সন্ন্যাসী কহিলেন, “জহাঁপনা, আর একটি নিবেদন আছে।”
বাদশাহ্ বলিলেন, “অনুমতি করুন।”
“হুগলীতে যত পর্ত্তুগীজ রমণী বন্দী হইবে তাহাদিগকে রক্ষা করিবার ভার যেন আমার উপর ন্যস্ত হয়।”
“আপনি যাহা ইচ্ছা করিবেন তাহাই হইবে।”
খাসদবীর আসিলেন, ফরমাণ লিখিত হইল, বাদশাহ্ তাহাতে মোহর অঙ্কিত করিলেন। সন্ন্যাসী ফরমাণ পাইয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। আসফ্ খাঁর আদেশে শায়েস্তা খাঁর চর তাঁহার পশ্চাৎ অনুসরণ করিতে গিয়া নগরমধ্যে সন্ন্যাসীকে আর খুঁজিয়া পাইল না।”
সন্ন্যাসী প্রস্থান করিলে, আসফ্ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “জহাঁপনা, এই কাফের ফকীর কে?”
বাদশাহ্ ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “সাহেব, ইনি কে তাহা বলিতে পারি না। হুগলীতে ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদ যখন আমার যথাসর্ব্বস্ব লুঠিয়া লইয়াছিল, তখন এই মহাত্মা আপনার কন্যার ইজ্জৎ রক্ষা করিয়াছিলেন এবং আমার প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। অন্য পরিচয় অনাবশ্যক। কাশেম খাঁ, আপনি বাঙ্গালার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন, এক বৎসরের মধ্যে সুবা বাঙ্গালা হইতে পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গি দূর করিতে হইবে।”
কাশেম খাঁ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন বাদশাহ, বিকলাঙ্গ বৈষ্ণবের নিকট আসিয়া, তাহার অঙ্গে হস্তাপর্ণ করিয়া কহিলেন, “ফকীর, আমার রাজ্যে বাস করিয়া তুমি অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছ, তুমি কি চাহ?”
চৈতন্যদাস নয়ন মুদিয়া ছিল, সে নয়ন মেলিয়া কহিল, “মহারাজ, গোবিন্দের মন্দিরপ্রান্তে বাস করিতে চাহি।”
“আর কিছু চাহ না ফকীর?”
“আর কি চাহিব?”
তখন বাদশাহ্ অনামিকা হইতে বহুমূল্য হীরক অঙ্গুরীয়ক খুলিয়া চৈতন্যদাসের হস্তে দিয়া কহিলেন, “ফকীর, এই চিহ্নটি রাখিও, যদি কখন কোন প্রয়োজন হয়, তখন এই চিহ্ন দেখাইও। আমি যখন যে স্থানে থাকিব তোমাকে বাদশাহী কর্ম্মচারিগণ সেই স্থানে লইয়া আসিবে।”
বাদশাহ্ নাল্কীতে আরোহণ করিয়া মহল্সরায় প্রবেশ করিলেন।
২৩. দিব্যদৃষ্টি
ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
দিব্যদৃষ্টি
বাদশাহের নাল্কী যখন মহলে প্রবেশ করিল, তখন হজরৎ মমতাজ-ই-মহল আরজ মন্দ বাণু বেগম রৌশন জহানী আঙ্গুরীবাগের চত্বরে দাঁড়াইয়া লাল মাছকে আহার দিতেছিলেন। বাদশাহ্ নাল্কী হইতে অবতরণ করিলেন এবং বেগমের হস্ত ধারণ করিয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিলেন। রঙ্গমহলের সম্মুখে বাঁদীর সর্দারণী মেহেদী বিবি ও খোজা হিম্মৎ খাঁ য়াকুৎ নিতান্ত অপরাধীর ন্যায় দাঁড়াইয়াছিল। বাদশাহ তাহাদিগের অবস্থা দেখিয়া বেগমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আলিয়া, ইহাদিগের কি হইয়াছে?”
বেগম বাদশাহের হস্তধারণ করিয়া যমুনাতীরস্থিত একটি কক্ষে লইয়া গেলেন এবং কহিলেন, “জহান্পনা, আমার আমলে মহলসরায় যাহা হয় নাই তাহাই হইয়াছে।”
“কি হইয়াছে?”
“আপনি সুস্থ হউন, তাহার পরে বলিব।”
“আমি বেশ সুস্থ আছি, তুমি বল।”
“বড় ভীষণ কথা, মহলসরায় দুই জন পুরুষ ধরা পড়িয়াছে।”
“পুরুষ? কি জাতি?” “বাঙ্গালী।” “বাঙ্গালী?”
“হাঁ, জহান্পনা, একজন সুন্দর বলিষ্ঠ যুবক, আর একজন বৃদ্ধ; কিন্তু তাহার দেহে জীনের মত অসীম বল।”
“কোথায় ধরা পড়িল?”
“শিশ্মহলের নীচে ফাঁসীখানায়।”
“কে ধরিল?” “আমি।” “তুমি?”
“হাঁ, জহান্পনা, সন্ধ্যার সময়ে য়াকুৎ বাঁদী গুলজার আমাকে বলিল যে গুলরুখ্ রঙ্গমহলে এজন পুরুষ আনিয়াছে। আমি অন্ধকারে তাহার সন্ধান না পাইয়া গুলজারের কথা মিথ্যা মনে করিয়াছিলাম। আপনি আজ যখন দরবার আমে তখন গুল্জার আসিয়া বলিল যে ফাঁসীখানায় জহানারা ও গুলরুখ্ একজন পুরুষকে কতল করিতেছে। আমি ফাঁসীখানার উত্তরের দেওয়াল সরাইয়া দেখিলাম যে সত্য সত্যই জল্লাদ হিলাল্ খাঁ একজন মরদকে কতল করিতেছে। জহানারা বলে তাহার নাম সরওয়ার্ খাঁ, সে গুলরুখের স্বামী, কিন্তু সে এক কাফের্ণীর জন্য গুলরুখকে পরিত্যাগ করিয়া কাফের হইয়াছে। সে বলে যে তাহার নাম ময়ূখ, সে হিন্দু এবং গুলরুখ্ তাহার কেহ নহে। কি করিব স্থির করিতে পারিতেছি না।”
সহসা নবাব দেখিলেন আলিয়া বেগমের আকর্ণবিশ্রান্ত নীলনয়নদ্বয় জলে ভরিয়া উঠিল, তিনি বাদশাহের উভয় হস্তধারণ করিয়া বলিলেন, “জনাব, আমার একটি অনুরোধ রাখিবে?”
শাহ্জহান সাদরে নয়নাশ্রু মুছাইয়া কহিলেন, “আলিয়া, হিন্দুস্থানের এক সীমা হইতে অপর সীমা পর্য্যন্ত তোমার আদেশ প্রতিপালিত হয়, তুমি যখন যাহা আদেশ কর আমি তাহাই করিয়া থাকি, এখনও করিব। তবে তোমার চোখে জল আসিল কেন?”
“দিলের, তাহার মুখখানি দারার মতন, তাহাকে প্রাণে মারিও না। যদি সে অপরাধী হয়, তাহা হইলে তাহাকে মোগল বাদশাহী এলাকা ছাড়াইয়া নির্ব্বাসিত করিও।”
“তাহাই হইবে, সে যদি অপরাধী হয় তথাপি তোমার নয়নাশ্রুর অনুরোধে তাহাকে মুক্ত করিব।”
বেগম আনন্দে আত্মহারা হইয়া বাদশাহের হস্তচুম্বন কুরিলেন, বাদশাহ্ হাসিয়া কহিলেন, “আলিয়া, অনেক দিন পরে ‘দিলের’ বলিয়া ডাকিয়াছ, আপনি বলিলে না, জহানপনা বলিলে না?” লজ্জায় আরজ মন্দ বাণুবেগমের মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, তিনি বাদশাহের বক্ষে মুখ লুকাইয়া কহিলেন, “সকল সময়ে মনে থাকে না।”
“তবে বল কেন?”
“এখন যে তুমি বাদশাহ্ হইয়াছ, দিলের?”
“তখ্তে বসিয়া কি পর হইয়া গিয়াছি আলিয়া?” “তাহা কেন? চল তাহাদিগকে দেখিবে।”