নিকটে অন্য এক কক্ষে ময়ূখ, ভুবন ও দুইজন খোজা বসিয়াছিল। বাদশাহ্ কক্ষে প্রবেশ করিয়া ময়ূখকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “মন্সবদার, তুমি এখানে?”
শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি ময়ূখকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল; তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া অভিবাদন করিলেন এবং কহিলেন, “শাহান্শাহ, তক্দির।”
তখন বাদশাহ্ বেগমকে কহিলেন, “আলিয়া, এ আমার নূতন মনসবদার, ইহার পিতার ন্যায় বিশ্বাসী ভৃত্য জহাঙ্গীর বাদশাহের বোধ হয় আর ছিল না।
এত মুসলমান নহে, বাঙ্গালী। কে তোমাকে রঙ্গমহলে আনিয়াছে?”
ময়ূখ যাহা জানিতেন তাহা বলিলেন। তখন হিম্মৎ খাঁ ও মেহেদী বিবির তলব পড়িল। তাহারা বলিল যে, গুলজার বাঁদী এই কাফেরকে লইয়া আসিয়াছিল, জহানারা বেগম বলিয়াছিলেন যে ইহা হজরৎ বাদশাহ্ বেগমের হুকুম। তখন বাদশাহ্ গুলরুখ্কে তলব করিলেন।
স্থির শান্ত তুষারশীতল ধবল মর্ম্মরমূর্ত্তির ন্যায় গুলরুখ্ ধীরে ধীরে কক্ষে প্রবেশ করিলেন। রক্তবর্ণপাষাণনির্ম্মিত কক্ষ যেন উষার উজ্জ্বল কান্তিতে শুভ্র হইয়া উঠিল। তরুণী রমণীর রূপ জগদ্বিজয়ী, শাহ্জহানের কঠোর সঙ্কল্প সহসা কোমল হইয়া গেল, হৃদয় দ্রবীভূত হইল, বাদশাহ্ উদ্দেশ্য বিস্মৃত হইয়া সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গুলরুখ্, এ কে মা?”
সুন্দর ওষ্ঠযুগল ঈষৎ কম্পিত হইল, গুলরুখ্ বলিল, “শাহনশাহ্, ইনি আমার দেবতা।”
“তুমি ইঁহাকে মহলসরায় আনিয়াছিলে?”
“আনিয়াছিলাম।”
“স্বেচ্ছায় আনিয়াছিলে মা?”
“শাহানশাহ্ পিতা কেমন তাহা দেখি নাই, আপনার নিকটে ও নবাব সাহেবের নিকটে জীবনে প্রথম পিতৃস্নেহ পাইয়াছি। মিথ্যা বলিব না, অনেক মিথ্যা কহিয়াছি, আরাধ্য দেবতাকে বহু যন্ত্রণা দিয়াছি। মোহের বশে কুপরামর্শে শয়তান ও শয়তানীর সাহায্যে, ইঁহাকে মাতার বাসস্থানে আনিয়াছিলাম।”
“কাহার পরামর্শে আনিয়াছিলে গুলরুখ্?”
“এই চক্ষুর, পিতা, এই চক্ষুই আমার কাল। কেহ অপরাধী নহে। গুল্জার, ইরাদৎ, হিম্মৎ, হিলাল, মেহেদী বা শাহ্জাদী কেহ অপরাধী নহে। অপরাধ আমার চক্ষুর। সুদূর সপ্তগ্রামে ঐ দেবদুর্ল্লভ রূপ আমার নয়ন অন্ধ করিয়া দিয়াছিল, সেই অন্ধতার বশবর্ত্তী হইয়া বহু অপরাধ করিয়াছি। শাহান্শাহ, আজি আপনার সাক্ষাতে দোষীর দগুবিধান করিব।”
গুলরুখ্ ক্ষিপ্র হস্তে বস্ত্রমধ্য হইতে দুইটি তীক্ষ্ণধার লৌহ শলাকা বাহির করিয়া নয়নদ্বয়ে বিদ্ধ করিল, মুহূর্ত্ত মধ্যে নীলেন্দীবরতুল্য উজ্জ্বল নয়নদ্বয় হীনপ্রভ হইয় গেল। তখন যুবতীর পাণ্ডুবর্ণ মুখমণ্ডলে ম্লান হাস্যের ক্ষীণ রেখা ফুটিয়া উঠিল, গুলরুখ্ বলিল, “আর দেখিব না, কিন্তু, প্রভু, অন্ধের নয়নপথে তোমার শান্ত স্নিগ্ধ সুন্দর মূর্ত্তি সতত বিরাজ কৱিবে।“
দৃষ্টিশক্তিহীনা রমণী আরজ্ মন্দ বাণু বেগমের দিকে হস্তদ্বয় প্রসারিত করিল এবং কহিল, “মা, তুমি কোথায় মা?”
বেগম গুলরুখের রক্তাপ্লুত দেহ আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ করিয়া রোদন করিয়া উঠিলেন। বাদশাহ্ স্তম্ভিত হইয় দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি ফিরিয়া দেখিলেন যে ময়ূখের গণ্ডস্থলে স্রোতের ন্যায় অশ্রুধারা বহিতেছে।
সেই মুহূর্ত্তে আগ্রার এক দরিদ্র পল্লীর প্রান্তভাগে জনৈক দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ সন্ন্যাসী দ্রুতবেগে পথ চলিতেছিল। সেই পল্লীর এক ক্ষুদ্র গৃহের বহির্দ্দেশে এক গতযৌবনা রমণী কাহার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়াছিল। সন্ন্যাসী তাহাকে দেখিয়া চমকিত হইয়া দাঁড়াইল। রমণীও সন্ন্যাসীকে দেখিল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ, কম্পিত হইল। সন্ন্যাসী দূর হইতে ডাকিল, “বিনোদিনী!”
কণ্ঠস্বর শুনিয়া রমণী মূর্চ্ছিতা হইল। তখন সন্ন্যাসী ঊর্দ্ধশ্বাসে সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল।
সেই দিন অপরাহ্নে সেইরূপ একজন গৌরবর্ণ দীর্ঘাকার প্রৌঢ় গুম্ফশ্মশ্রু জুটাজুট মণ্ডন করিয়া কাশেমখাঁর আহদী সেনাদলে প্রবেশ করিল।
২৪. পর্ত্তুগীজশক্তির সমাধি
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
পর্ত্তুগীজশক্তির সমাধি
মুক্তিলাভ করিয়া ময়ূখ কাশেমখাঁর সহিত বাঙ্গালায় ফিরিয়া আসিলেন। বাঙ্গালার সুবাদারী গ্রহণ করিয়া কাশেম ইয়ার খাঁ হুগলীর পর্ত্তুগীজগণের বিনাশের উদ্যোগ আরম্ভ করিলেন। সুবাদারের পুত্র এনায়েৎউল্লা, সেনাপতি আল্লা ইয়ার খাঁর সহিত হিজ্লী আক্রমণ করিবার ছলে সসৈন্য বর্দ্ধমানে পৌঁছিলেন। হুগলী আক্রমণের উদ্দেশ্য জানিতে পারিলে পাছে হুগলীর পর্ত্তুগীজগণ জলপথে পলায়ন করে, সেই জন্য মখ্সুসাবাদে বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও নাওয়ারার সমস্ত কোশা ও গরাবের সহিত খাজা শের শ্রীপুর হইতে সুন্দরবনে প্রেরিত হইলেন। স্থির হইল যে, নাওয়ারা পর্ত্তুগীজগণের জাহাজ যাইবার পথ রুদ্ধ করিলে, আল্লা ইয়ার খাঁ বর্দ্ধমান হইতে এবং বহাদর খাঁ কাম্বোহ মখ্সুসাবাদ হইতে হুগলীর দিকে অগ্রসর হইবেন।
এই সময়ে ফিরিঙ্গিগণ একদিন সপ্তগ্রামে গোকুলবিহারী শেঠের গৃহ আক্রমণ করিল। প্রতিশোধ লইবার জন্য গোকুলবিহারী ও সপ্তগ্রামের ফৌজদার হুগলী আক্রমণ করিলেন। যে দিন হুগলীর দুর্গ আক্রান্ত হইল, তাহার পরদিন রাঢ় হইতে ময়ুখ এবং বাগ্ড়ী হইতে বহাদর খাঁ গোকুলবিহারীর সহিত মিলিত হইলেন। এই সময়ে খাজা শের কোশা ও গরাব দিয়া সুন্দরবনের জলপুথ রুদ্ধ করিয়া হুগলীর দিকে অগ্রসর হইলেন। তখন বর্দ্ধমান হইতে এনায়েৎ উল্লা খাঁ ও আল্লা ইয়ার খাঁ হুগলী অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ১৯৪০ হিজরায় অর্থাৎ ১৬৩৯ খৃষ্টাব্দে হুগলীর পর্ত্তুগীজ দুর্গ চারিদিক্ হইতে আক্রান্ত হইল। পর্ত্তুগীজ পাদ্রী ও ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদের অত্যাচারে প্রপীড়িত দক্ষিণ বঙ্গের অধিবাসিগণ দলে দলে বাদশাহী ফৌজে প্রবেশ করিল। বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও খাজা শের নৌকা সংগ্রহ করিয়া হুগলীর নিম্নে একটি নৌসেতু নির্ম্মাণ করিলেন, ইহার ফলে হুগলী বন্দরের সমস্ত গরাব কোশা ও জালিয়া ডিঙ্গা বাদশাহী নাওয়ার কর্ত্তৃক ধৃত হইল। এইবার স্থলপথে পদাতিক ও জলপথে নৌসেনা হুগলী বন্দর ও দুর্গ আক্রমণ করিল, দুর্গের বহির্দ্দেশে অবস্থিত নগর ও বন্দর আল্লা ইয়ার খাঁর দখলে আসিল।