ময়ূখ কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া কহিলেন, “বিবি, আমি হিন্দু ব্রাহ্মণ, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমাকে ক্ষমা করুন।”
“দেখ তুমি আমার দেবতা, যাহার বাহির এত সুন্দর, তাহার ভিতর কখন মলিন হইতে পারে না; যাহার এত রূপ সে কখন নিগুর্ণ হইতে পারে না। আমি রমণী, মুগ্ধা, স্বেচ্ছায় নারীধর্ম্ম বিস্মৃত হইয়া তোমার চরণে আশ্রয় লইতে আসিয়াছি। মুসল্মান হিন্দু হইতে পারে, হিন্দুও মুসলমান হইতে পারে, হিন্দু ও মুসলমানের একাধিক পত্নী হইতে পারে। অন্দর মহলে আমার প্রতিপত্তি আছে, আমি বাদশাহ বেগমের অনুগ্রহের পাত্রী, শাহ্নশাহ্ বাদসা আমাকে স্নেহ করেন। তুমি যদি আমাকে চরণে আশ্রয় দাও, তাহা হইলে আমি তোমার জন্য অসাধ্য সাধন করিতে পারি। মন্সব, খিলাত, ইনাম, তালুক, মদদ্ যাহা চাহিবে তাহাই পাইবে—”
ময়ূখ তাহাকে বাধা দিয়া বলিয়া উঠিলেন, “বিবি সাহেব, আপনার বহুৎ মেহেরবাণী, কিন্তু আমি ত মুসলমান হইতে পারিব না?”
“আমি হিন্দু হইব।”
“মুসলমান কখনও হিন্দু হইতে পারে না।”
“কেন, বৈষ্ণব ত হইতে পারে?”
“আমি ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব হইলে জাতিচ্যুত হইব।”
“দেখ, আমি শাহ্জাদীকে বলিয়াছি যে তুমি সরওয়ার খাঁ, আমার স্বামী, এক কাফের রমণীর রূপে মোহিত হইয়া হিন্দু হইয়া গিয়াছ। তুমি জান যে মুসলমানের রাজ্যে হিন্দু মুসলমান হইলে ক্ষতি নাই, কিন্তু মুসলমান হিন্দু হইলে তাহার শাস্তি প্রাণদণ্ড। তুমি এখন সম্মত না হইলে শাহ্জাদী তোমাকে কতলের হুকুম দিবেন।”
“বিবি, আমি মরিতে কাতর নহি।”
“এখন সম্মত হও, পরে না হয় আমাকে ভুলিয়া যাইও “
“অসম্ভব, একবার সম্মত হইলে আবার কেমন করিয়া মিথ্যা কথা বলিব?”
“তবে আমাকে চরণে স্থান দিবে না?”
“বিবি সাহেব, মেহেরবাণী করিয়া আমাকে মাফ্ করুন, আপনি বাদশাহের পালিতা কন্যা, কত সম্ভ্রান্ত আমীর ওমরাহ্ আপনার পাণিগ্রহণের জন্য লালায়িত, আমি সামান্য ব্যক্তি, আমাকে অপরাধী করিবেন না।”
“জানি। আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু তোমাকে ত ভুলিতে পারি নাই? তোমার মুখ বিস্মৃত হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি আমার জান, আমার কলিজা। আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, তাহার জন্য আমাকে মাফ্ করিও। যদি পারি তাহা হইলে তোমাকে মুক্তি দিতেছি, কিন্তু যদি না পারি তাহা হইলে তোমার সঙ্গেই মরিব। অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছি।”
গুলরুখ ধূলা ঝাড়িয়া উঠিয়া দ্বারে করাঘাত করিলেন, একজন খোজা দ্বার মুক্ত করিল, শাহ্জাদী জিজ্ঞাসা করিলেন, “গুলরুখ্, তোমার খসম্ পোষ মানিয়াছে?”
গুলরুখ্ অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠে মিনতি করিয়া কহিলেন, “শাহজাদী, তুমি আজিকার মত উহাকে মাফ্ কর।”
“তবে পোষ মানে নাই?”
“মানিবে, সময় লাগিবে।”
“সে হইবে না, তোর খসম্ বলিয়া যে আমার হুকুম তামিল করিবে না আমি তাহা সহ্য করিব না। আমি এখনই তাহাকে কতল করিয়া কালি তোর নিকা দিব।”
শাহ্জাদী কক্ষে প্রবেশ করিয়া ময়ূখকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সরওয়ার্ খাঁ, তোমার বিবিকে লইয়া যাইবে?”
“আমার ত বিবি নহে শাহ্জাদী?”
“আবার মিথ্যা কথা?”
মিথ্যা বলি নাই।”
“জল্লাদ্!” এইবার বিংশতি খোজা ময়ূখকে বেষ্টন করিল, দ্বাদশজন তাতারী মুক্ত তরবারি হস্তে প্রাচীরের চারি দিকে দাঁড়াইল। জল্লাদ ময়ূখের হস্ত ধরিয়া আকর্ষণ করিল। তখন উপায়ান্তর না দেখিয়া ভুবন আত্মসমর্পণ করিল এবং শাহ্জাদীর পদযুগল ধারণ করিয়া কহিল, “শাহ্জাদী, উহার জন্ম অবধি উহাকে লালন পালন করিয়াছি, আমার সম্মুখে উহাকে মারিও না। দয়া করিয়া, মেহেরবাণী করিয়া আগে আমাকে কতল্ কর, পরে যাহা ইচ্ছা হয় করিও।” বৃদ্ধের কণ্ঠ রুদ্ধ হইল, কিন্তু তাহার কাতর আবেদন গ্রাহ্য হইল না।
দুইজন খোজা ময়ূখের মস্তক কাষ্ঠ খণ্ডের উপর স্থাপন করল, জল্লাদ কুঠার উঠাইল। সহসা তীব্র উজ্জ্বল সূর্য্যালোকে কক্ষ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, মুহূর্ত্তের জন্য সকলে দৃষ্টি শক্তি হারাইল। পরক্ষণেই খোজাগণ অস্ত্র ত্যাগ করিয়া ভূমি চুম্বন করিল। শাহ্জাদীর মুখ শুখাইয়া গেল, গুলরুখ্ শিহরিয়া উঠিলেন। ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে, অন্ধকারময় কক্ষের একদিকের প্রাচীর সরিয়া গিয়াছে, সেই স্থানে প্রশান্তমূর্ত্তি অপরূপ সুন্দরী একজন রমণী দাঁড়াইয়া আছেন। সহসা তাহার মনে আশার সঞ্চার হইল। খোজা তাহাকে পরিত্যাগ করিয়াছিল, ময়ূখ একলম্ফে সেই মাতৃমূর্ত্তির সমীপবর্ত্তী হইলেন এবং তাঁহার পদযুগল ধারণ করিয়া কহিলেন, “মা!”
মাতৃমূর্ত্তি তাঁহার মস্তকে হস্তাপর্ণ করিয়া কহিল, “বেটা, ডর্ নেহি।”
২২. গোসলখানা
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
গোসল্খানা
দরবার আম শেষ হইল, বাদশাহ্ সিংহাসন হইতে উঠিলেন। দেওয়ান-ই-আমের পশ্চাদ্ভাগে দ্বিরদরদনির্ম্মিত সুবর্ণমণিমুক্তাখচিত বিচিত্র নাল্কী লইয়া আটজন তাতারী অপেক্ষা করিতেছিল, বাদশাহ্ তাহাতে আরোহণ করিয়া প্রস্থান করিলেন। অন্যান্য সভাসদ্গণ নাকারাখানার ফটক দিয়া প্রস্থান করিলেন, কেবল উজীর আসফ্ খাঁ, শাহ্নওয়াজ খাঁ, আসদ্ খাঁ, কাসেম খাঁ, ইনায়েৎ উল্লা খাঁ, বহাদর খাঁ কাম্বোহ ও দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায়, দেওয়ান-ই-আমের পশ্চাৎস্থিত দ্বার দিয়া দেওয়ান-ই-খাসের চত্বরে প্রবেশ করিলেন। শ্বেতমর্ম্মরনির্ম্মিত দেওয়ান-ই-খাসের পশ্চাতে গোসলখানা। গোসল্খানা মোগল সাম্রাজ্যের মন্ত্রগৃহ, দরবার আমের পরে বাদশাহ্ এইখানে বসিয়া প্রধান অমাত্যগণের সহিত পরামর্শ করিতেন, ভিন্ন ভিন্ন সুবার শাসন সম্বন্ধে আদেশ দিতেন এবং রাজ্যতন্ত্রের গোপনীয় কার্য্যের ব্যবস্থা করিতেন।