শাহ্জাদী জিজ্ঞাসা করিলেন, “সর্ওয়ার খাঁ, দেখিতেছ?” ময়ূখ দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠে উপবীত জড়াইয়া চক্ষু মুদ্রিত করিলেন। শাহ্জাদী কহিলেন, “দেখ এখনও যদি ধর্ম্মপত্নীকে গ্রহণ কর, তাহা হইলে মুক্তি পাইতে পার।”
ময়ূখ মুদ্রিতনয়নে কহিলেন, “শাহ্জাদী, আমি হিন্দু, প্রাণভয়ে মিথ্যা কথা বলিব না। আমি ব্রাহ্মণ, মুসলমান নহি, আমার নাম ময়ূখ, সর্ওয়ার খাঁ নহে, এই রমণীকে আমি চিনি না। আমি মরণের জন্য প্রস্তুত, বিলম্ব করিয়া যন্ত্রণা বাড়াইবেন ন৷।”
“তুমি পত্নীগ্রহণ করিবে না?”
“আমার পত্নী নাই, কারণ এখনও আমার বিবাহ হয় নাই।”।
“এখনও ভাবিয়া দেখ।”
“শাহ্জাদী, মিথ্যা বলি নাই, যবনী বিবাহ করিব না, ধর্ম্মত্যাগ করিব না, মরণের রাজ্যে আসিয়া মিথ্যা বলি নাই।”
শাহ্জাদী ইঙ্গিত করিলেন, জল্লাদ্ ময়ূখের হস্ত ধরিয়া আকর্ষণ করিল। সহসা সেই ভূগর্ভস্থিত গৃহের ঘন অন্ধকার অপেক্ষা ঘন কৃষ্ণবর্ণ মসীপিণ্ড প্রাচীর হইতে লম্ফ দিয়া গৃহতলে অবতীর্ণ হইল এবং পদাঘাতে রন্ধ্র পদে জল্লাদকে যমুনাতলে প্রেরণ করিয়া পুনরায় প্রাচীরের অন্ধকারে মিশিয়া গেল। ময়ূখ বিস্মিত হইয়া রহিলেন, অস্ফুট শব্দ করিয়া গুলরুখ্ মূর্চ্ছিতা হইল, ভয়ে শাহ্জাদীর দেহ স্বেদাপ্লুত হইল।
অনেকক্ষণ কেহ কথা কহিল না। পরে ময়ূখ কহিলেন, “শাহ্জাদী, বিলম্বে প্রয়োজন নাই, কুঠার গিয়াছে, কিন্তু রজ্জু আছে, আবশ্যক হইলে আমি সহস্তে তাহা কণ্ঠে বেষ্টন করিব।”
শাহ্জাদী নীরব, যে তাতারী রজ্জু ধরিয়াছিল, সে দেখিল যে রজ্জু ধীরে ধীরে উপরে উঠিয়া অন্ধকারে মিশাইয়া গেল! সে “শোভানাল্লা” বলিয়া দূরে সরিয়া দাঁড়াইল। শাহজাদী স্তব্ধ। এই সময়ে সেই মসীপিণ্ড প্রাচীর হইতে একজন খোজার মুখে ভীষণ বেগে পদাঘাত করিল, তাহার হস্ত হইতে তরবারি পড়িয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেই মসীবর্ণ পুরুষ এক লম্ফে গৃহতলে অবতরণ করিয়া দ্বিতীয় খোজার মস্তকে অসির আঘাত করিল, খোজার মস্তক স্কন্ধ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া জহানারা বেগমের দেহে পড়িল। তখন অবশিষ্ট খোজা ও তাতারীগণ তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। সেই মসীপিণ্ড ময়ূখকে কহিল, “মহারাজ, দুই খানা তলোয়ার পড়িয়া আছে, দুয়ার হাব্সীদের পিছনে।”
ময়ূখ চিত্রার্পিতের ন্যায় দাঁড়াইয়াছিলেন, মসীপিণ্ডের কথা শুনিয়া তাঁহার চমক ভাঙ্গিল। তিনি তরবারি গ্রহণ করিলেন। আগন্তুকের কথা শুনিয়া খোজাদিগের ভয় ভাঙ্গিল, একজন কহিল, “ওরে জীন নহে, মানুষ।” দ্বিতীয় ব্যক্তি কহিল, “পাগল আর কি? মানুষ হইলে কখন আসমানে উঠিয়া যাইতে পারে?” তখন সেই মসীপিণ্ড পুনরায় কহিল, “হাঁ, আমি মানুষ।” ময়ূখ এতক্ষণে তাহাকে চিনিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভুবন?”
ভুবন কহিল, “হুজুর, বিলম্ব করিয়া কাজ নাই।”
সেই মুহূর্ত্তে খোজা ও তাতারীগণ তাহাদিগকে আক্রমণ করিল, অনেকগুলি উল্কা নিবিয়া গেল, বধমঞ্চ পুনরায় অন্ধকারপ্রায় হইল, এই সময়ে গুলরুখের চেতনা ফিরিল। সহসা গুলরুখ্ শাহ্জাদীর পদতলে পতিত হইয়া কহিলেন, “শাহ্জাদী মারিও না, আমি আর একবার বুঝাইয়া দেখি।” জহানারা বেগমের মন ভিজিল, তিনি ইঙ্গিত করিলেন, খোজাগণ নিরস্ত হইল। তাহা দেখিয়া ভুবন এক লম্ফে ফাঁসী কাষ্ঠে উঠিয়া অন্ধকারে মিশিয়া গেল।
পুনরার মশাল জ্বলিল। খোজা ও তাতারীগণ সেই ভূগর্ভস্থিত পুরী তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করিল; কিন্তু ভুবনকে দেখিতে পাওয়া গেল না। তখন গুলরুখের অনুরোধে খোজা ও তাতারীগণ কক্ষ পরিত্যাগ করিল। শাহ্জাদীও কক্ষের বাহিরে আসিলেন। গুলরুখ্ ধীরে ধীরে ময়ূখের দিকে অগ্রসর হইলেন। ময়ূখ তাঁহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিবি, তুমি কে? তুমি কেন আমায় বৃথা কষ্ট দিতেছ?” গুলরুখ স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন, তখন তাঁহার হৃদয় দ্রুতবেগে স্পন্দিত হইতেছিল, জিহ্বা শুষ্ক হইয়া আসিয়াছিল, গুলরুখের মুখে কথা ফুটিল না। তাহা দেখিয়া ময়ূখ মনে করিলেন যে রমণী অস্ত্র দেখিয়া ভয় পাইয়াছে। তিনি তরবারি দূরে নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন, “আমি ত আপনাকে চিনি না?”
সহসা গুলরুখের জিহ্বার জড়তা দূর হইল, সে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, “তুমি-আপনি—আমাকে চিনিতে পারিলে না?” ময়ূখ কহিলেন, “না।”
“সপ্তগ্রামের যুদ্ধে আহত হইয়াছিলে স্মরণ আছে?” “অাছে ” “বজরায় আমি তোমাকে শুশ্রূষা করিয়াছিলাম— স্মরণ আছে?”
“সে কি তুমি?”
“হাঁ।”
“রোগশয্যায় স্বপ্ন দেখিতাম আমার শিয়রে বসিয়া ললিতা সেতার বাজাইতেছে, কিন্তু ললিতা ত সেতার বাজাইতে জানে না?” “সে ললিতা নহে, সে আমি।” “তোমাকে ত আমি পূর্ব্বে দেখি নাই?”
“না। জীবনসর্ব্বস্ব, ত্রিবেণীর ঘাটে দূর হইতে তোমাকে দেখিয়া তোমার চরণে আত্মসমর্পণ করিয়াছি।”
গুলরুখ্ এই বলিয়া ময়ূখের পদযুগল ধারণ করিলেন। ময়ূখ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন গুলরুখ্ পুনর্ব্বার বলিতে আরম্ভ করিল, “তোমাকে পাইব বলিয়া লজ্জা সরম বিসর্জ্জন দিয়াছি, আসদ্ খাঁ ও শাহ্নওয়াজ খাঁর নিকট পরিচয় দিয়াছি যে আমি তোমার ধর্ম্মপত্নী। তুমি সপ্তগ্রামের যুদ্ধে আহত হইয়া পথে পড়িয়াছিলে, আমি তখন শাহ্নওয়াজ খাঁর সহিত বজরায় যাইতেছিলাম, আমরা তোমাকে পথ হইতে বজরায় উঠাইয়া আনিয়াছিলাম। বজরায় তুমি দুই তিন দিন অজ্ঞান হইয়াছিলে, আমাকে ললিতা বলিয়া ডাকিতে, আমি ভাবিতাম তুমি আমাকে আদর করিতেছ। হুগলীর ফিরিঙ্গিরা যখন আমাদের বজরা ডুবাইয়া দেয় তখন হইতে তোমাকে আর খুঁজিয়া পাই নাই। তাহার পর সে দিন দেখিলাম, তুমি পাণিফটকের নিকট দাঁড়াইয়া আছ। আমি তোমাকে এইখানে আনাইয়াছি, শাহ্জাদীর নিকটও পরিচয় দিয়াছি যে তুমি আমার স্বামী। তোমাকে দেখিবার আশায়, তোমাকে পাইবার আশায়, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়াছি, তুমি কি আমার হইবে না? দেখ, আমি রমণী, লজ্জা সরম বিসর্জ্জন দিয়া তোমার নিকট ভিক্ষা চাহিতেছি।”