যুবক ব্রাহ্মণবংশজাত শুনিয়া প্রৌঢ় তাহাকে প্রণাম করিয়া পদধূলি গ্রহণ করিলেন এবং কহিলেন, “ঠাকুর, আপনি ভিতরে অসুন।” নৌকায় একটি মাত্র কক্ষ ছিল, তাহার মধ্যে বহুমূল্য শয্যায় অনিন্দ্যসুন্দরকান্তি এক যুবা বসিয়া ছিল। প্রৌঢ় কক্ষে প্রবেশ করিয়া তাহাকে কহিলেন—“গোষ্ঠ, আমাদের অতিথি ব্রাহ্মণ, প্রণাম কর।” যুবা উঠিয়া অতিথিকে প্রণাম করিল। তখন প্রৌঢ় পুনরায় কহিলেন, “গোষ্ঠ, আমাদের খাস বন্দুকগুলি বাহির করিয়া আন।” যুবক কক্ষের নিম্নে নৌকাগর্ভ হইতে সাত আটটি বহুমূল্য বন্দুক বাহির করিল। প্রৌঢ় ময়ূখকে কহিলেন, “ঠাকুর, ভাল দেখিয়া একটি বন্দুক বাছিয়া লউন।” ময়ূখ একটি ক্ষুদ্র বন্দুক বাছিয়া লইলেন। গোষ্ঠ নৌকার ছাদ হইতে থলিয়া ভরা বারুদ ও গুলি বাহির করিল এবং তাহা ময়ূখের হস্তে প্রদান করিল। তখন প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, আপনি কি ক্লান্ত হইয়াছেন?” ময়ূখ কহিল “না।” “তবে বাহিরে আসুন, নিশাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইয়া থাকি।” “মাঝি মাল্লারা কি বন্দুক ধরিতে জানে?” “ঠাকুর, মাল্লারা কেহই ধীবর নহে, তাহারা শিক্ষিত সেনা, আবশ্যক মত নাবিকের কার্য্য করিয়া থাকে।” “কতজন মাল্লা আছে?” “দেড় শত, সকলের নিকটেই বন্দুক আছে।” “সেগুলি ভরিয়া রাখিলে হয় না?” “চলুন, বাহিরে যাই।”
তিন জনে কক্ষের বাহিরে অসিলেন। তখন শুক্লা নবমীর জ্যোৎস্না চারিদিকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে, অন্ধকার কূলে কূলে বিটপিরাজির আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। প্রৌঢ় কর্ণধারকে ডাকিলেন, সে একজন নাবিকের হস্তে হাল দিয়া তাঁহার নিকটে আসিল। প্রৌঢ় কহিলেন, “কেনারাম, প্রস্তুত হও, বোধ হইতেছে রাত্রিতে লড়াই করিতে হইবে।”
কেনারাম কিছুমাত্র বিস্মিত না হইয়া কহিল, “কাহার সহিত হুজুর?” “ফিরিঙ্গি হারমাদের সহিত।” “এখানেও ফিরিঙ্গি? আমরা ভাবিয়াছিলাম যে, সারা বাঙ্গলা মুলুকে একমাত্র সাতগাঁই জ্বলিয়া খাক হইয়া গেল। তবে তোপ দুইটা বাহির করি?” “কর। বারুদের অভাব হইবে না ত?” “হুজুর, যথেষ্ট বারুদ আছে। অভাব হইবে লোকের, এত বড় ছিপ লইয়া লড়াই করিতে হইলে তিন শত লোকের প্রয়োজন, দুই শত নৌকা বাহিবে, আর এক শত লড়াই করিবে।” “তোমাদের বন্দুকগুলি ভরিয়া রাখিতে বল।” “সমস্ত বন্দুক প্রস্তুত আছে, কেবল তোপ দুইটী ভরিয়া রাখিতে হইবে।” “শীঘ্র ভরিয়া লও।”
কর্ণধারের আদেশে দশ পনর জন মাল্লা নৌকাগর্ভ হইতে দুইটী তোপ তুলিয়া তাহা নৌকার উপরে সাজাইল এবং কর্ণধারের নির্দ্দেশ অনুসারে তাহা নৌকার উপরে বসাইয়া বারুদ ও গোলা ভরিয়া রাখিল। তখন সকলে মিলিয়া নৌকা বাহিতে আরম্ভ করিল, নৌকা নক্ষত্র বেগে ছুটিল।
রজনীর দ্বিতীয় যাম অতিবাহিত হইলে, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে তীব্র আলোক দৃষ্ট হইল। তাহা দেখিয়া প্রৌঢ় কর্ণধারকে জিজ্ঞাসা করিলেন,—“কিনু, কিসের আলো?” “কোনও গ্রামে আগুন লাগিয়াছে বোধ হয়।” “আলো বড়ই জোর, দুই এক খানি ঘরে আগুন লাগিলে এত আলো হইত না।” দেখিতে দেখিতে নৌকা আলোকের নিকটবর্ত্তী হইল, সকলে দেখিতে পাইলেন যে, একখানি বৃহৎ গ্রাম অগ্নিতে জ্বলিয়া উঠিয়াছে; তখন প্রৌঢ় কহিলেন, “এত বড় গ্রাম এক সঙ্গে জ্বলিয়া উঠিল কি করিয়া?” কেনারাম কহিল, “হুজুর, বোধ হয়, কেহ ইচ্ছা করিয়া আগুন লাগাইয়া দিয়াছে।” “ফিরিঙ্গি নহে ত?” “ভগবান্ জানেন, হুজুর, অনুমতি হইলে ছিপ কিনারায় লাগাই। ছায়ায় ছায়ায় চলিলে বিপদের সম্ভাবনা অল্প।” “তবে তাহাই কর।” ছিপ ফিরিল এবং ভাগীরথীর পশ্চিম কূলের নিম্নে চলিতে আরম্ভ করিল। সহসা কর্ণধার দীর্ঘাকার কোশা দেখিতে পাইয়া একটি ক্ষুদ্র খালের মধ্যে ছিপ চালাইয়া দিল। বৃক্ষতলের অন্ধকারে ছিপ বাঁধিয়া সকলে তীরে নামিল, কেবল পঁচিশ জন নাবিক পাহারায় রহিল। তীরে নামিয়া প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ঠাকুর, এ গ্রাম কি আপনার পরিচিত?” ময়ূখ কহিলেন, “না, গ্রামের ভিতরে প্রবেশ না করিয়া গঙ্গাতীরের পথে চলুন, তাহা হইলে নৌকা ও দস্যুদলের মধ্যে গিয়া পড়িব।” প্রৌঢ় কহিলেন, “উত্তম কথা; ঠাকুর, তুমি যুদ্ধ ব্যবসায় পারদর্শী দেখিতেছি। সকলে নদীকূলের উচ্চ ভূমির আশ্রয়ে ধীরে ধীরে চল।”
প্রৌঢ়, গোষ্ঠ, ময়ূখ, নাবিকগণের অগ্রে অগ্রে চলিতে লাগিলেন। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া, ময়ূখ কহিলেন, “দেখুন, নাবিকগণকে দুই ভাগে ভাগ করিয়া লই, একদল নাবিক গ্রামবাসিগণের রক্ষায় যাউক, দ্বিতীয়দল তাহাদের প্রত্যাবর্ত্তনের পথরোধ করুক।” “উত্তম কথা, কে কোন্ পথে যাইবে?” “আমি গ্রাম রক্ষায় যাইতেছি, আপনারা পিতাপুত্রে অগ্রসর হউন।”
সপ্ততি জন নাবিক ময়ূখের সহিত গ্রামের দিকে যাত্রা করিল; অবশিষ্ট নাবিকগণকে লইয়া প্রৌঢ় ও গোষ্ঠ নৌকার দিকে অগ্রসর হইলেন। ক্ষণকাল পরে গ্রামমধ্যে ক্রমাগত বন্দুকের শব্দ হইতে লাগিল; এবং মুহূর্ত্তপরে একজন নাবিক ফিরিয়া আসিয়া প্রৌঢ়কে কহিল, “আমাদের দেখিয়া দস্যুরা পলাইতেছে, তাহাদিগের নৌকা কোথায়?” প্রৌঢ় কহিলেন,— “নৌকা ত খুঁজিয়া পাই নাই, দস্যুরা কি ফিরিঙ্গি?” “হয় মগ্ না হয় ফিরিঙ্গি।”
এই সময়ে ফিরিঙ্গিদিগের কোশার মত একখানি বড় নৌকা আর একটি খালের ভিতর হইতে বাহির হইয়া গঙ্গায় পড়িল, তাহা দেখিয়া প্রৌঢ় নাবিককে কহিলেন, “বোধ হয়, ঐ দস্যুদিগের নৌকা, তুমি ঠাকুরকে গিয়া বল যে আর গ্রামে বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই, দস্যুরা নৌকায় উঠিয়া পলাইয়াছে। যত শীঘ্র সম্ভব নৌকায় ফিরিয়া আসিও।”