বাদশাহের আদেশ অনুসারে তর্করত্ন চৈতন্যদাসের প্রতি পাদ্রীর অত্যাচারের কথা বলিলেন, তাহা শুনিয়া বাদশাহ, শিহরিয়া উঠিলেন এবং ওয়াইল্ডকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আংরেজ, সমস্ত খৃষ্টান পাদ্রী কি এইরূপ অত্যাচার করিয়া থাকে?” ওয়াইল্ড অবনত বদনে কহিলেন, “জহাঁপনা, খৃষ্টান সমাজে কেবল পর্ত্তুগীজ ও স্পেনীয় পাদ্রীই এইরূপ অত্যাচার করিয়া থাকে। ভারতবর্ষে এইরূপ অত্যাচার নূতন, ইহারা স্বদেশে অন্য মতালম্বী খৃষ্টানদিগের উপরেও এইরূপ অত্যাচার করিয়া থাকে।”
“তাহা হইলে আমার রাজ্যে ইহাদিগকে বাস করিতে দেওয়া উচিত নহে।”
ওয়াইল্ড। শাহনশাহের দরবারে বহুবার আমাদিগের প্রতি পর্ত্তুগীজদিগের অত্যাচারের কথা নিবেদন করিয়াছি। জহাঁপনার হুকুম পাইলে আমরা এত দিন পর্ত্তুগীজ পাদ্রী ও দস্যুর অত্যাচার নিবারণ করিতে পারিতাম।
বাদশাহ্। দেখ আংরেজ, তুমিও ফিরিঙ্গি পর্ত্তুগীজও ফিরিঙ্গি। তোমরা উভয়েই বাণিজ্য করিতে এ দেশে আসিয়াছ। আমরা মনে করিতাম যে ঈর্ষাবশতঃ তোমরা পর্ত্তুগীজ বণিকদিগকে অপবাদ দিয়া থাক। আমার প্রজার উপরে অত্যাচারের কথা আমি ইহার পূর্ব্বে শুনি নাই।
ওয়াইল্ড। জহাঁপনা হিন্দুস্থানের সকল সংবাদ কি বা শাহের কর্ণগোচর হয়?
আসফ্ খাঁ। জহাঁপনা, ওয়াচীয়ানবীশগণ যে সমস্ত সংবাদ প্রেরণ করে তাহা শুনিতে গেলে বাদশাহের অন্য কার্য্যের সময় থাকিবে না বলিয়া খাসদবীর বাছিয়া বাছিয়া কতকগুলি পত্র রঙ্গ মহলে পাঠাইয়া দেয়।
বাদশাহ্। সাহেব, ইহার পূর্ব্বে কি পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গির অত্যাচারের কথা কোন ওয়াচীয়ানবীশ লিখিয়া পাঠাইয়াছিল?
আসিফ্। হাঁ, আহমদাবাদ, সাতগাঁও, ও জহাঙ্গীর নগরের ওয়াচীয়ানবীশ দুই তিন বার এই সংবাদ দিয়াছিল।
বাদশাহ্। ইহার পরে সুবা বাঙ্গালা ও সুবা গুজরাতের সমস্ত ওয়াচীয়ানবীশের সমস্ত পত্র যেন আমার নিকট উপস্থিত করা হয়।
আসফ্। জহাঁপনার হুকুম তামীল হইবে।
বাদশাহ্। শুন ওয়াইল্ড, কাশেম খা বাঙ্গালার সুবাদার হইয়া যাইতেছে। আমি বাঙ্গালা ও গুজরাতে পর্ত্তুগীজদিগকে শাসন করিব। তোমাদিগের সহিত পর্ত্তুগীজদিগের বিবাদ আছে?
ওয়াইল্ড। শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ চলিতেছে।
বাদশাহ্। তোমাদের জাহাজ পর্ত্তুগীজ সমস্ত জাহাজ ইরাণে এবং সুরট অঞ্চলে আটকাইয়া রাখিতে পারিবে?
ওয়াইল্ড। পারিবে।
এই সময়ে শায়েস্তা খাঁ গোসলখানায় প্রবেশ করিয়া কহিলেন, “জহাঁপনা, এক হিন্দু ফকীর নাকারাখানায় অপেক্ষা করিতেছে, সে বাদশাহের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে। তাহার নিকট শাহনশাহের নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়ক ও পঞ্জা আছে।” বাদশাহ্ শায়েস্তা খাঁর কথা শুনিয়া বিচলিত হইয়া উঠিলেন, তিনি শায়েস্তা খাঁকে কহিলেন, “খাঁ সাহেব, আমার নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় কেবল একজন হিন্দু ফকীরের নিকট আছে; তিনি আমার ও নবাব আলিয়া বেগমের পরম মিত্র, তুমি সত্বর তাঁহাকে লইয়া আইস।”
শায়েস্তা খাঁ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। বাদশাহ্ তখন আংরেজ প্রধান ওয়াইল্ডকে কহিলেন, “ওয়াইল্ড, তুমি সুরটে ফিরিয়া যাও। যুদ্ধের বন্দোবস্ত কর।”
ওয়াইল্ড কহিলেন, “জহাঁপনা, আমি এতদিন চলিয়া যাইতাম, কেবল উজীরের হুকুম পাই নাই বলিয়া যাই নাই।”
মোগল সাম্রাজ্যের বন্দরশ্রেষ্ঠ সুরটের আংরেজ কুঠীর প্রধান ওয়াইল্ড অভিবাদনান্তে প্রস্থান করিলেন, তখন শায়েস্তা খাঁ গৈরিকধারী এক দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ সন্ন্যাসীকে লইয়া প্রবেশ করিলেন। দূর হইতে তাঁহাকে দেখিয়া বাদশাহ, সিংহাসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহা দেখিয়া আসফ্ খাঁ এবং শাহ্নওয়াজ খাঁও উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সন্ন্যাসী গোসলখানায় প্রবেশ করিলে, বাদশাহ্ স্বয়ং অগ্রসর হইয়া তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। তাহা দেখিয়া উজীর আসফ্ খাঁ ও নবাব শাহ্ নওয়াজ খাঁ সন্ন্যাসীকে অভিবাদন করিলেন। সন্ন্যাসী বাদশাহকে অভিবাদন না করিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। এই সময়ে অন্যান্য মুসলমান সভাসদগণ সন্ন্যাসীকে অভিবাদন করিলেন, কেবল দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় তাঁহার পদধূলি লইয়া প্রণাম করিলেন। একজন খোজা বাদশাহের মসনদের সম্মুখে একখানা গালিচ বিছাইয়া দিল। সন্ন্যাসী উপবেশন করিলে, বাদশাহ্ শাহ্ নওয়াজ খাঁ ও আসফ খাঁ উপবেশন করিলেন। সন্ন্যাসী কহিলেন, “জহাঁপনা, অদ্য বাদশাহের দরবারে ভিক্ষা করিতে আসিয়াছি।”
বাদশাহ্ হাসিয়া কহিলেন, “আপনাকে অদেয় আমার কিছুই নাই। আপনি হুগলীতে আমার জান ও ইজ্জৎ রক্ষা করিয়াছিলেন, সেই অবধি আমি আপনার হুকুম তামিল করিতে বাধ্য।”
“জহাঁপনা, হুগলী বন্দরের কথা মনে আছে?”
“ফকীর সাহেব, আমি জলাল্উদ্দীন আকবর বাদশাহের পৌত্র, নুরউদ্দীন জহাঙ্গীর বাদশাহের পুত্র, আমার সকল কথাই স্মরণ অাছে।”
“শীঘ্রই হুগলীতে পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গির সহিত আপনার যুদ্ধ হইবে।”
“কোন কথাই আপনার অবিদিত নাই।”
“জনাবে আলী, গঞ্জালীস্ ফিরিঙ্গিকে স্মরণ আছে?”
“আছে, সে কথা কখনও বিস্মৃত হইব না।”
“শীঘ্রই আপনার সেনা হুগলী দখল করিবে, তাহার পরে গঞ্জালীস্ যদি বন্দী হয়, তাহা হইলে তাহাকে আমার হস্তে সমর্পণ করিবেন।”
বাদশাহ্ আসফ্ খাঁর দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “সাহেব, এখনই ফরমাণ লিখিয়া আনিতে আদেশ করুন।”