“বাদশাহের আদেশ, তাহাকে শাহ্নশাহের সম্মুখে উপস্থিত করিতে হইবে।”
“মথুরার ফৌজদারকে আদেশ করুন, তাহাকে যেন পাল্কীতে পাঠাইয়া দেয়, পর্ত্তুগীজ পাদ্রীর অনুগ্রহে চৈতন্যদাস চলচ্ছক্তিরহিত।”
উজীর করতালিধ্বনি করিলেন, একজন খোজা আসিয়া অভিবাদন করিল, আসফ্ খাঁ খাসনবীশকে ডাকিয়া দিতে আদেশ করিলেন। অবিলম্বে খাসনবীশ আসিল, উজীর চৈতন্যদাসকে আগ্রায় পাঠাইবার জন্য পত্র লিখিলেন। তৃতীয় প্রহর অতীত হইল, দিল্লী ফটকে নৌবৎ বাজিয়া উঠিল। রাত্রি শেষ হইয়া আসিয়াছে দেখিয়া তর্করত্ন বিদায় চাহিলেন। বিদায় দিবার সময়ে উজীর তাঁহাকে পরদিন আমদরবারে ও গোসলখানায় উপস্থিত থাকিতে অনুরোধ করিয়া, খাস চৌকীর মনসবদার স্বীয় পুত্র শায়েস্তা খাঁর নামে পত্র দিলেন। তর্করত্ন ময়ূখের গৃহে ফিরিলেন।
তিনি বিদায় হইলে আসফ খাঁ পুনরায় করতালিধ্বনি করিলেন, একজন খোজা কক্ষে প্রবেশ করিয়া অভিবাদন করিল। উজীর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “খাওয়াস্ আমানৎ খাঁ ফিরিয়াছে?” খোজা কহিল, “জনাব, হাঁ।”
“তাঁহাকে ডাকিয়া আন।”
খোজা অভিবাদন করিয়া নিষ্ক্রাস্ত হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে তাহার সহিত অতি কুৎসিত কুজপৃষ্ঠ একজন হাব্সী কক্ষে প্রবেশ করিয়া অভিবাদন করিল। আসফ্ খাঁ তখন অবনত বদনে চিন্তা করিতেছিলেন। খোজাদ্বয় কৃষ্ণমর্ম্মরে খোদিত পাষাণমূর্ত্তির ন্যায় স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। অর্দ্ধদণ্ড পরে উজীর মুখ তুলিলেন, তখন কুব্জপৃষ্ঠ খোজা পুনরায় অভিবাদন করিল। আসফ্ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমানৎ খাঁ?” খোজা কহিল, “জনাব!”
“সমস্ত কার্য্য শেষ করিয়াছ?”
“জনাব, সমস্ত শেষ।”
“বাঙ্গালী কোথায় গেল?”
“জনাব, সে সাঁতার দিয়া পাণিফটক পার হইয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিয়াছে।”
“কেহ দেখিতে পায় নাই ত?” “আলম্পনা, বুড়া বাঙ্গালী জলের ভিতর ডুবিয়া সাঁতার দিয়া ত্রিশ গজ পরিখা ও পাঁচ গজ লহর পার হইয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিয়াছে।”
“সাবাস, তাহার কথা অন্দরে বলিয়া আসিয়াছ?” “সরদারণী মেহেদী বিবিকে বলিয়া আসিয়াছি, হিলাল খাঁর মুখে রঙ্গমহলের বখ্শী হিম্মত খাঁ য়াকুৎকে খবর দিয়াছি।” “বাঙ্গালী রাজাকে কয়েদ করিল কে? সে খবর লইয়াছ?”
“সমস্ত খবর পাই নাই তবে সন্ধ্যার পরে য়াকুৎ বাঁদী গুলজার আর কালমক্ ইরাদৎ খাঁ নৌকায় করিয়া পাণি ফটকে আসিয়াছিল, ইরাদৎ খাঁ সেখানে নামিয়া গিয়াছিল, গুলজার বাঁদী নৌকা লইয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিয়াছে। বুড়া বাঙ্গালী বলিয়াছিল যে, তাহার রাজাকে একজন মরদ্ ও একজন আওরৎ নৌকায় করিয়া ধরিয়া লইয়া গিয়াছে। গুলজার বিবিই যে বাঙ্গালী রাজাকে কয়েদ করিয়াছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।”
“উত্তম, তুমি যাও।”
খোজাদ্বয় অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিল, আসফ্ খাঁ অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। সার্দ্ধ তৃতীয় প্রহরে বিস্তৃত মোগল সাম্রাজ্যের প্রধান অমাত্যের বিশ্রামের অবসর হইল।
২১. নবাব আলিয়া বেগম
একবিংশ পরিচ্ছেদ
নবাব আলিয়া বেগম
আগ্রা দুর্গের অভ্যন্তরে বাদশাহের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিবার দুইটি প্রকাশ্য পথ ছিল, একটি দিল্লী ফটকে ও অপরটি অমরসিংহ ফটকের সম্মুখে। এতদ্ব্যতীত পাণি ফটক দিয়াও অন্তঃপুরে প্রবেশ করা যাইত, কিন্তু সে পথ কেবল বাদশাহের অবরোধবাসিনী রমণীগণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এই তিনটি প্রকাশ্য পথ ব্যতীত আগ্রা দুর্গের অন্তঃপুর প্রবেশের একটি গুপ্ত পথ ছিল, স্বয়ং বাদশাহ্ ব্যতীত অন্য কৈহ সে পথ জানিতেন না।
অন্তঃপুরে আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে এক বেগমের মহল হইতে অন্য বেগমের মহলে যাইবার বহু গুপ্ত পথ নির্ম্মিত হইয়াছিল। শাহ্জহানের আমলে আরজ্ মন্দ বাণু বেগম ব্যতীত মহল সরার অন্য কোন অধিবাসিনী না থাকায়, গুপ্তপথ ব্যবহৃত হইত না। যোধবাই মহলের পশ্চাতে বাদশাহ্ বেগমের হামামের নিম্নে একটি গুপ্ত গৃহ আছে। এই গৃহে এখনও একটি বধমঞ্চ দেখিতে পাওয়া যায়। কোনও অন্তঃপুরচারিণী রীতিবিরুদ্ধ আচরণ করিলে, বাদশাহ্ অথবা প্রধানা বেগম এই গৃহে তাহাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করিতেন। মোগল সাম্রাজ্যের যুগের ধ্বংসাবশেষ মধ্যে আগ্রা দুর্গে শ্বেত ও রক্তমর্ম্মরনির্ম্মিত বিশাল প্রাসাদের নিম্নে পথবিচলিতা অন্তঃপুরচারিণীর জীবননাট্যের শেষ অঙ্ক যে রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইত, তাহা এখনও দর্শকের মনে ভীতি সঞ্চার করিয়া থাকে।
বহুদিন এই বধমঞ্চ ব্যবহৃত হয় নাই; বাদশাহের অন্তঃপুরে বহুদিন কোনও অবরোধবাসিনী স্বীয় রক্তস্রোতে স্বেচ্ছাচারের প্রায়শ্চিত্ত করেন নাই; বহু দিন সে কক্ষে কেহ প্রবেশ করে নাই। কক্ষ আবর্জ্জনাময়, গৃহতল ধুলায় আচ্ছন্ন, বহুদিন পরে সহসা সেই অন্ধকার গৃহ বহু মশালের আলোকে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। চারিজন খোজা ময়ূখকে লইয়া সেই কক্ষে প্রবেশ করিল। তাহাদিগের সম্মুখে পাঁচজন ও পশ্চাতে পাঁচজন তাতারী প্রতিহারী মশাল হস্তে প্রবেশ করিল, পরে গুলরুখ্ ও জহানার বেগম আসিলেন। সর্ব্বশেষে কুঠার হস্তে এক জন খোজা ও রজ্জু হস্তে একজন তাতারী কক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার রুদ্ধ করিল।
খোজাগণ ময়ূখকে নামাইয়া তাঁহার বন্ধন মোচন করিল এবং তাঁহাকে জহানারা বেগমের সম্মুখে রাখিয়া দূরে সরিয়া দাঁড়াইল। মশাল হস্তে তাতারীগণ প্রাচীরের পার্শ্বে সারি দিয়া দাঁড়াইল। যে কুঠারহস্তে আসিয়াছিল, সে বহুদিনের রক্তস্রোতে বিবর্ণ কাষ্ঠখণ্ড টানিয়া লইয়া আঘাতের জন্য প্রস্তুত হইল। তাতারী ফাঁসীকাষ্ঠে রজ্জু লাগাইয়া গৃহতলের মধ্যদেশ হইতে কাষ্ঠখণ্ড সরাইয়া ফেলিল, সঙ্গে সঙ্গে যমুনা-জলের কুলুকুলুধ্বনি শ্রুত হইল।