নাবিক চলিয়া গেল, প্রৌঢ় নৌকায় ফিরিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ময়ূখ ও অন্যান্য নাবিকগণ নৌকায় ফিরিয়া আসিলেন। নৌকা তৎক্ষণাৎ দক্ষিণাভিমুখে যাত্রা করিল। কক্ষে বসিয়া প্রৌঢ় ময়ূখকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আর দুই দিনে সপ্তগ্রাম পৌঁছিব। আপনি সপ্তগ্রামে কোথায় যাইবেন?” “ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁর নিকটে।”
“একদিনেই কি ফৌজদারের সাক্ষাৎ পাইবেন? সপ্তগ্রামে কি আপনার কোন পরিচিত লোক আছে?” “কেহ না, তবে আমার পিতার দুই একজন বন্ধু আছেন।” “তাঁহারা কি আপনাকে জানেন?”
“আমার নাম শুনিয়াছেন, কিন্তু কখনও আমাকে চক্ষে দেখেন নাই।” “তবে আশ্রয় লইবেন কোথায়?” “যদি কেহ চিনিতেই না পারেন, তাহা হইলে অতিথিশালায় আশ্রয় লইব।” “যদি অনুগ্রহ করিয়া সপ্তগ্রামে আমার কুটীরে বাস করেন, তাহা হইলে চরিতার্থ হইব।”
“আপনি জীবনদাতা, যখন যাহা আদেশ করিবেন আমি সানন্দে তাহাই সম্পাদন করিব। আমি সপ্তগ্রামে অপরিচিত, কর্পদ্দকশূন্য ভিখারী; আপনি দয়া করিয়া দ্বিতীয়বার আমাকে আশ্রয় দিতে চাহিয়াছেন, ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য—”
সহসা গুড়ুম করিয়া তোপের আওয়াজ হইল, সঙ্গে সঙ্গে ছিপ কাঁপিয়া উঠিল, প্রৌঢ় কক্ষের দীপ নিবাইয়া ত্রস্ত পদে বাহিরে আসিলেন এবং দেখিলেন যে, দূরে কোশার ন্যায় এক খানি বৃহৎ নৌকা অন্ধকারে দাঁড়াইয়া আছে। তাঁহাকে বাহির হইতে দেখিয়া কেনারাম তাঁহার নিকটে আসিল এবং কহিল, “হুজুর, ফিরিঙ্গি হার্মাদ বোধ হয় পিছু লইয়াছে, গোলা লাগিয়া একজন মাল্লা মরিয়াছে।”
প্রৌঢ় কহিলেন,—“আমাদের তোপ প্রস্তুত আছে ত?”
“আছে, কিন্তু তাহার গোলা অতদূর পৌঁছিবে না।” “তবে শীঘ্র নৌকা ফিরাও।” মুহূর্ত্ত মধ্যে ছিপ ফিরিল এবং উত্তরাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিল। তখন প্রৌঢ় ময়ূখকে কহিলেন, “ঠাকুর, এ অত্যাচার আর সহ্য হয় না,—এইবার আমি স্বয়ং অস্ত্র ধরিব।” ময়ূখ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“আপনার উপরে কে অত্যাচার করিয়াছে?” পর্ত্তুগীজ বণিক্ অথবা দস্যু।“ “পর্ত্তুগীজ বণিক্ কি দস্যু?” “ইহারা যখন সুবিধা পায় তখন বাণিজ্য করে এবং যখন অবসর বুঝে তখন লুঠ তরাজ করে।” “ফৌজদার ইহাদিগকে শাসন করেন না কেন?” “পারেন না বলিয়া।” “সুবাদার কি এ সকল কথা জানেন না?” “ভিতরে আসুন বলিতেছি।”
০৪. অতিথি-পরিচয়
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
অতিথি-পরিচয়
“ঠাকুর, আমি ঢাকা হইতে ফিরিতেছি, বাঙ্গালার সুবাদার দরিদ্র প্রজাকে দস্যুর অত্যাচার হইতে রক্ষা করিতে অক্ষম।” “তবে বাদশাহের নিকটে আবেদন করুন।” “ঠাকুর, আমি বণিক্, ফিরিঙ্গির অত্যাচারে আমার সর্ব্বস্ব গিয়াছে। যাহা কিছু আছে দিল্লী গেলে তাহাও যাইবে।” “কেন, বাদশাহ কি তাহা কাড়িয়া লইবেন?” “না, তবে আমি বাদশাহের দরবারে পৌঁছবার পূর্ব্বে ফিরিঙ্গি বণিক্ এবং খৃষ্টান পাদরী আমার অবশিষ্ট সম্পত্তি এমন কি স্ত্রী, পুত্র, পর্য্যন্ত হরণ করিবে।”
ময়ূখ বিস্মিত হইয়া প্রৌঢ়ের মুখের দিকে চাহিয়া রছিলেন, —ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আপনি কে?” প্রৌঢ় ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “ঠাকুর, আপনি নিজ পরিচয় গোপন করিয়াছেন—কিন্তু আমি তাহা করিব না। আমি সপ্তগ্রামবাসী সুবর্ণবণিক্, বাণিজ্য আমার ব্যবসা, আমার নাম—গোকুলবিহারী সেন। সপ্তগ্রামে, গৌড়ে, সুবর্ণগ্রামে ও ঢাকায় আমার কুঠী আছে। পূর্ব্বে আমার দশখনি জাহাজ ছিল, সেগুলি একে একে বিসর্জ্জন দিয়াছি। গৌড়ে ও ঢাকায় ব্যবসা বাণিজ্য অচল এবং সপ্তগ্রামে অসম্ভব হইয়া উঠিয়াছে।” ময়ূখ কহিলেন, “মহাশয়, আমার নাম ময়ূখ, আমার পিতা উত্তর রাঢ়ে একজন প্রসিদ্ধ ভূস্বামী ছিলেন। বাদশাহের আদেশে, আমার শৈশবে, পিতৃব্য সে অধিকার পাইয়াছেন, আমি একা সম্বলহীন ভিখারী। আপনার দশখানি জাহাজ ছিল, তাহা বিসর্জ্জন দিলেন কেমন করিয়া?” “পর্ত্তুগীজ বণিক্ তাহার কতকগুলি ডুবাইয়া দিয়াছে এবং অবশিষ্টগুলি কাড়িয়া লইয়াছে।” “ইহার কি প্রতিকার নাই?” “অনেক চেষ্টা করিয়া দেখিলাম—কিন্তু কোন ফল হইল না—” “এখন কি করিবেন?” “আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিব।” “সুবাদার ফৌজদার যাহাদিগের সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারেন না, আপনি একা তাহাদিগের সহিত কি করিয়া লড়াই করিবেন?” “আমার কিঞ্চিৎ সৈন্যবল আছে এবং অন্য ফিরিঙ্গিরা আমাকে সাহায্য করবে।” “ফিরিঙ্গী কি দুই তিন রকম আছে না কি?” “ঠাকুর কি তাহা জানেন না? এখন যাহাদিগের প্রভাব অধিক তাহার পর্ত্তুগীজ; ইহাদিগের এক সন্ন্যাসী জল ও স্থলের রাজত্ব ইহাদিগকে লিখিয়া পড়িয়া দান করিয়াছেন, সেইজন্য ইহারা পৃথিবীর সর্ব্বত্র অত্যাচার করিয়া বেড়ায়। অন্যান্য ফিরিঙ্গীরা ইহাদের ন্যায় উদ্ধত নহে, তাহাদিগের মধ্যে ওলন্দাজ জাতি সর্ব্বাপেক্ষা পরাক্রান্ত। আংরেজ ও ফরাসী জাতি ক্রমে ক্রমে এদেশে বাণিজ্য বিস্তার করিতেছে, তাহাদিগের মধ্যে ফরাসী জাতি শুনিয়াছি বড়ই পরাক্রান্ত; কিন্তু এদেশে পরাক্রমের লক্ষণ কিছু দেখিতে পাই নাই। অন্য ফিরিঙ্গী বণিকের সহিত কারবার করি বলিয়া পর্ত্তুগীজ বণিক্ আমার উপর অসন্তুষ্ট। ইহারই জন্য আমার জাহাজ মারা গিয়াছে, আমার সপ্তগ্রামের কুঠিতে আগুন লাগিয়াছে এবং সকল বিষয়ে আমার সর্ব্বনাশের চেষ্টা হইতেছে।”