তর্করত্নের স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে বৃদ্ধ গোস্বামী কছিলেন, “ভাই, ললিতা আমার দুইদিন উপবাসী ছিল, ব্রত সাঙ্গ করিয়া গঙ্গাস্নান করিতে গিয়াছিল, সেই অবস্থায় দুর্ব্বৃত্ত ফিরিঙ্গী তাহাকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। আহা! মা আমার আর নাই! জগতে এমন কে আছে যে পরাক্রান্ত দস্যুর হস্ত হইতে তাহাকে উদ্ধার করিয়া আনিবে?”
পশ্চাৎ হইতে ধ্বনিত হইল, “আছে, যে প্রকৃত রাজা সে তোমার কন্যা উদ্ধার করিতে গিয়াছে।” সকলে ফিরিয়া দেখিলেন যে, দূরে পনস তরুতলে একজন দীর্ঘাকার গৈরিকবসন-পরিহিত সন্ন্যাসী দাঁড়াইয়া আছেন। সন্ন্যাসী পুনর্ব্বার কহিলেন, “গোস্বামী, গৃহে ফিরিয়া যাও, তোমার কন্যা ফিরিয়া আসিবে। আজ দেবেন্দ্রনারায়ণ নাই, কিন্তু তাহার পুত্র আছে; যে উত্তর রাঢ়ের প্রকৃত অধীশ্বর সে দস্যুর দণ্ডবিধান করিতে গিয়াছে। ফিরিয়া যাও, গৃহ-দেবতার নিকটে তাহার মঙ্গল কামনা কর।”
সন্ন্যাসী উত্তরের প্রতীক্ষা না করিয়া প্রস্থান করিলেন, গ্রামবাসিগণ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। কিয়ৎক্ষণ পরে রুধিরাপ্লুতদেহ বৃদ্ধ ভূবন ধীরে ধীরে আসিয়া তর্করত্নকে প্রণাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর, আমাদের মহারাজকে দেখিয়াছেন?” তর্করত্ন বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “না। ভুবন, তুমি আঘাত পাইলে কোথায়?” “ফিরিঙ্গীর সহিত যুদ্ধে।” “কখন?” “দুই দণ্ড পূর্ব্বে, ঠাকুরের কন্যাকে উদ্ধার করিতে গিয়া।” “মহারাজ কোথায়?” “তিনিও আহত হইয়াছেন। ধনু ও তীর লইয়া যতক্ষণ বন্দুকের সহিত যুদ্ধ সম্ভব ততক্ষণ দুই জনে যুঝিয়া ছিলাম। তিনি অজ্ঞান হইয়া নৌকায় পড়িয়া গেলে, আমি নৌকা ভাসাইয়া দিয়া জলে পড়িয়াছিলাম আর নৌকার কাছি ধরিয়া সাঁতার দিয়া পলাইলাম। রাঙ্গামাটির নিকট নৌকা তীরে লাগাইলাম। মহারাজের জ্ঞান হইলে তাঁহাকে গঙ্গাতীরে বসাইয়া রাখিয়া গ্রামে লোক ডাকিতে গিয়াছিলাম, ফিরিয়া আসিয়া দেখি নৌকাও নাই মানুষও নাই। নদীর তীরে তীরে তাঁহার সন্ধান করিতে করিতে আসিয়াছি; কিন্তু কোথাও তাঁহার চিহ্ন পাই নাই।”
কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া তর্করত্ন কহিলেন—“ভুবন, মহারাজকে আমরা দেখি নাই। তিনি বোধ হয় তোমার নৌকা লইয়া হার্ম্মাদের নৌকার অনুসরণ করিয়াছেন। তুমি তোমার বড় নৌকা প্রস্তুত কর; দেবেন্দ্রনারায়ণের অন্নের ঋণ যে যে এখনও স্বীকার করে তাহাদিগকে প্রস্তুত হইতে বল। মহারাজ একাকী গিয়াছেন, কি হইবে বলিতে পারা যায় না। হয় ত আজি দেবেন্দ্রনারায়ণের বংশ লোপ হইবে। তুমি বিলম্ব করিও না। দুই দণ্ডের মধ্যে তোমার নৌকায় আমি সপ্তগ্রাম যাত্রা করিব। আমি রাজবাটীতে চলিলাম।”
তর্করত্ন দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন, ভুবনও অন্য দিকে চলিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকিয়া গোস্বামীও গৃহে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। তখন মাধব খুড়া কহিলেন—“কি হে কালিদাস, কি রকম বুঝিতেছ?” “গোস্বামীকে সমাজচ্যুত করা অসম্ভব।” “তর্করত্ন যখন বিরূপ তখন আর উপায় কি?” “তর্করত্নটী যেন ফৌজদারের সিপাহী—হরিনাথ কোথায়?” “গোস্বামীকে দেখিয়াই পলায়ন করিয়াছে।” “সন্ধ্যা হইল, চল ঘরে যাই।”
০৩. আশ্রয় লাভ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আশ্রয় লাভ
খৃষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পাদের শেষ বৎসরে, ভাদ্র মাসে, প্রশস্ত গঙ্গাবক্ষে একখানি দীর্ঘাকার নাতিপ্রশস্ত নৌকা দ্রুতবেগে দক্ষিণাভিমুখে যাইতেছিল। সন্ধ্যা আগতপ্রায়; ভাগীরথীর উভয় কূল ধূসরবর্ণ ছায়ায় আবৃত হইয়া আসিতেছে; প্রথম সন্ধ্যায় আলো অাঁধারে নৌকার নাবিকগণ সম্মুখে একখানি ক্ষুদ্র নৌকা দেখিতে পাইয়া তাহা দূরে লইয়া যাইতে কহিল; কিন্তু ক্ষুদ্র নৌকার আরোহী বা নাবিক শুনিতে পাইল না, অথবা গ্রাহ্য করিল না। দেখিতে দেখিতে দ্রুতগামী নৌকাখানি ক্ষুদ্র নৌকার পার্শ্বে আসিয়া পড়িল। নাবিকগণ দেখিতে পাইল যে, ক্ষুদ্র নৌকা কর্ণধারবিহীন, স্রোতের মুখে ভাসিয়া যাইতেছে, নৌকার গর্ভে একটি মনুষ্য দেহ-পড়িয়া রহিয়াছে। সহসা বৃহদাকার নৌকার গতি পরিবর্ত্তিত হইল, তাহা ফিরিয়া আসিয়া ক্ষুদ্র নৌকার পার্শ্বে আসিয়া লাগিল, দুই তিন জন নাবিক ক্ষুদ্র নৌকায় উঠিয়া আরোহীর দেহ পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে, সে তখনও জীবিত আছে, কিন্তু রক্তস্রাবে অত্যন্ত ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে। নাবিকগণ তাহাকে নিজ নৌকায় উঠাইয়া ক্ষুদ্র, নৌকা ভাসাইয়া দিল। বৃহৎ নৌকা পুনরায় দক্ষিণাভিমুখে চলিতে আরম্ভ করিল। নৌকারোহিগণের শুশ্রূষায় আহত ব্যক্তির চেতনা ফিরিলে, নাবিকগণ তাহার থরিচয় জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু সে পরিচয় না দিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তোমরা কোথায় যাইবে?” নাবিকগণ কহিল,—“আমরা সপ্তগ্রামে যাইব।” “পথে আর কোন নৌকা দেখিয়াছ?” “না।” “তুমি আহত হইলে কিরূপে?” “ফিরিঙ্গীর সহিত যুদ্ধে।” “ফিরিঙ্গীর সহিত যুদ্ধে? কেমন করিয়া বিবাদ বাধিল? কোথায় যুদ্ধ হইল?” “মকসুসাবাদের নিকটে গৌরীপুরে।” “ফিরিঙ্গী কি তোমার নৌকা মারিয়াছিল?” “না, আমার এক আত্মীয়াকে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।”
এই কথা শুনিয়া একজন নাবিক নৌকার কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল এবং ক্ষণকাল পরে জনৈক প্রৌঢ় ব্যক্তির সহিত ফিরিয়া আসিল। প্রৌঢ় যুবকের কাহিনী শুনিয়া তাহাকে পরিচয় দিতে অনুরোধ করিল, কিন্তু যুবক কিছুতেই পরিচয় দিল না। তখন প্রৌঢ় কহিল, “যুবক, তুমি বীর, অস্ত্র ধরিতে জান, বন্দুক ধরিতে শিখিয়াছ কি?” “এমন কোন অস্ত্র নাই যাহা ধরিতে শিখি নাই।” “তুমি কি জাতি?” “আমি ব্রাহ্মণ। অন্য কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবেন না; আপনি জীবনদাতা, আপনার আদেশ অমান্য করিতে হইলে সংকোচ বোধ হয়।”