এই চত্বরে যাদের বহুদিনের আনাগোনা তাদের অবশ্যই মনে থাকবে আনন্দবাজার তাঁবু ক্যান্টিনে গরম ঝরঝরে সরু চালের ভাত আর কাটাপোনার ঝোল। ধোঁয়া ওঠা থালার একপাশে আধ টুকরো পাতিলেবু আর পেঁয়াজ। মনে পড়তেই অ্যাতোদিন বাদেও স্যালাইভার নিঃসরণ জিভের ডগায়। আসলে সময় তখন অনেক অলস, সহজ সরল আর নিরুপদ্রব ছিল। সেই পুরনো ইডেন গার্ডেন। পাঁচ দিনের টেস্টম্যাচ। চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েসলি হলের বাম্পার বল (বাউন্সার নয়), চন্দ্রশেখরের বিষ মেশানো স্পিন আর গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথের লেটকাট দেখে লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে অনেকেরই ঠিকানা সোজা আনন্দবাজার ক্যান্টিন। টেস্ট ক্রিকেট থেকে পুরনো ইডেন গার্ডেন— সময়ের করাল গ্রাস অনেক কিছুই খেয়েছে। সেই সর্বগ্রাসী সময়ের থাবা এড়িয়ে আনন্দবাজার ক্যান্টিনের মাছের ঝোল ভাত আজও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে কিনা জানা নেই। আপাতত স্মৃতিসরণি থেকে বেরিয়ে একটু অন্য পথে হাঁটা যাক। ময়দানের এ অঞ্চলটা ছেড়ে রেড রোড টপকে শহিদ মিনারের তলায় পড়ন্ত বিকেলে রচিত হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্যপট। মিনার লাগোয়া ময়দান জুড়ে বসে গেছে বিকিকিনির হাট। শেকড়বাকড় আর হেকিমি তেলের পশরা সাজিয়ে বসা বেদে-বেদেনি, ঢোলক বাজিয়ে খনখনে যৌন আবেদন মাখা গলায় আদি রসাত্মক গান গাওয়া যাযাবরী মহিলারা, দড়ির ওপর দিয়ে বাঁশের পোল হাতে ব্যালান্স করে হেঁটে যাওয়া বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ে। অ্যালুমিনিয়ামের ত্যাড়াব্যাঁকা থালা নিয়ে দর্শকদের কাছে পয়সা চাওয়া ছোট ভাইটা, একটু আগে টায়ারের রিঙের ফাঁক দিয়ে গলে যাবার খেলা দেখিয়েছে, জটপাকানো চুল, চোখে তিনদিনের পিচুটি… দড়ি বেয়ে এগিয়ে আসছে মেয়েটা। শতচ্ছিন্ন নোংরা ফ্রক, মুখে চাপ চাপ ময়লা, জটপড়া চুল, চোখে অপার ক্লান্তি। দড়ি টাঙানোর বাঁশের এক কোণে অপেক্ষারত সতর্ক বাবা মা। এ প্রান্তে এসে বাঁশটা ফেলে দিয়ে লাফিয়ে পড়া মাত্র লুফে নেবে মেয়েকে। একটা গোটা সার্কাস পরিবার। এর থেকে হাত দশকে দূরে ছোট টুল পেতে বসে সান্ডার তেল আর শিলাজিৎ বেচছেন জাঁদরেল চেহারার খান সাহেব। পরনে পাঠান স্যুট। মাথায় বিশাল পুশতুনি পাগড়ি। পাশে দাঁড়ানো তাগড়াই চেহারার তিন ছেলে। সহকারী। বাজখাঁই গলায় হুঙ্কার ছাড়ছেন খান সাহেব, “ইয়ে বাঙালি! মুড়ি খাকে বাড়ি বনাতা হায়। লেকিন জওয়ানি কে উপ্পর ধ্যান নহি দেতা… মেরি বাত মানো, ইয়ে খান কা শিলাজিৎ লো। রাত কো অ্যায়সা খেল খেলোগে কি বিবি পুছেগি— ‘ওয় মেরি জান, তুমনে আজ ক্যা খায়া?’ তব তুম বিবিকো বতানা— ‘হাম খান কা শিলাজিৎ খায়া’…” গলা চড়ছে খান সাহেবের। ভিড় বাড়ছে খান সাহেবকে ঘিরে। দুর্বল বাঙালি জাতিকে পুরুষ বানানোর ইজারা নিয়েছেন খান সাহেব। বরাবর খেয়াল করেছি যারা খান সাহেবের আসল খদ্দের, তারা কখনওই বক্তৃতা চলাকালীন কেনাকাটা করবেন না। ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকবেন ভিড়ের পিছনে। ভাষণ শেষ হবার পর আনকা পাবলিকের ভিড় হালকা হয়ে গেলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে খানসাহেবের সামনে ঝুঁকে পড়ে মিনিট দুয়েক গুজগুজ ফুস ফুস। জেনে নেওয়া ব্যবহারের নিয়মকানুন। মানিব্যাগ থেকে দ্রুত বের করে আনা কয়েকটা দশ বিশ টাকার নোট। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি হাতে পাওয়া মাত্র টুক করে কেটে পড়া অকুস্থল থেকে। কোনওদিক না তাকিয়ে। খান সাহেবের প্রায় গা ঘেঁষে ইয়াসিন। মেটিয়াবুরুজে বাড়ি। সঙ্গে ভুল্লু। হাড় জিরজিরে নেড়ি কুকুরছানা। ইয়াসিনের নির্দেশে একটা ডালডার কৌটোর ওপর উঠে দাঁড়াবে ভুল্লু। ফের নেমে আসবে। আকারে তুলনামূলকভাবে ছোট আরেকটা কৌটো চড়ানো হবে ডালডার কৌটোর ওপর। ফের চড়ে বসবে ভুল্লু। এভাবে ক্রমাগত কৌটোর আকার ছোট হতে হতে একটা জর্দার কৌটো। ভুল্লুর দাঁড়াবার শেষ আশ্রয়স্থল। চারপাশে ফটাফট হাততালি আর ছুঁড়ে দেয়া একটাকা। দু’টাকা… ইয়াসিন আর ভুল্লুর পেটের ভাত। সেই ছোটবেলায় দেখা রাশিয়ান সার্কাস থেকে নিয়ে জেমিনি সার্কাস, কমলা সার্কাস… বাঘ, সিংহ, হাতি, শিম্পাঞ্জি, কুকুর… এক সে না মানুষি খেলোয়াড়ের কসরৎ আর কেরামতি দেখেছি। ভুল্লুর তুল্য খিলাড়ি চোখে পড়েনি আজ অবধি। গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি কথাটা।
আসুন এবার খানসাহেব, ইয়াসিন আর ভুল্লুর থেকে নজর সরিয়ে আরেকটু সামনে এগোনো যাক। স্পোর্টিং ইউনিয়ন আর কাবাডি অ্যাসোসিয়েশনের তাঁবুর মাঝখানে একটুকরো ঘাসজমিতে একটা জলচৌকির ওপর রামচরিত মানস রেখে দুলে দুলে পড়ে চলেছেন কথকঠাকুর— “বন মে চলে রামচন্দ্রজী/পিছে সীতা, লছমন ভাই…” পরনে শ্বেতশুভ্র ধুতি-ফতুয়া, কপালে চাল-চন্দন আর সিঁদুরের টিকা, গানের গলাটি ভারী মিঠে। সামনে বসা নিম্নমধ্যবত্তি অবাঙালি ভক্তের দল। সপরিবারে। প্রতিটি দোঁহা শেষ হবার পর হেঁকে উঠছেন কথকঠাকুর— “জয় সিয়া বোলো রামচন্দ্রকি…” “জয়!” সমবেত গলায় সাড়া দিচ্ছে ভক্তরা। পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে লাঠিতে টাঙানো বেলুনওয়ালা, চিনেবাদাম, ঝালমুড়ি, কাটা শাঁখালু, বাচ্চাদের জন্য সস্তা ছিটের ফ্রক-জামা বিক্রেতার দল। প্রবচনসুধা পানের পাশাপাশি কেনাকাটাও চলছে টুকটাক। কথকতা শেষ। রামচরিতমানস বন্ধ করে উঠে দাঁড়াচ্ছেন কথকঠাকুর। মিষ্টি হেসে নমস্কার করছেন। ভক্তরা যে যার সাধ্যমতো পাঁচ টাকা, দশ টাকা নামিয়ে রাখছেন সামনে। প্রণাম করছেন সাষ্টাঙ্গে। কথকঠাকুর তাতেই খুশি। যতবার দেখেছি ততবারই মনে হয়েছে— ‘আরে, এটাই তো আমার দেশ। ভারতবর্ষ ছড়িয়ে রয়েছে এই একফালি ময়দানে।’
ছায়ামূর্তিরা আসে জীবিকার সন্ধানে
অতঃপর সন্ধে নামে ময়দানে। নিঝুম হয়ে আসা ক্লাবতাঁবু। টিম হারার দুঃখে ম্লানমুখ সমর্থক, যাযাবরি মেয়েরা, মাদারি পরিবার, খানসাহেব, ইয়াসিন, ভুল্লু, কথকঠাকুর, ক্লান্ত খেলোয়াড় আর রেফারির দল… সবাই ঘরমুখো আজকের মতো। ময়দান মার্কেটে জামাকাপড় আর খেলার সরঞ্জামের দোকানগুলোয় ঝাঁপ পড়তে থাকে। একটু দূরে বাসগুমটি থেকে ভেসে আসা ‘মালদা, রায়গঞ্জ, শিলিগুড়ি…’ হাঁক। দিনের বেলা ময়দানের চরিত্ররা প্রায় সবাই চলে গেলেও থেকে যান ঝালমুড়ি, বাদামওয়ালার দল। এদের সঙ্গে এসে যোগ দেন আরও কিছু বিক্রেতা যাদের দিনের বেলা কখনওই দেখা যাবে না ময়দানে। যেমন বিমলদা। গামছার বিড়ে বাঁধা মাথার ওপর গরম ঘুগনির ডেকচি। শালপাতার বাটিতে করে ধরিয়ে দেন খদ্দেরদের হাতে হাতে। বিমলদা একসময় ডানলপে চাকরি করতেন। সব খুইয়ে ডেকচি মাথায় এই রাতের ময়দানে। বন্ধ কারখানার দরজা কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু। শুধু কাড়তে পারেনি ঠোঁটের কোণে কখনওই হার না মানা জেদি নাছোড় হাসিটা। সেলাম বিমলদা। বিমলদা ছাড়াও রাতের ময়দানে অবশ্যই দেখা মিলবে নরহরিদার। নরহরি বেহড়া। আদি নিবাস ওড়িশার জগত্সিংহপুর। গলায় ঝোলানো মাটির হাঁড়িতে কুলফি মালাই। ভারী মিঠে গলায় ‘কুলফিইই… কুলফি মালাইইই…’ ডাকটা শুনলে খাওয়ার আগেই প্রাণটা জুড়িয়ে যাবে। নরহরিদার মূল আকর্ষণ গাঢ় সবুজ রঙের সিদ্ধিমেশানো কুলফি। রসিকজনেরা তেমনভাবে চাইলে কুলফির সঙ্গে ফাউ হিসেবে পাওয়া যায় খানিকটা কাঁচা সিদ্ধিবাটা। অলৌকিক এক দুনিয়ায় পৌঁছে যাবার চাবিকাঠি।