“অন্য ফিরিঙ্গীদের কোথাও কুঠী আছে?” “এদেশে নাই, কিছুদিন পূর্ব্বে দুইজন ইংরাজ পাটনায় একটি কুঠী খুলিয়াছিল, কিন্তু সে কুঠী বোধ হয় উঠিয়া গিয়াছে। সকলেই সপ্তগ্রামে অথবা নিকটে কুঠী খুলিবার চেষ্টায় আছে, সপ্তগ্রামের বাজারে সকল ফিরিঙ্গীর গোমস্তা খরিদ বিক্রয় করিতে আসে। এখন কেহই পর্ত্তুগীজ বণিকের সহিত পারিয়া উঠিতেছে না, তবে ওলন্দাজ ও আংরেজ একসঙ্গে মিশিলে বোধ হয় পর্ত্তুগীজের প্রভাব কমিয়া যাইবে।”
“সুবাদারের কাছে দরবার করিয়া কোন লাভ হইল না?” “না,-মোকরম খাঁ অত্যন্ত বিলাসী, পর্ত্তুগীজ বণিক্গণ নানা উপায়ে তাহাকে সন্তুষ্ট রাখিয়াছে, সেইজন্য তিনি বাদশাহের নিকট প্রজা বা অন্য জাতীয় ফিরিঙ্গীর আর্জি পেশ করিতে দেন না।”
“পর্ত্তুগীজদিগের সহিত লড়াই আরম্ভ করিলে সুবাদার কি অসন্তুষ্ট হইবেন না?” “হয়ত হইবেন। কিন্তু সুবাদারকে সন্তুষ্ট করিতে হইলে আমাকে সবংশে মরিতে হইবে।” “তবে কি করিবেন? স্বয়ং সুবাদার যদি ফিরিঙ্গীর সহিত যোগ দেন তাহা হইলে কতক্ষণ তিষ্ঠিতে পারিবেন?” “দেখি নারায়ণ কি করেন? ঠাকুর, আপনি কি করিবেন?” “মহামায়া আমাকে আপনার আশ্রয়ে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, আপনি আমাকে যাহা করিতে বলিবেন তাহাই করিব।” “দেখুন, পর্ত্তুগীজ বণিক্ অপেক্ষা পর্ত্তুগীজ পাদরী আরও ভয়ানক। আপনার আত্মীয়া পাদরীর হাতে পড়িলে তাহাকে উদ্ধার করা কঠিন হইবে।” “আমরা কি কল্য সপ্তগ্রামে পৌঁছিব?” “না, এখান হইতে সপ্তগ্রাম দুই দিনের পথ, সাধারণ নৌকা সপ্তাহের পূর্ব্বে পৌঁছিতে পরিবে না।” “ফিরিঙ্গীদের কোশা কয়দিনে পৌঁছিবে?” “দিবারাত্রি চলিলে কল্য সন্ধ্যাকালে বন্দরে পৌঁছিবে।” “আমরা একদিন পরে পৌঁছিব, তাহাতে বিশেষ কোন ক্ষতি হইবে না ত?” “বোধ হয় না।” “সপ্তগ্রামে কে কে আপনার বন্ধু আছেন?”
“বন্দরের মুন্সী হাফিজ আহ্মদ্ খাঁ, নাওয়ারার মীর আতেশ এনায়েৎ উল্লা খাঁ, খালিশা মহলের নায়েব দেওয়ান চিন্তামণি মজুমদার এবং ফৌজদারের খাজাঞ্চি হরিনারায়ণ শীল।” “চিন্তামণি মজুমদার ও হরিনারায়ণ শীল এখনও সপ্তগ্রামে আছেন। দুই বৎসর পূর্বে হাফিজ আহমদ্ খাঁর মৃত্যু হইয়াছে এবং এনায়েত উল্লা খাঁ জহাঙ্গীর নগর গিয়াছেন। ফৌজদারের সহিত কি আপনার পরিচয় আছে?” “না, তবে সুলতান সাজাহানের সহিত যখন উড়িষ্যার নায়েব নাজিম আহমদ্ বেগখাঁর যুদ্ধ হইয়াছিল, তখন পিতা ও কলিমুল্লা খাঁ পিপলি হইতে বর্দ্ধমান পর্য্যন্ত এক সঙ্গে ছিলেন, আকবর নগর ও জহাঙ্গীর নগরের যুদ্ধে পিতা আহামদ্ বেগ খাঁর দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ ছিলেন। নাওয়ারার কোন কর্ম্মচারী কি এখন সপ্তগ্রামে আছেন?” “আছেন; আমীরউলবহর আসদ খাঁ কিছুদিন পূর্ব্বে সপ্তগ্রামে আসিয়াছেন।”
“বড়ই সৌভাগ্যের কথা, আসদ্খাঁও আমার পিতৃবন্ধু, মহবৎখাঁ ও খানাজদ্খাঁ সুবাদারীর সময়ে পিতা বহুদিন আসদখাঁর সহিত একসঙ্গে বিদ্রোহদমন কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন।” “সুবাদারের কর্ম্মচারীদের মধ্যে কাহারও সহিত আলাপ আছে কি?” “নায়েব কানুনগো ভগবান্ রায় পিতার বন্ধু, আর কাহারও নাম স্মরণ নাই।” “অনেক রাত্রি হইয়াছে, বিশ্রাম করুন, সপ্তগ্রামে পৌঁছিয়া পরামর্শ করা যাইবে।”
গোকুল, গোষ্ঠ ও ময়ূখ কক্ষমধ্যে শয়ন করিলেন। রাত্রি শেষে নৌকা থামিল, কেনারাম আসিয়া গোকুলকে জাগাইল এবং কহিল, “হুজুর, সম্মুখে অনেক নৌকা দেখা যাইতেছে, সমস্তই গরার ও কোশা। একখানা পঞ্চাশ তোপের গরার ঠিক গঙ্গার মাঝখানে নোঙ্গর করিয়া আছে, নৌকা কি চালাইব?”
গোকুল, গোষ্ঠ ও ময়ূখ নৌকার বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন এবং দেখিলেন যে, নৌবাহিনীর আলোকমালায় অন্ধকার গঙ্গাবক্ষ দিনের ন্যায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা দেখিয়া গোকুলবিহারী কহিলেন, “বোধ হয়, বাদশাহী বহর; কেনারাম, তুমি ধীরে ধীরে ছিপ বাহিয়া গরারের নিকট চল।” ছিপ ধীরে ধীরে চলিল। গরারের শত হস্ত দূরে পৌঁছিলে গরারের উপর হইতে শান্ত্রীপাহারা হাঁকিল, “নৌকা তফাৎ, কাহার ছিপ্?” ছিপ্ হইতে গোকুলবিহারী কহিলেন, “সপ্তগ্রামের বণিক্ গোকুলবিহারী সেনের ছিপ্, সপ্তগ্রামে যাইব।” “কোথা হইতে আসিতেছ?” “জহাঙ্গীর নগর হইতে।” “ছাড় আছে?” “আছে।” “দাঁড়াও।”
গরার হইতে একখানি ছোট নৌকা আসিয়া ছিপে লাগিল, একজন নাখোদা আসিয়া জহাঙ্গীরনগর বন্দরের ছাড়পত্র দেখিয়া পুনরায় ফিরিয়া গেল। ক্ষণকাল পরে গরার হইতে শান্ত্রী হাঁকিয়া কহিল, “ছিপ চালাও, কিন্তু খবরদার ফিরিঙ্গিদের একখানি কোশা এই পথে গিয়াছে।” নৌকার উপরে দাঁড়াইয়া গোকুলবিহারী কহিলেন, “তাহার জন্য চিন্তা নাই।” ছিপ বহর পার হইয়া নবদ্বীপাভিমুখে চলিল।
০৫. আশিক ও মাসুক
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
আশিক ও মাসুক
মুক্তবেণীতে সরস্বতী ও গঙ্গাসঙ্গমের নিকটে একটি তিন্তিড়ি বৃক্ষতলে বসিয়া একটি যুবক একমনে গঙ্গ-প্রবাহে অসংখ্য নৌবাহিনীর সম্মিলন দেখিতেছিল। সরস্বতী তখন প্রায় বিগতযৌবনা, কিন্তু তথাপি বর্ত্তমান সময়ের ন্যায় কঙ্কালাবশিষ্টা হয় নাই। তখনও চারি পাঁচ হাজার মনের নৌকা স্বচ্ছন্দে হিজলি হইতে সপ্তগ্রামে আসিত এবং বৎসরের বারমাস নদীতে নৌকা চলিত। সরস্বতীর মোহানায় ক্ষুদ্র বৃহৎ অনেকগুলি নৌকা ভাঁটার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল, তাহার মধ্যে দুই একখানি বজ্রাও ছিল। একখানি বজরার কামরার সম্মুখে দুইটি মুসলমান রমণী বসিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে একজন যুবতী ও রূপসী, অপর প্রৌঢ়া ও কুরূপা। তাহাদিগের পোষাক পরিচ্ছদ দেখিলে বোধ হয় যে তাহারা সম্ভ্রান্তবংশীয়া, অথচ তাহারা নর্ত্তকী; কারণ কোন মুসলমান কূলবধূ দিবসে জনসমাজে বাহির হয় না। রূপসী কুরূপাকে কহিল, “ফতেমা, ঐ তিন্তিড়ি বৃক্ষতলে যে কাফের যুবক বসিয়া আছে, যদি তাহাকে পাই তবে বিবাহ করি।” প্রৌঢ়া বিরক্ত হইয়া কহিল, “তোমার বয়স হইয়াছে তথাপি গাম্ভীর্য্য আসিল না। কি দুঃখে কাফেরকে বিবাহ করিতে যাইবে? কোন মুসলমানের ঘরে কি উপযুক্ত পাত্র নাই?” “হয়ত আছে। আমার মনে ধরিলে ত?” “এত যায়গায় ঘুরিয়া বেড়াইলে, এত লোক দেখিলে, কাহাকেও কি, বাছা, তোমার মনে ধরিল না?” “ধরিয়াছে ত।” “কাহাকে?” “ঐ কাফের যুবককে।” “সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। মনের মত পাত্র কি সুবাবাঙ্গালার মুসলমান সমাজে মিলিল না?” “না।” “ধন্য মন বটে!” “সে জিনিষটা এখন বেশ ভাল আছে, ফতেমা, তুই সেতারটা লইয়া আয়।”