তখন বয়স বাও কি ত্যাও। পুরনো পাড়া গড়পারে একটি মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক কাউন্টারের সামনে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফাস গলায় দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন—‘সেনবাবু আছেন?’ দোকানি অর্থপূর্ণ চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল, মানে আছে। তারপর দোকানের কর্মচারী ছেলেটিকে বলল—‘দাদাকে ভেতর থেকে দশটা সেনবাবু এনে দে।’ কর্মচারী চলে গেল। মিনিট পাঁচেক বাদে ফিরে এল হাতে একটা প্যাকেট। তড়িঘড়ি খদ্দেরের হাতে গুঁজে দিল। ভদ্রলোক যেন রাজ্য লটারির ফার্স্ট প্রাইজ মেরেছেন এরকম মুখের ভাব, দাম মিটিয়ে চলে গেলেন কোনওদিকে না তাকিয়ে। সেনবাবু কী করে প্যাকেটে থাকেন? দোকান মালিককে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। সন্ধের পর বাবা বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞেস করে গূহ্য কথাটা জানতে পারি। সেটা ষাটের দশক। অদ্ভুত এক সরকারি নির্দেশে মিষ্টির দোকানে ছানার ব্যবহার বন্ধ করা হয় বেশ কিছুদিনের জন্য। কিন্তু বাঙালি বলে কথা। সন্দেশ রসগোল্লা ছাড়া কি চলে? অনেক মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীই লুকিয়ে চুরিয়ে তৈরি করতে শুরু করলেন ছানার মিষ্টি। রাজ্যের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের নামে মিষ্টির কোডনাম হল ‘সেনবাবু’। অনেককাল পরে এই সেনবাবুর মতো আর এক দাসবাবুর আবির্ভাব ঘটেছিল বাজারে। নব্বইয়ের শেষ বা দু’হাজারের গোড়ায়। সঠিক সময়টা ভুলে গেছি। বাজারে রিলিজ করেছে সঞ্জয় লীলা বনশালীর (শরত্চন্দ্রের নয়) দেবদাস। সুপার ডুপার হিট। দর্শক ফেটে পড়ছে হলে। শোয়ের পর শো হাউসফুল। এই সাফল্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হল ভিডিও পাইরেসি। পঞ্চাশ-একশো টাকায় জাল দেবদাসে ছেয়ে গেল বাজার। প্রমাদ গুনলেন প্রোডিউসার-ডিস্ট্রিবিউটররা। আইনের দ্বারস্থ হলেন তাঁরা। ভিডিও পার্লার স্টলে শুরু হল রেইড। ফলে দেবদাস নামক সিডি মহোদয় নাম পরিবর্তন করিয়া হইলেন ‘দাসবাবু’। হুবহু গড়পারের সেই ভদ্রলোকের মতো দোকানে গিয়ে স্রেফ ‘দাসবাবু’র খোঁজ করবার ওয়াস্তা। খবরের কাগজ বা কালো পলিপ্যাকে মোড়া কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি চলে আসবে ক্রেতার হাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘সেনবাবু’ ‘দাসবাবু’রা বিদায় নিলেও ‘পাকা পেঁপে’, ‘গরমমশলা’ বা ‘পানু’রা কিন্তু বাজারে রয়ে গেছে। পার্মানেন্টলি। আজ্ঞে হ্যাঁ। পর্নোগ্রাফির ভিডিও সিডি বাজারে এ নামেই পরিচিত।
সবশেষে একটু বাজারে ঢোকা যাক। ভবানীপুরের রূপচাঁদ মুখার্জি লেনে মামাবাড়ি। জয়েন্ট ফ্যামিলি। এক রোববারে বাবা-মা’র সঙ্গে গেছি। ঠিক হল মাংস হবে। বাজারের দায়িত্বে মেজোমামা। সঙ্গে থলে হাতে ল্যাংবোট আমি। জগুবাজারে মাংসের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পাঞ্জাবি দোকানদার, দাড়িভর্তি মুখে একগাল হাসি— আরে, বাবুরা এসে গেছে। ভেতর থেকে ভাল দেখে দে। এহেন আপ্যায়নে মেজোমামা তো বটেই ভাগ্নেও যারপরনাই পুলকিত। বিজয়গর্বে হাতে থলে ঝুলিয়ে বাড়ি তো ফেরা হল। ধুয়ে পাকলে কড়াইয়ে চাপাতেই সে এক কেলেঙ্কারিয়াস কাণ্ড। উৎকট বোঁটকা গন্ধে টেকা দায়। নাকে আঁচল চেপে দিদিমার চিল চিৎকার— ‘ফ্যালায়া দে। ফ্যালায়ে দে… পচা মাংস দিছে…মাগো…।’ নামী কোম্পানির দামি অফিসার বড়মামা—‘পচা নয়। রামপাঁঠা। ইট মাস্ট বি হি গোট।’ হাঁড়ির সামনে বসা মা’র মুখটা অনেকটা স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধে পরাজিত হিটলারের মতো। পাড়ার লোকে তেড়ে এসে মারতে বাকি রেখেছিল। অনেকদিন বাদে মার্কেট ইন্সপেক্টর পদে বদলি হয়ে জগুবাজারে আসা বাবার এক বন্ধুর কাছে জানা গিয়েছিল ‘ভেতর থেকে’ আর ‘ভাল দেখে’ এই দুটো নাকি খাসির বদলে রাম ছাগলের মাংস গছিয়ে দেবার কোড। এ ধরনের অজস্র দুর্মূল্য কোডরত্ন ছড়িয়ে রয়েছে কলকাতার বাজারময়। কবজির সূক্ষ্ম মোচড়ে পাল্লা হেলিয়ে দেবার কায়দাকে বলে ‘হ্যাটা’ বা ‘হাতাবাবা’। পচা মাছের সাংকেতিক নাম ‘তেলো’ বা ‘লুসো’। একশো থেকে এককিলো ওজনের কাটা বা জাল বাটখারার একাধিক কোডনেম। যেমন ‘ডাকটাকি’, ‘সিকচাকি’, ‘নেত্যচাকি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ নিয়ে আর বেশি মুখ খুলব না। বুঝতেই পারছেন ছাপোষা মধ্যবিত্ত। ৩৬৫ দিন বাজার করে খেতে হয়। একটা মারও বাইরে পড়বে না। তবে এই সিরিয়ালের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এপিসোডটা দেখেছিলাম উত্তর কলকাতার নতুন বাজারে। দুধের হোলসেল মার্কেট। সার সার খড় চোবানো দুধের ড্রাম। লম্বা লম্বা চাতালে লাইন দিয়ে বিক্রেতারা বসে রয়েছেন। ডান হাতটা গামছা ঢাকা। খদ্দেররা এগিয়ে গামছার তলায় হাত ঢুকিয়ে কানে কানে বিজাতীয় ভাষায় কী সব যেন বলছেন। গামছার নীচে আঙুলের নড়াচড়া… বিক্রেতাও ফিসফিস করে উত্তর দিচ্ছেন ওই একই ভাষায়। অত্যন্ত বিনীতভাবে মানে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে বোম্বাই ধমক ছাড়া কপালে আর কিছুই জোটেনি। আমার দ্বারা তো হল না। আপনারা একবার চেষ্টা করে দেখুন না। জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন কিন্তু। এই অধমের কোড ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আরও কিছু জমা পড়বে।
০৩. ক্যাসিনো কলকাতা
মধ্য কলকাতার একটা সরু গলির মুখে একচিলতে দোকানে আধাখোলা ঝাঁপ। পঞ্চাশ পাওয়ারের টিমটিমে বালবের আলো জ্বলছে। কাঠের ছোট শোকেসের গায়ে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে সিড়িঙ্গে মতো একটা লোক। মাঝ ডিসেম্বরের হাড়কাঁপানো শীত উপেক্ষা করে রাত সাড়ে এগারোটায় দোকানের বাইরে বিশ-পঁচিশজন। ফিসফাস, উৎকণ্ঠা, আলোচনা নিচুস্বরে, পৌনে বারোটা তো বাজতে চলল। খবর আসতে কত দেরি? ক্রিং ক্রিং…দূর থেকে সাইকেল ঘণ্টির আওয়াজ…ওয়ান টু সিক্স— নয়লা। বলতে বলতে পাস দিয়ে চলে গেল সাইকেল আরোহী। দোকানের মধ্যে ঝিমোতে থাকা সিড়িঙ্গে লোকটা মুহূর্তে গা ঝাড়া দিয়ে শোকেসের কাচ সরিয়ে বের করে আনল ছোট একটা শ্লেট। চক দিয়ে খসখস করে কিছু লিখে টাঙিয়ে দিল দোকানের বাইরে। তাতে লেখা— ১২৬/৯। বাইরে অপেক্ষমাণ জনতার প্রতিক্রিয়া এবার সরাসরি দ্বিধাবিভক্ত। একদল ‘বুকি’ নামক খলনায়কের পিতৃমাতৃকুল উদ্ধার করতে করতে পা বাড়াল বাড়ির দিকে। অপরদল রয়ে গেল ‘পেমেন্ট’ নামক ওয়েসিসের আশায়।