যা একই সঙ্গে মজার এবং বেশিরভাগ দুঃখের। আমাদের বন্ধু সালাউদ্দিন, অগাধ ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে। রেসের নেশা প্রবল। সঠিক সময়টা মনে নেই, মোটামুটি আশির দশকের মাঝামাঝি রয়্যাল চ্যালেঞ্জ নামে বিখ্যাত ঘোড়ার ওপর হাজার তিরিশেক বাজি ধরেছিল। প্রাণীটির ট্র্যাক রেকর্ড মারাত্মক— দেশের সব কটা ডার্বিতে জয়ী। রেস শুরু হওয়ার পর দেখা গেল ‘রয়্যাল চ্যালেঞ্জ’ দৌড়োচ্ছে রাজাবাজারের মোড়ে দাঁড়ানো ছ্যাঁকড়া গাড়ির ঘোড়ার চেয়েও ঢিমেতালে। ডেডলাস্ট, স্বাভাবিকভাবেই। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে গ্যালারিতেই মুখে গ্যাঁজলা তুলে অজ্ঞান সালাউদ্দিন। বাজি জেতার টাকায় আনন্দ করার বদলে বন্ধুকে নিয়ে ছুটতে হয় পি জি। হাসপাতালে দিন তিনেক কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। মাঠমুখো আর হয়নি কোনওদিন।
দ্য এন্ড…
কথাটা বলার আগে জানিয়ে রাখি-আরও দু’-এক ধরনের জুয়া চলে এ শহরে। দিওয়ালির রাতে অবাঙালি শ্রেষ্ঠীদের তাসের বাজিতে কোটি কোটি টাকার পকেটবদল ঘটে যায় ঘণ্টা ছয়েকের মধ্যে। এ ছাড়াও আছে ‘হাউজি’, উচ্চবিত্ত মহিলারা এক-একটি নম্বর বা ঘরের ওপর টাকা লাগিয়ে খেলাটা খেলে থাকেন। তবে এগুলো এতটাই সাময়িক আর নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ যে এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে কলমের খাপ বন্ধ করলাম। ঠিক আছে?
০৪. ময়দান-ই-কলকাতা
“বুঝলি তো, নেক্সট সিজনে বাবুদা বলেছে এরিয়ানে সাইন করিয়ে দেবে। তিরিশ হাজার অ্যাডভান্স… থোক হাতে হাতে। পেলেই নাইকের সি আর সেভেন বুটটা কিনে ফেলব। ওই তোর ময়দান মার্কেটের আলি জালি মাল নয়। এ্যাক্কেবারে অরিজিনাল। গ্র্যান্ডের তলায় কাচের শোকেসে সাজানো রয়েছে। সাত হাজার মতো পড়বে। আসতে যেতে রোজ দেখি একবার করে। অনেক দিনের ইচ্ছে মাইরি… শুধু একবার সাইনটা হয়ে গেলেই…।” “হবে হবে গুরু, চিন্তা করবি না একদম। চোখের সামনে মেহতাবকে দ্যাখ। বাসুদেবকে দ্যাখ… বাসুদেব, কালীঘাটের ফুটপাতে একটা চায়ের দোকান ছিল ওর বাবার। সেখান থেকে উঠে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান হয়ে ইন্ডিয়া ক্যাপটেন। ভাবা যায়! ওদের যদি হয় তা হলে আমাদের হবে না কেন?… চ চ, তাড়াতাড়ি পা চালা… ওদিকে আবার প্র্যাকটিসে দেরি হয়ে যাবে।”
ভোরবেলা। কুয়াশাঘেরা ময়দান। কথা বলতে বলতে মেয়ো রোডের মোড় পার হচ্ছিল ছেলে দুটো, রোগা, কালোকালো চেহারা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে ময়দান মার্কেটের সস্তা জার্সি, মোজা, অ্যাংক্লেট, বুট, নিক্যাপ…। চোখ-ভরতি স্বপ্ন। বাসুদেব মণ্ডল, মেহতাব হোসেন হয়ে ওঠার। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতো সাত হাজারি বুট পরে মাঠে নামার… তারপর ব্যাঙ্ক বা মেট্রোরেলে একটা চাকরি। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, চার্চিল, ডেম্পো, ইন্ডিয়ার জার্সি, হালিশহর বা চাকদায় পুরনো ধচাপচা টালির বাড়িটা ভেঙে দোতলা বাড়ি একটা। ই এম আইয়ে কেনা বাইক, স্মার্ট ফোন… জন্মে ইস্তক দেখে আসা খাটতে খাটতে কোলকুঁজো মেরে যাওয়া দোকান কর্মচারী বাবার একটু অবসর। সাত সকালে উঠে কয়লার উনুনে ফুঁ দিতে দিতে গলার শিরা নীল হয়ে যাওয়া মা’র জন্য একটা গ্যাসওভেন। দিদিটার বিয়ে… তাবৎ স্বপ্ন চোখে পুরে ওই দুটো ছেলের মতো আরও হাজার হাজার ছেলে লোকাল ট্রেন আর কলকাতা-মফস্সল বাসে চেপে ভোরের ময়দানে পাড়ি জমায় রোজ। শুধু কি ছেলেরা? ঠিক একইরকম সামাজিক অবস্থান থেকে উঠে আসা মেয়ের দল, পরনে রং চটে যাওয়া মলিন ট্রাকসুট, তার চেয়েও মলিন চোখমুখের চেহারা, দৌড়োচ্ছে রেড রোডের ধারে ঘাসজমিতে, মোহনবাগান ক্লাবের গায়ে ফুটপাত ধরে। প্রাণ আর ইজ্জত হারানোর ভয়কে নিত্যসঙ্গী করে। এই তো কয়েক বছর আগে কিছু ধনীর দুলাল চলন্ত গাড়ি থেকে হাত বাড়িয়ে ওদের মতো একজনকে ধরে ফেলেছিল খপ করে। চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে গেছিল দুশো মিটারখানেক। তারপর আহত অবস্থায় ফেলে দিয়ে খ্যা খ্যা হায়না হাসি হাসতে হাসতে চলে গেছিল গাড়ি চালিয়ে। তবু মেয়েগুলো আসে। কারণ ওই যে স্বপ্ন। বুট-জার্সি কাঁধে রাস্তা পেরোনো ওই ছেলেদুটোর মতো। শুধু স্বপ্নের নামগুলো বদলে গেছে। বাসুদেব, মেহতাবদের জায়গায় জ্যোতির্ময়ী শিকদার, সোমা বিশ্বাস, কুন্তলা ঘোষ দস্তিদার… বাকিটা হুবহু এক।
কলকাতা ময়দান। সেই ব্রিটিশ আমলেরও আগে থেকে শহরের বুকে বড় একটুকরো সবুজ। কলকাতার ফুসফুস। সারা দেশে আর কোনও শহরে একলপ্তে এতটা ফাঁকা সবুজভূমি রয়েছে বলে এই প্রতিবেদকের অন্তত জানা নেই। অদ্ভুত বৈচিত্র্যময় এই ময়দান। একে ঘিরে গড়ে ওঠা কত মিথ, কত রহস্য, কত স্বপ্ন গড়ে ওঠা আর ভেঙে যাওয়ার কাহিনি। কাকভোর থেকে গভীর রাত— পরতে পরতে রং বদলায় এর। বদলে যায় চরিত্র। সকালের প্র্যাকটিস সেরে চলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের গায়ে গায়ে লেগে দুপুর নেমে আসে ময়দানে। সি এ বি ক্লাব হাউসের উলটোদিকে বিখ্যাত বটতলা। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান আর মহামেডান মাঠের ফাঁকা গ্যালারি আর আশপাশের ফাঁকা জমিতে, রেড রোডের পাঁচিলে, কার্জন পার্কের আনাচেকানাচে, ইডেনে প্যাগোডার ছায়ায় ছোট ছোট জটলা। কতরকম আড্ডা। কতরকম মানুষ। ভবঘুরে, চিটিংবাজ, বেকার, নিত্যরোজ অফিসের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া চাকরি খোয়ানো মানুষ, গেঁজেল, তাসের জুয়াড়ি, ক্লাব টেন্টের ধারে বসে সেই কবে হাবিব, পরিমল দে, সুধীর কর্মকার, আর ফুটবলের স্বর্ণযুগ চর্চায় ব্যস্ত ক্ষয়া ক্ষয়া চেহারার লোকজন, চোলাই মদ, ড্রাগ আর রক্তাল্পতায় আক্রান্ত ফোলা ফোলা ফ্যাকাসে চোখমুখের পেশাদার রক্তদাতা। ফোর্ট উইলিয়ামের দেয়াল ঘেঁষা ঝোপঝাড়ে ভর দুপুরবেলায় খদ্দেরকে হাতছানি দেয়া সস্তা বেশ্যা, আধময়লা ফাটাফুটো শাড়ি, ময়দানের পুকুরে কঞ্চির ছিপে কেঁচো গেঁথে ত্যালাপিয়া ধরা কাঙালি, ছাগল ভেড়া চরানো হাটুরে, উনুনের ওপর কেটলি বসিয়ে এ আড্ডা থেকে ও আড্ডায় ঘোরাফেরা করা চাওয়ালা… বেমতলব গরিব মানুষজন সব। নবারুণের ভাষায় ফ্যাতাড়ু। সারপ্লাস পিপল, অলস দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে ময়দানে। দুপুরের নিঝুম অলস ভাবটা একঝটকায় মুছে যায় ময়দানের মুখ থেকে। বিশেষত ফুটবলের মরশুমে। হাওড়া, তালতলা, বাগবাজার, দমদম, বেলঘরিয়া, যাদবপুর, চিৎপুর, কলুটোলা, রাজাবাজার থেকে দলে দলে ময়দানমুখো ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান সমর্থক আর তাদের জঙ্গিপনাকে সামাল দিতে ঘোড়সওয়ার পুলিশ। যদিও আই পি এল, আই এস এল আর ফি শনি-রোববার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দাপটে কলকাতা ফুটবলের সে রমরমা আর নেই, একইসঙ্গে সমর্থকদের মধ্যে ষাট-সত্তরের সেই উগ্র জঙ্গিপনার ভাবটা অনেকটাই অন্তর্হিত এখন, তবুও রোজ সকাল বিকেল দু’বেলা ময়দানে মাউন্টেড পুলিশের উপস্থিতি ইংরিজিতে যাকে বলে— ‘মাস্ট,’ ময়দানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আজও অনেকখানি ওদেরই হাতে। এ ছাড়া ফুটবলের পাশাপাশি ময়দানের সর্বত্র বিরাজমান বাঁধাকপি, টমাটো বা ধনেপাতার মতো বারোমেসে হয়ে যাওয়া ক্লাব ক্রিকেট, ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং ক্যাম্প আর বাঁশের খুঁটিতে জাল টাঙিয়ে নেট প্র্যাকটিস। নেটে অনুশীলনরত কচি কচি মুখ। গ্রীষ্মের তপ্ত অপরাহ্ণে ঘেমে পুড়ে লাল। মাঠের একধারে রাখা ইয়া ঢাউস কিটসব্যাগ আর হাতে হেল্থ ড্রিংকসের বোতল, উদ্বিগ্ন মায়ের দল। সবাই ছেলেকে সৌরভ বানাতে চান, এই সর্বগ্রাসী ক্রিকেট ম্যানিয়ার দাপটে পিছু হটতে হটতে প্রায় দেয়ালে পিঠ ঠেকার জোগাড় গরিবগুর্বো ময়দানি ফুটবলের। অতীতে ফুটবলের আঁতুড়-ঘর একাধিক বিখ্যাত সব ক্লাব এরিয়ান, রাজস্থান, খিদিরপুর, উয়াড়ির তাঁবুগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত চেহারা দেখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। কংকালসার কাঠামো জীর্ণ তেরপলের ছাদ, ফুটো দিয়ে জল পড়ে বর্ষাকালে। অতীত গৌরবের সাক্ষী হয়ে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজও ময়দানের বুকে। ক’দিন থাকবে জানা নেই, ভাবলেই ভারী হয়ে যায় মনটা। যাকগে, আপাতত এই মনখারাপের এলাকা থেকে বেরিয়ে চলুন একটু অন্যদিকে নজর ঘোরানো যাক। সারাবছর প্রায় নিয়মিত খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিনগুলোর পাতা ওলটালেই বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁ দোকান এমনকী ফুটপাতের খাবার নিয়েও প্রচুর লেখা দেখতে পাওয়া যায়। কেন জানি না ময়দান সেই তালিকায় ব্রাত্য অদ্ভুতভাবে। অথচ সকাল থেকে রাত অবধি কতরকম খাবারের যে আনাগোনা উপস্থিতি গোটা ময়দান জুড়ে। যার মধ্যে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ— ‘ডান্ডাপানি’ এ রাজ্য তো বটেই, সারা দেশে তথা বিশ্বের আর কোথাও এ বস্তুটি পাওয়া যায় বলে জানা নেই। একমাত্র এই ময়দান চত্বর ছাড়া। দু’চাকার ঠেলাগাড়িতে বসানো একটা বড় টিনের ড্রামে ভরতি জল। এটা ডান্ডা-লাগানো পাত্রে তুলে চোঙার মধ্যে দিয়ে পরিবেশন করা হয় গেলাসে গেলাসে। প্রয়োজন মতো লেবুর রস, বরফ, জলজিরা, বিটনুন বা স্যাকারিন সিরাপ মিশিয়ে। স্বাদে লা-জবাব, অত্যন্ত সস্তা, সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত। দীর্ঘদিন ঘোরাফেরার অভিজ্ঞতা ময়দান চত্বরে। ডান্ডাপানি খেয়ে কারও পেট খারাপ হয়েছে বলে শুনিনি কোনওদিন। তবে সবকিছুর ওপরে থাকবে বিভিন্ন ক্লাব তাঁবুতে ক্যান্টিনের খাবার। প্রেস ক্লাবের উলটোদিকে ভেজিটেবল চপ আর ঘুগনি, হাওড়া ইউনিয়ন টেন্টের ফ্রিশফ্রাই। ছাঁকা তেলে ভাজা সোনালি কুইজিন! এককথায় দেবভোগ্য। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা প্রার্থনীয়। কিন্তু সেরার সেরা অবশ্যই কাস্টমস বা সেন্ট্রাল এক্সাইজ টেন্টে বাটার টোস্ট, চিকেন অথবা ভেজিটেবল স্টু। দুধসাদা পিরিচে পেঁপে, গাজর, আলু আর আর তাজা মুরগির মাংস, ফ্রেশ ক্রিমের মাধুরী মিশিয়ে, গরম গরম। সাহেবি কেতায় যাকে বলে ‘পাইপিং হট’। এককথায় অলৌকিক এক পাকপ্রণালী। সঙ্গে কড়া লিকারের চা, সঠিক পরিমাণে দুধ মিশিয়ে। জাস্ট কোনও কথা হবে না।