সকলে গোসলখানায় প্রবেশ করিয়া দ্বারের দুই পার্শ্বে সারি দিয়া দাঁড়াইলেন, বাদশাহের নাল্কী আসিয়া দুয়ারে দাঁড়াইল, বাদশাহ্ নামিলেন। সমস্ত সভাসদ্ এক সঙ্গে কুর্ণীশ করিলেন। বাদশাহ্ গদীতে উপবেশন করিলে, উজীর আসফ্ খাঁ ও শাহ্নওয়াজ খাঁ তাহার নিকটে উপবেশন করিলেন, অপর সকলে তাহাদিগকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন। উপবেশন করিয়াই বাদশাহ আসফ্ খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব, নূতন মন্সবদার কোথায়?” আসফ্ খাঁ বিপদে পড়িলেন, মন্ত্রণা সভায় উপস্থিত সভাসদগণের মধ্যে ময়ূখের কথা প্রকাশ করিবার ইচ্ছা থাকিলেও, তাহা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। বৃদ্ধ উজির অনায়াসে একটা মিথ্যা কথা বলিলেন, তিনি কহিলেন, “জহাঁপনা, নূতন হাজারী মনসবদার ময়ূখ নারায়ণকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।” বাদশাহ্ অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “সে কি কথা সাহেব? যে ব্যক্তি কল্য রাত্রিতে আমার নিকটে আসিয়াছিল, অদ্য প্রভাতে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না? আসদ্ খাঁ! কোতোয়ালকে তলব কর।”
আসদ্ খাঁ কুর্ণীশ করিয়া গোসলখানা পরিত্যাগ করিলেন, তখন বাদশাহ্ করতালিধ্বনি করিলেন। একজন তাতারী প্রতিহারী আসিয়া অভিবাদন করিল, বাদশাহ তাহাকে রঙ্গমহলের দারোগা গুলশের খাঁ ও বখ্শী হিম্মৎ খাঁ য়াকুতকে তলব করিতে আদেশ করিলেন। তাতারী অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলে, বাদশাহ্ আসফ্ খাঁকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব, সুরটের আংরেজ সর্দ্দার ও বাঙ্গালী গওয়াহ্ হাজির আছে?” আসফ্ খাঁ কহিলেন, “জনাবে আলা, সকলেই উপস্থিত আছে।”
আসফ্ খাঁ করতালিধ্বনি করিলেন, খাওয়াস্ আমানৎ খাঁ অভিবাদন করিল, উজীর তাহাকে খাস্ চৌকীর মনসবদার শায়েস্তা খাঁকে ডাকিতে আদেশ করিলেন। মুহূর্ত্ত পরে শায়েস্তা খাঁ আসিয়া কুর্ণীশ করিলেন। অাসফ্ খাঁ পুত্রকে সুরট কুঠীর আংরেজ প্রধান ওয়াইল্ড, তর্করত্ন মহাশয় ও চৈতন্যদাস বাবাজীকে গোসলখানায় আনিতে আদেশ করিলেন। শায়েস্তা খাঁ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন, তখন আগ্রার কোতোয়াল জফর খাঁ গোসলখানায় প্রবেশ কুরিয়া কুর্ণীশ করিলেন।
জফর খাঁকে দেখিয়া বাদশাহ্ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া কহিলেন, “জফর খাঁ, তুমি খাজা আবুলহসনের পুত্র; সেই জন্য তোমাকে আগ্রার কোতয়াল করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন দেখিতেছি যে তুমি নিতান্ত অকর্ম্মণ্য। কল্য রাত্রিতে একজন বাঙ্গালী আমীর, হাজারী মনসব্দার নিযুক্ত হইয়াছে। কল্য রাত্রিতে সে প্রথম প্রহরের শেষ পর্য্যন্ত দেওয়ান-ই-খাসে উপস্থিত ছিল, কিন্তু তাহার পর সে গৃহে ফিরে নাই। তুমি কি কোন সংবাদ পাইয়াছ?” জফর খাঁ অবনত মস্তকে কহিলেন, “না।”
“অদ্য রজনীতে দেওয়ান-ই-খাসে তাহার সংবাদ আনিতে না পারিলে তোমাকে আগ্রা হইতে দূর করিয়া দিব। গর্দ্দভের পৃষ্ঠে চড়াইয়া আউরতের পোষাক পরাইয়া বাহির করিয়া দিব।”
জফর খাঁ কেতিয়াল কাঁপিয়া উঠিলেন এবং অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন আসফ্ খাঁ বাদশাহের কর্ণমূলে কহিলেন, “জহাঁপনা, জফর খাঁর অপরাধ নাই। বখ্শী হিম্মৎ খাঁ য়াকুৎ, দারোগা গুল্সের্ খাঁ ও সরদারণী মেহেদি বিবি নূতন হাজারী মনসব্দারের খবর দিতে পারিবে।” বাদশাহ্ বিস্মিত হইয়া আসফ্ খাঁর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
এই সময়ে শায়েস্তা খাঁ, ওয়াইল্ড ও তর্করত্ন মহাশয়ের সহিত গোসল্খানায় প্রবেশ করিলেন। তাঁহাদিগের পশ্চাতে দুইজন খোজা চৈতন্যদাস বাবাজীকে ধরিয়া লইয়া আসিল। চৈতন্যদাস দাঁড়াইতে না পারিয়া বসিয়া পড়িল। বাদশাহ্ বিস্মিত হইয়া তাহার দিকে চাহিলেন, তাহা দেখিয়া শাহ্নওয়াজ খাঁ কহিলেন,“জনাব্ আলি, পর্ত্তুগীজ পাদ্রী ইহার দেহের সমস্ত অস্থি চূর্ণ করিয়া দিয়াছে, ইহার দাঁড়াইবার শক্তি নাই।” বাদশাহ্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “নবাব সাহেব, পর্তুগীজ পাদ্রী ইহার অস্থি চূর্ণ করিল কেন?”
“শাহনশাহ্, তাহা ঐ হিন্দু ফকীরের মুখ হইতেই শুনিবেন।”
আসফ্ খাঁর আদেশে দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় বাদশাহের প্রশ্ন ও চৈতন্যদাসের উত্তর তর্জ্জমা করিতে লাগিলেন। বাদশাহ্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফকীর, পর্ত্তুগীজ পাদ্রী তোমার উপর অত্যাচার করিয়াছিল কেন?”
“সে আমার বন্ধু সেই জন্য।”
“সে তোমার বন্ধু?” “মহারাজ, যে পথভ্রান্তকে পথ নির্দ্দেশ করে সেই বন্ধু।”
“তুমি কি পথ ভুলিয়া হুগলী গিয়াছিলে?”
“না, ইচ্ছা করিয়াই গিয়াছিলাম।”
“তবে পথ ভুলিয়াছিলে কোথায়?”
“বৈরাগী হইয়া যখন অর্থের লোভ হইয়াছিল তখনই পথ ভুলিয়াছিলাম।”
“পর্ত্তুগীজ পাদ্রী তোমার উপরে অত্যাচার করিল কেন?” “গোবিন্দের আদেশে।”
“গোবিন্দ কে?”
“গোবিন্দ অখিল বিশ্বের রাজচক্রবর্ত্তী, বাদশাহের বাদশাহ, আপনার ও আমার প্রভু।”
বাদশাহ্ হাসিলেন, কহিলেন, “ফকীর, খোদা কি তোমার উপর অত্যাচার করিতে পর্ত্তুগীজ পাপীকে আদেশ করিয়াছিলেন?”
“নিশ্চয়, তাহা না হইলে মানুষের সাধ্য কি যে মানুষের অঙ্গে হস্তক্ষেপ করে?”
“ফকীর, তুমি কি পাগল?”
“মহারাজ, লোভ ও মোহ যখন আমাকে আক্রমণ করিয়াছিল, তখন পাগল হইয়াছিলাম, এখন মদনমোহন দয়া করিয়াছেন, এখন আর পাগল নই।”
এই সময়ে আসদ্ খাঁ কহিলেন, “শাহান শাহ্ এই ব্রাহ্মণ সেই স্থানে উপস্থিত ছিল, ইহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সকল কথা জানিতে পারিবেন।”