটকে যায় পুলিশভ্যান। সেই ফাঁকে উধাও হয়ে যায় কালো অ্যাম্বাসাডার যা ওই সময় ডাকাতির বাহন হিসেবে সমার্থক হয়ে উঠেছিল। প্রশাসনকে অনেক ঘোল খাইয়ে অবশেষে বেলেঘাটায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন হেনা। পরবর্তীতে এই দলেরও অনেকে পেশাদার ডাকাতে পরিণত হয়েছিল।
সেটা আশির মাঝামাঝি। পার্ক স্ট্রিটের একটা বারে দলবল সমেত বসে রয়েছেন মীর মহম্মদ ওমর। মধ্য কলকাতার অবিসংবাদিত ডন। এ রাজ্য ছাড়িয়ে সুদূর মুম্বই অবধি যার ক্ষমতার হাত বিস্তৃত ছিল, ওঠা-বসা ছিল হাজি মাস্তান মির্জা আর করিম লালাদের মতো কিংবদন্তী মাফিয়া ডনদের সঙ্গে। হঠাৎই বারের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল একজন। বেঁটেখাটো বলিষ্ঠ চেহারা। হাতে খোলা রিভলবার। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সোজা গুলি চালাল ওমরের কপাল লক্ষ্য করে। সেই কপালই ভাল থাকায়, বুলেট গিয়ে লাগে ইঞ্চি দুয়েক ওপরে। কাচের দেয়ালে। গুলি চালিয়েই দ্রুত বার ছেড়ে বেরিয়ে সামনে অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে মিলিয়ে যায় ওই যুবক। কে এই দুঃসাহসী? বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘেরই ল্যাজ মুচড়ে ধরার হিম্মত রাখে? উত্তরটা হল পার্ক সার্কাস এলাকায় জাননগর রোডের জান মহম্মদ ওরফে ‘পাগলা জান’। ঘনিষ্ঠ মহলে পরিচিত ছিল ‘দাদাভাই’ নামে। ওমর যে রাজনৈতিক দলের অনুগামী ছিল সেই দলেই ওমরের বিরোধী গোষ্ঠীর এক নেতার হাত ছিল এর পিছনে বলে অনুমান। মধ্য কলকাতায় ওমরের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করতে আর একবার সচেষ্ট হয়েছিল ওই গোষ্ঠী। ব্যবহার করেছিল ‘তাড়িবাবা’কে। এলিয়ট রোড রিপন স্ট্রিট অঞ্চলের ছোটখাটো গুন্ডা থেকে হয়ে ওঠা আরেক ডন। ওমর আর তাড়িবাবার দলবলের মধ্যে সংঘর্ষ সে সময় প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল মধ্য কলকাতায়। তবে তাড়িবাবা বা পাগলাজান কারও অপরাধ জীবনই তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পুলিশের তাড়া খেয়ে রাজ্য ছাড়তে বাধ্য হয় তাড়িবাবা। প্রায় নিজের বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিজেরই বিশ্বস্ত অনুচর বাঙালি খ্রিস্টান দুই ভাই কেলো ও ভোলার পিস্তলের পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে ছোঁড়া বুলেটে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাগলাজান। এর কিছুদিনের মধ্যে কেলোও খুন হয়ে যায় এ জে সি বোস রোডের একটি কবরখানার ভিতরে।
খুন পালটা খুনের এই খেলার মধ্যেও ওমরের রাজ্যপাট অবশ্য বজায় ছিল আরও বেশ কিছুদিন। কিন্তু তত্কালীন শাসকদল তাদের বিরোধী দলের অনুগামী ওমরকে কোণঠাসা করতে মদত জোগাতে থাকে বউবাজারের সাট্টা ডন রশিদ খানকে। রশিদ আর তার চ্যালা চামুণ্ডা গুড্ডু, কাট্টা শাকিল, লালাদের দাপটে একটু একটু করে নিজের জমি হারাতে থাকে ওমর। তারপর তো একটা খুনের কেসে ফেঁসে গিয়ে দীর্ঘকালীন কারাবাস। অবশেষে জামিন পেয়ে ফেরার বিদেশে। আর কোনও দিনই ফেরা সম্ভব হয়নি। ওমর-পাগলাজান-তাড়িবাবা পরবর্তী সময়েও অনেক মস্তানি, ক্ষমতার দাপট, অস্ত্র আর টাকার ঝনঝনানি দেখেছে সংখ্যালঘু মহল্লা। ফুলবাগান, মেহেদি বাগান, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে আওরঙ্গজেব, সোলজার, বুইয়া, স্টিলবডি। রাজাবাজারে ছক্কা মনোয়ার। দারাপাড়ায় বড়কা, কাদের, জাহাঙ্গীর। তিলজলায় লুলা বাপি। আনোয়ার শা রোডে রাজেশ, শেখ বিনোদ, শাহজাদা। নিত্য গ্যাংওয়ার নিজেদের মধ্যে ড্রাগ, মেয়ে পাচার, অবৈধ বেআইনি নির্মাণ, মদ ও জুয়া সাট্টার ঠেক আরও একাধিক বেআইনি ব্যাবসার থেকে লব্ধ অর্থের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে। তবে এদের সবার অপরাধজীবনও স্বল্পমেয়াদী। গ্যাংওয়ার, পুলিশি এনকাউন্টার আর জেলের দেয়াল এদের বৃহদংশকেই অপরাধ জগতের মানচিত্র থেকে মুছে দেয় খুব তাড়াতাড়ি। যদিও এদের মধ্যে কেউ কেউ জেলের মধ্যে বসেই দিব্যি রাজ্যপাট চালিয়ে যাচ্ছে একথা আজকাল প্রায়ই শোনা যায় প্রিন্ট বা ভিশন মিডিয়ার দৌলতে।