“এইবার গোঁসাইজীকে দেখিয়া লইব। ধর্ম্ম আছেন, ব্রাহ্মণের উপরে অত্যাচার কখন সহ্য হয়? দর্পহারী মধুসূদন, তুমি সত্য। আমি ফুলের মুখুটী, বিষ্ণু ঠাকুরের সন্তান, আমার উপর অত্যাচার?”
ভাগীরথীর পশ্চিম পারে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে একটি প্রাচীন অশ্বখ বৃক্ষের নিম্নে ইষ্টকনির্ম্মিত বেদীর উপরে বসিয়া কতিপয় বৃদ্ধ ও প্রৌঢ় সমাজসংস্কারে ব্যাপৃত ছিলেন। তাহাদিগের মধ্যে একজন বক্তাকে কহিলেন, “ওহে হরিনাথ, এখন কি করা যায় বল দেখি?”
“আবার কি? গোঁসাই আমার যে ব্যবস্থা করিয়াছিল তাহারও সেই ব্যবস্থা; আজি হইতে রাধামোহন গোস্বামীর হুকা বন্ধ, নাপিত বন্ধ, রজক বন্ধ। গোঁসাই সপরিবারে বৈরাগী হউক না হয় বৃন্দাবনে যাউক। কি বল মাধব খুড়া?”
তৃতীয় বৃদ্ধ ধীরে ধীরে কহিল, “তাহাই ত ব্যবস্থা। রাধামোহন গোস্বামীর অবিবাহিত যুবতী কন্যাকে যখন ফিরিঙ্গিতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তখন দোষ পিতৃকুলকেই ম্পর্শ করিয়াছে।”
দ্বিতীয় বক্তা মাধব খুড়াকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “খুড়া, ইহাই কি শেষ সিদ্ধান্ত? ব্রাহ্মণের শাস্তি বড় কঠোর হইল না?”
“কঠোর কিসে? এই সকল বিষয়ে গুরুতর দণ্ড বিধান না করিলে কিছু দিন পরে রাধামোহন গোস্বামী সমাজের বক্ষে পদাঘাত করিয়া ফিরিঙ্গী জামাতা ঘরে লইয়া আসিবে।” “কিহে, কালিদাস, কি বল?” “তাই ত, কি করা যায়?”
হরি। দেখ কালিদাস, তোমরা যদি রাধামোহন গোস্বামীকে সমাজচ্যুত না কর, তাহা হইলে আমি আত্মহত্যা করিব, আর তোমাদের ব্রহ্মহত্যার পাপ হইবে।
মাধব। সে কি কথা হরি, তুমি আমার দশ রাত্রের জ্ঞাতি, তোমাকে ছাড়িয়া আমি কি সুবর্ণ বণিকের ব্রাহ্মণ রাধামোহন গোস্বামীর পক্ষ অবলম্বন করিতে যাইব?
হরি। তবে গোস্বামী সমাজচ্যুত হইল?
মাধব। হইল বৈ কি।
এই সময়ে জনৈক দীর্ঘাকার শ্যামবর্ণ ব্রাহ্মণ অশ্বত্থতলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সমবেত ব্রাহ্মণগণ সকলেই অভিবাদন করিলেন। আগন্তুক জিজ্ঞাসা করিলেন-“কিহে মাধব, ব্যাপার কি?”
“তর্করত্ন মহাশয়, শুনিতে পাওয়া গেল রাধামোহন গোস্বামীর কন্যাকে ফিরিঙ্গীতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে”—“বল কি? কখন লইয়া গেল?” “এই দণ্ড দুই পূর্ব্বে।” “রাধামোহন শুনিয়াছে?” “খুব শুনিয়াছে, আমি নিজে গিয়া শুনাইয়া আসিয়াছি।” “তোমরা বৃদ্ধের দল এখানে বসিয়া কি করিতেছ?” “কি আর করিব? সমাজরক্ষার ব্যবস্থা করিতেছি।” “তোমরা কি পুরুষ না রমণী, দস্যুতে ব্রাহ্মণকন্যাকে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে, তোমরা তাহার উদ্ধারের চেষ্টা না করিয়া নিশ্চিন্ত মনে বসিয়া আছ? তোমরা না কুলীন সমাজের অগ্রণী, রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ সমাজের মুকুটমণি? মাধব, সমাজরক্ষার কি ব্যবস্থা করিতেছ?” “গোস্বামীর ধোপা নাপিত বন্ধ করিয়াছি।” “গোস্বামীর অপরাধ?” “বলেন কি তর্করত্ন মহাশয়, গোস্বামীর অবিবাহিত যুবতী কন্যাটাকে ফিরিঙ্গীতে ধরিয়া লইয়া গেল, সমাজ ইহার কোন প্রতিবিধান করিবে না? কঠোর শাস্তি বিধান না করিলে সমাজ অধঃপাতে যাইবে। দুইদিন পরে রাধামোহন গোস্বামী ফিরিঙ্গী জামাতাকে ঘরে আনিয়া সমাজ নিমন্ত্রণ করিবে।” “হরি, রাধামোহন কি ফিরিঙ্গীকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া কন্যা সম্প্রদান করিয়াছে?” “না।” “তবে কি হইয়াছে?” “গোস্বামীর কন্যা গঙ্গাস্নানে গিয়াছিল, ফিরিঙ্গীরা তাহাকে ঘাট হইতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।” “তাহাতে রাধামোহনের অপরাধ কি?” “অবিবাহিতা কন্যাকে স্লেচ্ছ ফিরিঙ্গী ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তাহাতে পিতৃকুলের দোষ হইবে না?” “পিতৃকুলের অপরাধ? এই মাত্র বলিতে পার যে কন্যা গঙ্গাস্নানে যায় কেন? এই সমাজে কাহার মাতা, কাহার বনিতা, কাহার ভগিনী গঙ্গাস্নানে না গিয়া থাকে?” রাঢ়ীয় কুলীন সমাজ নিরুত্তর। কিয়ৎক্ষণ পরে হরিনাথ সাহসে ভর করিয়া কহিল, “কিন্তু সমাজ রক্ষার উপায় কি হইবে?”
“সমাজের ত কোন হানি হয় নাই। তোমার ভাগিনী যখন মুসলমানের সহিত কুলত্যাগ করিয়াছিল, তখন তুমি তাহাকে গৃহে ফিরাইয়া আনিবার চেষ্টা করিয়াছিলে, সেইজন্য তোমার প্রতি দণ্ডবিধান করিয়া সমাজ রক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিলাম। রাধামোহনের কন্যা কি ফিরিঙ্গীর ঔরসজাত পুত্র প্রসব করিয়াছে?”
হরিনাথ অগত্যা নীরব হইল। তর্করত্ন পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “সমাজের কোন হানি হয় নাই, তথাপি সমাজ রক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছ; কিন্তু বৃদ্ধ অপুত্রক রাধামোহনের একমাত্র কন্যা দস্যুকর্ত্তৃক অপহৃত হইয়াছে, তাহার উদ্ধারের কি ব্যবস্থা করিয়াছ?”
“কি করব? ফিরিঙ্গী হার্ম্মাদ গোলা গুলি লইয়া লড়াই করে, একি যে সে দস্যু যে লাঠিয়াল পাঠাইয়া লড়াই করিব? ফৌজদার সুবাদার অবধি ফিরিঙ্গীর ভয়ে শঙ্কিত; সেখানে আমরা কি করিব?”
হরি। কিন্তু গোস্বামীকে জাতিচ্যুত করা উচিত।
তর্করত্ন। তোমরা মানুষ না পাষাণ? উপকার করিতে পার না, কিন্তু অপকার করিতে জান। অভাগিনীকে উদ্ধার না করিয়া তাহার পিতাকে জাতিচ্যুত করিতে বসিয়াছ? নারায়ণ! এই ব্রাহ্মণসমাজ রসাতলে যায়না কেন?
পশ্চাৎ হইতে গম্ভীরস্বরে উচ্চারিত হইল, “অনেক দিন গিয়াছে। তর্করত্ন, ইহা সমাজের কবন্ধ।” সকলে বিস্মিত হইয়া চাহিয়া দেখিলেন, বৃদ্ধ রাধামোহন গোস্বামী অর্দ্ধনগ্ন অবস্থায় দাঁডাইয়া আছেন। মুহূর্ত্তমধ্যে তর্করত্ন তাঁহাকে বাহুপাশে আবদ্ধ করিলেন, সহানুভূতি পাইয়া বৃদ্ধ ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সেই অবসরে কুলীনকূলচূড়ামণি হরিনাথ মুখোপাধ্যায় পলায়ন করিল।