হবিব যুবককে সঙ্গে লইয়া জাফরখাঁর কবর, মসজিদ্, মদরসা প্রভৃতি দেখাইয়া তিন্তিড়ি বৃক্ষতলে ফিরাইয়া আনিল। যুবক তাহাকে কিছু অর্থ দিতে চাহিল; কিন্তু বৃদ্ধ তাহা কোন মতেই গ্রহণ করিল না। সে কহিল, “হুজুর ঠিকানা দিয়া যাউন, আমি কল্য প্রাতে দুয়ারে হাজির থাকিব এবং ফরমায়েস মত হুজুরকে সহর দেখাইতে যাইব।” যুবা তাহাকে নিরস্ত করিতে বহু চেষ্টা করিল, কিন্তু বৃদ্ধ তাহা শুনিল না। তখন যুবা বাধ্য হইয়া কহিল, “আমি মীনাবাজারে গোকুলবিহারী সেনের গৃহে থাকি, আমার নাম ময়ূখ।” বুড়া তাহা শুনিয়া যুবকের মুখে প্রচুর পরিমাণে নিষ্ঠীবন নিক্ষেপ করিতে করিতে কহিল, “তোফা বাবু সাহেব, বড় সুন্দর নাম, খোদাতালা আপনাকে যেমন খুবসুরত দিয়াছেন, নামটিও তেমনই সুন্দর। আমি কল্য প্রাতে হুজুরের দৌলতখানায় হাজির থাকিব।” বৃদ্ধ প্রস্থান করিল।
ময়ূখ যতক্ষণ হবিবের সহিত কথা কহিতেছিলেন, ততক্ষণ আর একখানি নৌকা হইতে জনৈক দীর্ঘাকার ব্রাহ্মণ তাঁহাকে লক্ষ্য করিতেছিল। হবিব চলিয়া গেলে ময়ূখ নদীর দিকে ফিরিলেন, তখন ব্রাহ্মণ তাঁহার মুখ দেখিতে পাইলেন। তিনি দুই তিন বার ডাকিলেন, কিন্তু ময়ূখ তাহা শুনিতে পাইলেন না। ব্রাহ্মণের নৌকা দূরে ছিল, তাহা ভিড়াইতে ভিড়াইতে ময়ূখ প্রস্থান করিলেন। ব্রাহ্মণ কুলে উঠিয়া আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন না।
০৬. পতিতোদ্ধারে বাধা
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
পতিতোদ্ধারে বাধা
সপ্তগ্রামে পৌঁছিয়া ময়ূখ নিত্য প্রভাতে একবার বন্দরে আসিতেন। তাঁহার মনে হইত যে হয় ত ভীমেশ্বর হইতে কেহ না কেহ তাঁহার সন্ধান করিতে আসিবে, কারণ ভুবন ফিরিয়া গিয়াছে। আর কেহ আসুক আর না আসুক ভুবন যে আসিবে সে বিষয়ে তাঁহার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। সেই জন্য তিনি প্রভাতে একবার করিয়া বন্দর অর্থাৎ সরস্বতী ও গঙ্গার সঙ্গমস্থলে আসিতেন। গৌরীপুরে ও ভীমেশ্বরে তাঁহার পিতার সভাপণ্ডিত জগদীশ তর্করত্ন তাঁহার সাহায্যের জন্য যে বিপুল আয়োজন করিয়াছিলেন, তিনি তাহার কিছুই জানিতেন না।
দিবসের দ্বিতীয় প্রহর আরম্ভ হইয়াছে দেখিয়া ময়ূখ বন্দর হইতে দ্রুতপদে গৃহে ফিরিতেছিলেন। গোকুলবিহারীর গৃহ হইতে সপ্তগ্রামের বন্দর প্রায় দুই ক্রোশ দূরে অবস্থিত, নগরের পথে ভীষণ জনতা, দ্রুতপদে চলা অসম্ভব, তথাপি ময়ূখ যথাসম্ভব দ্রুতবেগে চলিতেছিলেন। বন্দরের বাজার পার হইয়া ময়ূখ সপ্তগ্রাম দুর্গের নিম্নে উপস্থিত হইলেন। সেই সময়ে একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান দুর্গদ্বার হইতে নির্গত হইয়া ময়ূখের সঙ্গে চলিতে আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে একটি গৃহের সম্মুখে তিনজন ফিরিঙ্গি দাঁড়াইয়া আছে, তাহাদিগের মধ্যে একজন কৃষ্ণবস্ত্রাবৃত ও অপর দুইজন সাধারণ সেনা। গৃহের সম্মুখে বসিয়া একজন যুবক কাতর কণ্ঠে কহিতেছে যে, সে হিন্দু, সে খৃষ্টান হয় নাই এবং হইবে না; সে ব্যক্তি মধ্যে মধ্যে কৃষ্ণবসনপরিহিত ফিরিঙ্গীর পদযুগল ধরিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিবার জন্য মিনতি করিতেছে। ফিরিঙ্গি বলিতেছে যে সে কল্য খৃষ্টীয় ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছে, গৃহে থাকিলে তাহার আত্মীয় স্বজন দীর্ঘ নরকবাসের পথ সুগম করিয়া দিবে, সেইজন্য তাহাকে হুগলী যাইতে হইবে। এই সময়ে ময়ূখ ও তাঁহার মুসলমান সঙ্গী সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। মুসলমান ফিরিঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইয়াছে?” ফিরিঙ্গী কহিল, “আমি ধর্ম্মযাজক, এই হিন্দু কল্য পবিত্র খৃষ্টীয় ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছে, কিন্তু তাহার আত্মীয় স্বজনের পরামর্শে অদ্য পলাইয়া আসিয়াছে। সেই জন্য আমি তাহাকে হুগলীতে লইয়া যাইতে আসিয়াছি।” মুসলমান যুবককে জিজ্ঞাসা করিল, “হিন্দু, তুমি ইসাই হইয়াছ?” যুবা মুসলমানের পদতলে লুটাইয়া পড়িয়া কছিল, “দোহাই হুজুরের, হিন্দু ও মুসলমানের ঈশ্বরের দিব্য আমি খৃষ্টান হই নাই। এই পাদ্রী আমাকে জোর করিয়া খৃষ্টান করিতে চাহিয়াছিল বলিয়া আমি হুগলী হইতে সপ্তগ্রামে পলাইয়া আসিয়াছি।”
“পাদ্রী কি মিথ্যা কথা বলিতেছে?” “হাঁ। হুজুর আমাকে রক্ষা করুন।”
তখন মুসলমান পাদ্রীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ফিরিঙ্গি, হিন্দু যাহা বলিল তাহা শুনিলে? তুমি বল প্রয়োগ করিও না, কাজীর নিকটে যাও, এই হিন্দুর উপরে যদি তোমার অধিকার থাকে, তাহা হইলে, কাজী ইহাকে তোমার হস্তে সমর্পণ করিবেন।” পাদ্রী উদ্ধত ভাবে কহিলেন, “আমরা কাজীর বিচারাধীন নহি। এই হিন্দু খৃষ্টান হইয়াছে, আমি এখনই ইহাকে হুগলী লইয়া যাইব।”
“ইহা শাহান শাহ বাদশাহের এলাকা ফিরিঙ্গি,—এখানে, বল প্রয়োগ করিলে তুমি দণ্ডনীয় হইবে।” “আমাকে দণ্ড দিবার ক্ষমতা তোমার বাদশাহের পিতৃপিতামহেরও নাই। তুমি অধিক কথা কহিলে তোমাকে চাবুক লাগাইব।”
ক্রোধে মুসলমানের মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, সে নিজের কটিবন্ধ স্পর্শ করিয়া দেখিল যে তাহাতে কোন অস্ত্র নাই। তখন মুসলমান চাহিয়া দেখিল, তাহার সহযাত্রী হিন্দু যুবা তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছে। মুসলমান পুনরায় পাদ্রীকে কহিল, “ফিরিঙ্গি তোমার অপরাধ মার্জ্জনা করিতেছি। শাহনশাহ বাদশাহের নামে কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করিলে হিন্দুস্থানের আইন অনুসারে শূলে যাইতে হয়। তুমি বিদেশীয়, সম্ভবতঃ আইন কানুন জান না। এই দণ্ডে সপ্তগ্রাম পরিত্যাগ কর নতুবা মরিবে।” ফিরিঙ্গি ক্রোধে জ্ঞানশূন্য হইয়া কহিল,— “তোর মত বিধর্ম্মী কুক্কুরকে আমরা কারাগারে রাখিয়া শূকর মাংস খাইতে দিই।” মুসলমান অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল, “ফিরিঙ্গি, তোমার কি মরিতে ইচ্ছা হইয়াছে?” উত্তরস্বরূপ পাদ্রী মুসলমানের শ্মশ্রু ধরিয়া আকর্ষণ করিলেন, মুসলমান ক্ষিপ্ত হইয়া পাদ্রীর প্রশস্ত গণ্ডস্থলে এক বিরাট চপেটাঘাত করিল, স্থূল ক্ষুদ্রকায় লম্বোদর পাদ্রী আঘাতের বেগ সহিতে না পারিয়া গড়াইয় পড়িল। ফিরিঙ্গি সেনাদ্বয় তৎক্ষণাৎ মুসলমানকে আক্রমণ করিল। তখন ময়ূখ একজনের পশ্চাদ্দেশে ভীষণ বেগে পদাঘাত করিলেন, ফিরিঙ্গি তাহার ফলে ভূমি হইতে উঠিয়া পাঁচ হাত দূরে গিয়া পড়িল। তাহা দেখিয়া তাহার সঙ্গী মুসলমানকে ছাড়িয়া বন্দুক ধরিল। পথে অনেক লোক দাঁড়াইয়াছিল, তাহারা বন্দুক দেখিয়া উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল। এমন কি, যে হিন্দু যুবার উদ্ধারের জন্য মুসলমান পাদ্রীর সহিত বিবাদ করিয়াছিল সেও গৃহে প্রবেশ করিয়া কবাট রুদ্ধ করিয়া দিল। ফিরিঙ্গি বন্দুক ছুড়িল, ময়ূখ পাশ কাটাইয়া সরিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিমেষের মধ্যে মুসলমানকে টানিয়া লইয়া পথি-পার্শ্বের এক অশ্বত্থ বৃক্ষের আশ্রয় লইলেন। দ্বিতীয় ফিরিঙ্গির বন্দুকের গুলি তৎক্ষণাৎ আসিয়া বৃক্ষকাণ্ডে বিদ্ধ হইল। ময়ূখ তখন বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে রজত নির্ম্মিত একটি ক্ষুদ্র বন্দুক বাহির করিল। মুসলমান তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ইহা কি?” ময়ূখ বন্দুকটি একজন ফিরিঙ্গী সেনার দিকে ধরিয়া কহিলেন, “ইহা নূতন ধরণের বন্দুক, ইহার নাম পিস্তল।”