দাঙ্গা তো শেষ। কিন্তু হাতে রয়ে গেছে প্রচুর অস্ত্র, ক্ষমতা আর লোকজন। অচিরেই কলকাতা ছাড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যত্রও এই মস্তান বাহিনীর ক্ষমতার রথ ছুটতে থাকে জেট গতিতে। নেতৃত্বে অবশ্যই সেই গোপাল পাঁঠা, তত্কালীন কলকাতার ‘আনক্রাউনড কিং’।
ওঁর এই বিচিত্র পদবির পিছনে অবশ্যই একটা কারণ ছিল। গোপালবাবুর কাকা অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন অগ্নিযুগের প্রখ্যাত বিপ্লবী। বিপ্লবীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা, অস্ত্রশস্ত্রের আদানপ্রদান এবং লুকিয়ে রাখা, শেল্টারের ব্যবস্থা, গোপন মিটিং/সভা আয়োজন মূলত এগুলোই ছিল অনুকূলবাবুর কাজ। এক কথায় উনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। কলেজ স্ট্রিট আর প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে একটা পাঁঠার মাংসের দোকান ছিল ওঁর। সামনে মা কালীর ছবি আর দেয়ালে ঝোলানো একটা বিশালাকার বলির খাঁড়া। অনুকূলচন্দ্রের এই দোকানেই ছিল বিপ্লবীদের যোগাযোগ, খবর আদানপ্রদানের গোপন কেন্দ্রগুলির অন্যতম। ওঁর অবর্তমানে দোকানের মালিকানা বর্তায় ভাইপো গোপালের ওপর। সেই থেকেই ওঁর নামের পিছনে এই বিচিত্র পদবিটা জুড়ে যায়।
গোটা শহর জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দাপট দেখানোর আরও দুটি মঞ্চও প্রস্তুত হতে থাকে দ্রুত। পুজো আর জলসা। সে সময় সারা কলকাতায় বিখ্যাত ছিল বৌবাজারে গোপাল পাঁঠার সরস্বতী আর ক্রিক রোয়ে ভানু বোসের কালীপূজা। পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সারারাতব্যাপী জলসা। স্থানীয় এবং বহিরাগত অসংখ্য মধ্যবিত্তের বিনোদন। নিখরচায়। উইদাউট টিকিট। মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে শুরু করে হেমন্ত-মানবেন্দ্র-শ্যামল-ধনঞ্জয় সহ কলকাতা বম্বের অন্যান্য নামী দামি শিল্পীদের ক্রিক রোয়ের বিচিত্রানুষ্ঠানে হাজিরা ছিল মাস্ট (কলকাতা এবং শহরতলিতে আজকাল যে সব বাহুবলী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের পুজোর জাঁকজমক দেখতে আমরা অভ্যস্ত তার গোড়াপত্তন কিন্তু সেই সময় থেকেই)। ভানু-গোপালদের ওপর শাসকদলের কৃপাদৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। বাজারে চালু আছে তত্কালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শ্রীবিধানচন্দ্র রায় একবার যখন ইলেকশনে বামপন্থী প্রার্থী মহম্মদ ইসমাইলের কাছে প্রায় হারতে বসেছিলেন, শেষ মুহূর্তে কাউন্টিং বুথে হামলা চালিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মানরক্ষা করে ‘ভানু-গোপাল অ্যান্ড কোং।’
সবকিছুরই একটা শেষ থাকে। চল্লিশের দশক থেকে শুরু হওয়া মস্তানদের আধিপত্যে প্রথম ধাক্কা লাগে ষাটের দশকে, জঙ্গি বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনের হাত ধরে। এই প্রথম কলকাতার রাস্তায় সোর্ড, চাকু, ডান্ডা, সাইকেলের চেন (মস্তান নেতাদের কারও কারও হাতে পিস্তল), বায়রনের সোডার বোতলের বদলে আসরে নামল পেটো। সোজা বাংলায় হাতবোম। আকাশ বাতাস কাঁপানো বজ্রগর্জন। মুহূর্তে এলাকা ফাঁকা। ছিটকে যাওয়া জালকাঠি, পেরেক, ভাঙা কাচের টুকরো, স্প্লিন্টার। ঠিকঠাক লক্ষ্যভেদ করলে সোজা হাসপাতাল। মাসখানেক কমপ্লিট বেডরেস্ট। আর কপাল খারাপ হলে নিমতলা বা ক্যাওড়াতলার ইনসিওরেন্স স্কিম একেবারে পাক্কা। মূলত সেই সময়কার কলেজগুলোয় বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলির সদস্য রসায়নবিদ্যার ছাত্রদের আবিষ্কার এই পেটো। মাস্তানদের বিরুদ্ধে রাস্তার লড়াইয়ে তখন কলকাতার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে একাধিক যুব-ছাত্র নেতা-কর্মীর নাম। এরা কেউই তথাকথিত সমাজবিরোধী মস্তান নয়। স্রেফ একটা আদর্শের জন্য জান হাজির। মারতে ও মরতে প্রস্তুত সাহসী, শিক্ষিত এবং লড়াকু একদল যুবক। পেটো আর আদর্শবাদী এক ঝাঁক ছেলে। এই দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে ক্রমাগত পিছু হটতে বাধ্য হয় মস্তান বাহিনী। ‘ভানু-গোপাল বাহিনী অপরাজেয়’ এই মিথটায় কিন্তু চিড় ধরেছিল বেশ কিছুদিন আগেই। যাদবপুর অঞ্চলে একটা উদ্বাস্তু কলোনি দখলে গিয়ে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে মস্তানেরা। সে সময়কার কলোনি আন্দোলনের নেতা আমার এক সম্পর্কিত মামার কাছে শুনেছিলাম গাড়ি থেকে নেমেই নাকি হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ভানুবাবু—‘আবে, আমাকে চিনিস? আমার নাম ভানু বোস!’ কিন্তু তিনি ও তাঁর দলবল বোধহয় ‘জার্মান পার্টি’র (তত্কালীন এদেশীয়রা ওপার থেকে আসা উদ্বাস্তুদের এ নামেই ডাকতেন) মানসিকতা বুঝতে একটু ভুল করেছিলেন। একে তো সব ভিটেমাটি চাটি হয়ে এপারে এসেছে। দেশভাগ আর দাঙ্গার ক্ষত তখনও দগদগ করছে মনে। আর একবার আশ্রয় থেকে উচ্ছেদ হবার আশঙ্কা। ভিড়ের মধ্যে কে যেন চিৎকার করে উঠেছিল— ‘কে হালায় ভাউন্যা, ক্যাডা হালায় গোপাইল্যা? কে কোথায় আছস। বাইরা সব লাঠি-নাদনা লইয়া।’ এরপর শুরু হয়ে যায় যাকে বলে সংঘবদ্ধ ‘ব্লিত্জক্রিগ অ্যাটাক।’ বাঙাল নামক প্যানজার বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের সামনে কোনওমতে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে বাধ্য হয় মস্তান বাহিনী।
আবার প্রসঙ্গে ফিরি। ছাত্রযুবদের প্রতিরোধের সামনে পড়ে সেই যে পিছিয়ে আসার শুরু সেটা অন্তিম আকার নেয় নকশাল আমলে। পাড়ার মোড়ে, অলিতে গলিতে রাগী রোগা-রোগা চেহারার সবে দুধের দাঁত গজানো বাচ্চা ছেলেগুলো স্রেফ ধমকাচ্ছে না, বেশি বেগড়বাই করলে জানে মেরে দেবে— এ ভয়টা পুরনো বনেদি মস্তানদের মধ্যে চেপে বসল। এরই মধ্যে কোলে মার্কেটের সামনে এলাকার উঠতি বাঙালি ক্রিশ্চান ছেলে রনি গোমস এবং তার দলবলের হাতে বেধড়ক মার খেয়ে হাসপাতালে যান ভানু বোস। মাসাধিককাল মৃত্যুর সঙ্গে টানাহ্যাঁচড়া করে ফিরে এলেও পুরনো দাপট আর ফিরে পাননি কোনওদিনই। আশির দশকেও মাঝে মাঝে দেখতাম মৌলালির মোড়ে পেতল কাঁসার বাসনের দোকানগুলোর সামনে টুলে বসে আছেন চুপ করে। হাতে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের ভাঁড়। কীরকম একটা উদ্ভ্রান্ত ফাঁকা দৃষ্টি। পরাজিত কোনও সম্রাটের মতো। ভানু বোসের পতনের মধ্যে দিয়েই চল্লিশ থেকে ষাট দশকব্যাপী মস্তান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম তারকেশ্বর-চন্দননগরের রবিনহুড। রাম চ্যাটার্জি। ক্ষমতার খাঁজ-খোঁজ-গলিঘুঁজি এবড়ো খেবড়ো আর পিছল রাস্তা টপকে কীভাবে বাহুবলী থেকে রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে উন্নীত হয়েছিলেন সে এক অন্য ইতিহাস।