সত্যি কথা বলতে কী কলকাতার বুকে মস্তানরা প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিল ওই একবারই। ষাটের শেষ আর সত্তরের গোড়ায়। যাই হোক, বাহাত্তরের গোড়া থেকেই প্রবল সরকারি দমন পীড়নের মুখে পড়ে নকশাল আন্দোলনের আঁচ স্তিমিত হয়ে যায় অনেকটাই। হাজার হাজার যুবক গ্রেফতার হয়ে জেলে, পুলিশি অত্যাচারে পঙ্গু হয়ে যান অনেকে। শহিদের সংখ্যাও অগুনতি— ‘এনকাউন্টারে’ অথবা দলীয় সংঘর্ষে। বাহাত্তর সালেই এই রাজ্যে ক্ষমতায় আসে সিদ্ধার্থশংকর রায়ের নেতৃত্বাধীন নব কংগ্রেসি সরকার। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গে আবার ফিরে আসে মস্তানতন্ত্র। এই মস্তানদের সরাসরি দু’ভাগে ভাগ করা যায়— এক) যারা পাড়ায় পাড়ায় প্রত্যক্ষভাবে নকশাল প্রতিরোধ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছিল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তায়। দুই) এই সব তরুণ-যুবকেরা, কোনওরকম রাজনৈতিক শিক্ষা বা আদর্শ ছাড়াই নকশাল আন্দোলনে ভিড়ে গিয়েছিল স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারিজম আর শক্তিপ্রদর্শনের মোহে। আন্দোলনে যখন ভাটার টান সেসময় পাড়ায় ফিরে এসে শাসকদলের নেতাদের কাছে আত্মসমর্পণ অথবা মুচলেকা/ বন্ড দিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে আনুগত্য বদল করেছিল। প্রথম দলে অবশ্যই আসবে মধ্য কলকাতার কেশব সেন স্ট্রিটের কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত (মুখে বসন্তরোগের একাধিক ক্ষতচিহ্নের জন্য ফাটাকেষ্ট নামেই বিখ্যাত গোটা কলকাতা জুড়ে), গৌরীবেড়িয়ায় হেমেন মণ্ডল, কসবার দেবা দত্ত ওরফে হাতকাটা দেবা, কালিকাপুরে কানাই কুমির, চেতলা কালীঘাটে ভীম-টুপি কাশি-সোনা, মুদিয়ালি প্রতাপাদিত্য রোডে নীরেন চ্যাটার্জি ওরফে চিনা, পণ্ডিতিয়ায় নেলো, চারু মার্কেটে টনি, যাদবপুরে কানা অজিত, চাঁদনি কলুটোলায় মীর মহম্মদ ওমর, হাওড়ায় নব পাঁজা, বেলেঘাটায় রতন ঘোষ, ঘোঁতন মিত্র, বেলঘরিয়ায় ইনু মিত্তির, বরানগরে সত্য দুবে-বুটুন চ্যাটার্জি, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এ জগা মিত্র এরকম আরও অজস্র নাম। দ্বিতীয় দলে উল্লেখযোগ্য আমহার্স্ট স্ট্রিটের শঙ্কর সিং, টালিগঞ্জের অমল-সজল-কাজল-পণ্ডিত ইত্যাদি। নকশাল থেকে কংগ্রেসে যোগ দেওয়া এই দ্বিতীয় দলের সদস্যরাই সেসময় কংশাল নামে পরিচিত হয়। আগেই বলেছি পুজো অথবা জলসা— স্ট্রংম্যানদের মাস্ল পাওয়ার শো করার অন্যতম সেরা পদ্ধতি। সেই কারণে অচিরেই কলকাতা জুড়ে বিখ্যাত হয়ে ওঠে সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট আর বেহালায় ফাটাকেষ্ট, শঙ্কর পাইনের কালীপুজো, কসবায় দেবা দত্তর জলসা।
প্রথম দুটি দলের বাইরে তৃতীয় একটি দলও ছিল, প্রথমে যাদের কথা বলতে ভুলে গেছি। এদেরও অধিকাংশই জড়িত ছিল নকশাল আন্দোলনে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুরোপুরি ডাকাত বনে যায়। সুদীর্ঘকালীন অস্ত্র নির্ভরতা আর অ্যাডভেঞ্চার প্রবণতা কখনওই পিছু ছাড়েনি এদের। সঙ্গে অতিরিক্ত যোগ হয়েছিল যেটা— সহজে টাকা কামানোর নেশা। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমহার্স্ট স্ট্রিটের হৃষিকেশ মুখার্জি। একাধিক ট্রেন আর ব্যাঙ্ক ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিল। আশির শেষাশেষি নদিয়ার হরিণঘাটায় নকশাল আমলের এক ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ পুলিশ অফিসারের গুলিতে নিহত হয় হৃষিকেশ। দ্বিতীয় যার কথা এখানে বলব, ব্যক্তিগত পরিচয় থাকার কারণে তার নামটা উল্লেখ করছি না।
মা ছিলেন সরকারি নার্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়্যাল নার্সিং সার্ভিস কমিশনে যোগ দিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানেই আলাপ হয় এক সুদর্শন পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারের সঙ্গে। যুদ্ধে আহত হয়ে কম্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরিচয় প্রেম আর প্রেম পরিণয়ে পরিণত হতে দেরি হয়নি। লন্ডনেই জন্ম হয় আমার পরিচিতের। তীক্ষ্ন মেধা, অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু আর অক্লান্ত পাঠক। ইবসেন থেকে অরণ্যদেব— কিছুতেই অরুচি নেই। হস্তাক্ষর সোনার জলে বাঁধিয়ে রাখার মতো আর অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেয়ালে ‘নকশালবাড়ি লাল সেলাম’ লিখে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যেত। একাত্তরের শেষদিকে গ্রেফতার। বছর সাতেক জেল খেটে বেরিয়ে ডাকাত দলে ভিড়ে আর একবার পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ক্রমাগত প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে অবশেষে ধরা পড়ে যায় ডিডি-র হাতে। শ্যাওড়াফুলি না চন্দননগর কোনও একটা স্টেশন থেকে। স্টেশনের বেঞ্চিতে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরা পড়ার সময় বালিশের বিকল্প হিসেবে মাথায় রাখা ব্রিফকেসের মধ্যে ছিল লক্ষাধিক ক্যাশ টাকা, ভরি দশেক সোনার গয়না আর ছ’ঘড়ার একটা রিভলবার। শোনা কথা লক আপে হাজারো অত্যাচার সহ্য করেও লুঠ করা এবং লুকোনো টাকার হদিশ দেয়নি। পরবর্তী কালে প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান দেবী রায় ‘দেশ’ (সম্ভবত) পত্রিকায় বাংলার ডাকাতদের নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন লেখেন। ওর নামটাও সেই প্রতিবেদনে ছিল। দ্বিতীয়বার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে একটা মিত্সুবিসি ক্যান্টার ওয়াগন কিনে ভাড়ায় খাটাতে শুরু করে। কোনও ড্রাইভারের হাতে ছাড়েনি। নিজেই চালিয়ে চষে বেড়ায় গোটা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড। এই তিনটে রাজ্যের প্রতিটা রাস্তাকে চেনে হাতের তালুর মতো, গাড়ির ক্যাবিনেটে সর্বক্ষণের সঙ্গী দেশি-বিদেশি দু’তিনটে বই আর রামের একটা পাঁইট। বিয়ে থা করেনি। ফুর্তিতে রয়েছে সবসময়। সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতি আর অপরাধ জগৎ দুটোই বর্তমানে ইতিহাস ওর কাছে। গাড়ির গায়ে লেখা ‘দ্য কার ইজ মাই ব্ল্যাক মাদার।’ কোথায় নাকি পড়েছে পৃথিবীর প্রথম মা কৃষ্ণকায়া এবং জন্মেছিলেন আফ্রিকা মহাদেশে।