“তোমরা কি পর্ত্তুগীজ ফিরিঙ্গির দুষমন্?”
“হাঁ”
“তোমরা ঈসাই?”
“হাঁ, তবে পর্ত্তুগীজদের ন্যায় নহে।”
“যদি শাহানশাহ্ বাদশাহের হুকুম তামিল করিতে পার, তাহা হইলে তোমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে।”
বাদশাহ্ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আসদ্ খাঁ, তোমার সহিত সপ্তগ্রামে ফিরিঙ্গির বিবাদ হইয়াছিল কেন?”
“জহাপনা, এক কাফের পাদ্রীর নিকট হইতে পলাইয়া বাদশাহী বন্দরে আশ্রয় লইয়াছিল, পাদ্রী ফিরিঙ্গি সিপাহী লইয়া তাহাকে ধরিয়া লইয়া যাইবার উদ্যোগ করিয়াছিল, আমি বাধা দিয়াছিলাম বলিয়া সে আমাকেও আক্রমণ করিয়াছিল। সেই দিন দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র আমার জীবন রক্ষা করিয়াছিল। কাফেরকে ধরিয়া লইয়া যাইতে পারে নাই বলিয়া ফিরিঙ্গি ফৌজ রাত্রিকালে বন্দর আক্রমণ করিয়া লুট করিয়াছিল। তখনও এই যুবা সপ্তগ্রাম রক্ষা করিয়াছিল।”
“আপনি সেই রাত্রিতে ফিরিঙ্গির সহিত লড়াই করিয়াছিলেন?”
“হাঁ, নবাব শাহ্নওয়াজ খাঁও সেই রাত্রিতে উপস্থিত ছিলেন।”
শাহ্নওয়াজ খাঁ অগ্রসর হইয়া আসিলেন, আসফ্ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি ফিরিঙ্গিদের হাঙ্গামার দিনে সপ্তগ্রামে ছিলেন?”
“হাঁ, আমি ও আমার পুত্রবধূ সেই রাত্রিতে ফিরিঙ্গিদিগের হস্তে বন্দী হইয়াছিলাম। সপ্তগ্রামের শেঠ গোকুলবিহারীর আক্রমণে ফিরিঙ্গি হারিয়া পলাইয়া গিয়াছিল; পরদিন সপ্তগ্রামের নিম্নে ফিরিঙ্গিরা আমার বজরা মারিয়া অামাকে ও আমার পুত্রবধূকে ও আমার পালিতা কন্যাকে হুগ্লীতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল। ফিরিঙ্গি আমীর-উল্-বহর ডিসুজা দয়া করিয়া আমাদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছে।”
আসফ্ খাঁ ফিরিঙ্গি দূতকে কহিলেন,“আপনি শুনিলেন?”
“শুনিলাম।”
সহসা আসদ্ খাঁ বাদশাহের নিকটে আসিয়া অভিবাদন করিয়া কহিলেন, “শাহন্ শাহ্ বাদশাহের অনুমতি হইলে দাস কিঞ্চিৎ নিবেদন করিতে চাহে।”
বাদশাহ্ মস্তক সঞ্চালন করিয়া অনুমতি দিলেন, তখন আসদ্ খাঁ বৃদ্ধ উজীর আসফ্ খাঁকে কহিলেন, “জনাব, ইংরাজ বণিকের দূত সমস্ত কথা শুনেন নাই, নবাব শাহ্নওয়াজ খাঁ হিন্দুস্থানের একজন প্রসিদ্ধ ওমরাহ, আমি বাদশাহের অনুচর; সামান্য ফিরিঙ্গি বণিক্ যখন আমাদের উপর এমন অত্যাচার করিতে পারে, তখন সুবা বাঙ্গালার শত শত দরিদ্র প্রজা তাহাদিগের নিকট কি ব্যবহার পায় তাহা বিচারযোগ্য। আমার দুইজন সাক্ষী আছে।”
বাদশাহ্ এতক্ষণ নীরব ছিলেন, তিনি সহসা আসন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার মস্তক হইতে মণিমুক্তাখচিত বহুমূল্য উষ্ণীব খুলিয়া পড়িল, শাহ্জহান সক্রোধে বলিলেন, “আসদ্ খাঁ, সাক্ষী অনিবার আবশ্যক নাই। আমি যখন শাহ্জাদা ছিলাম, তখন আমাকে অসহায় দেখিয়া এই ফিরিঙ্গিগণ আমার সমস্ত দাসদাসী বন্দী করিয়া আমাকে ও আমার স্ত্রীকে অত্যন্ত অপমান করিয়াছিল। আমি বাদশাহ্ হইয়াও তাহাদিগের সকলকে উদ্ধার করিতে পারি নাই।”
বাদশাহের ক্রোধ দেখিয়া আসদ্ খাঁ ভয়ে পশ্চাৎপদ চইলেন। বাদশাহ্ বলিতে লাগিলেন, “ফিরিঙ্গি পর্ত্তুগীজেরা পিতাকে বলিয়াছিল যে শাহ্জাদা খুর্রম বাদশাহের বিরুদ্ধে আমাদিগের নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করিয়াছিলেন। আমরা সাহায্য না করায় তিনি মিথ্যা দোষারোপ করিয়াছিলেন। আমার পত্নীর দুইটি দাসী এখনও সপ্তগ্রামে বন্দী আছে। শীঘ্রই পর্ত্তুগীজ বণিকের দর্পচূর্ণ করিব; ওয়াইল্ড, তুমি আমাকে সাহায্য করিতে পার?”
“জহাপনার হুকুম।”
“পর্ত্তুগীজের জাহাজ দেখিলেই মারিবে, পর্ত্তুগীজের পণ্য দেখিলেই লুটিবে, তাহা হইলে সুবা বাঙ্গালা ও উড়িষ্যায় কুঠী খুলিতে পারিবে।”
সুরট বন্দরের ইংরাজ কোম্পানীর প্রধান সসম্মান অভিবাদন করিয়া কহিল, “বাদশাহের ফর্ম্মাণ পাইলেই পারি।”
“কল্য প্রভাতে ফর্ম্মাণ পাইবে।”
তখন ইংরাজ কোম্পানি পর্ত্তুগীজ বণিকের প্রতিদ্বন্দ্বী; আরব সমুদ্রে, পারস্য উপসাগরে ও সুরটে ইংরাজ বণিকের সহিত পর্ত্তুগীজগণের বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যুদ্ধ হইয়া গিয়াছে। বাদশাহের মুখে এই অপ্রত্যাশিত সুখ সংবাদ শুনিয়া ওয়াইল্ড সানন্দে তিনবার ভূমি চুম্বন করিয়া অভিবাদন করিল। বাদশাহ্ উজীরকে কহিলেন, “সাহেব, ফিরিঙ্গি দমন ফিদাইখাঁর কার্য্য নহে, কল্য কাসেমখাঁকে তলব করিবেন, দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র হাজারী মন্সবদার।”
সকলে অভিবাদন করিলেন; তঞ্জাম আসিল, বাদশাহ্ রঙ্গমহলে প্রবেশ করিলেন ৷
ময়ূখ যখন গৃহে ফিরিতেছিলেন তখন অন্ধকারে এক ব্যক্তি তাঁহার মস্তকে আঘাত করিল, তিনি চেতনা হারাইয়া পড়িয়া গেলেন। তখন একজন পুরুষ ও একটি রমণী তাঁহার দেহ একখানি ছোট নৌকায় তুলিল এবং যমুনা বাহিয়া দুর্গের পাণি ফটকে প্রবেশ করিল। অন্ধকারে লুকাইয়া আর এক ব্যক্তি ময়ূখের গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল, নৌকা পাণি ফটকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া সে সহরে উজীর আসফখাঁর গৃহে সংবাদ দিতে চলিল।
১৯. গুপ্তপথে
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
গুপ্তপথে
যখন চেতনা ফিরিয়া আসিল, তখন ময়ূখ দেখিলেন যে তিনি একটি সঙ্কীর্ণ কক্ষমধ্যে বহুমূল্য শয্যায় শয়ান আছেন। কক্ষটি দুই হস্তের অধিক প্রশস্ত নহে, কিন্তু দীর্ঘে অনন্ত। সেই অপ্রশস্ত গৃহে অস্পষ্ট আলোকে ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে তাঁহার শিয়রে এক ভয়ঙ্করী রমণীমূর্ত্তি বসিয়া আছে। তাহার নাসিকা নাই বলিলেই হয়, চক্ষু দুইটি ক্ষুদ্র, কোটরগত, বর্ণ হরিদ্রাভ। তাঁহার চেতনা ফিরিয়াছে দেখিয়া, রমণী শয্যার নিকটে আসিল, ময়ূখ দেখিতে পাইলেন যে তাহার কটিদেশে দীর্ঘ কৃপাণ আবদ্ধ রহিয়াছে। রমণী তাতারী, তখন ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় তাতার রমণী ব্যতীত অন্য কোন জাতীয় স্ত্রীলোক মোগল বাদশাহের অন্তঃপুরে প্রতিহারীর পদ পাইত না। ময়ূখ কয়েক বৎসর আগ্রায় থাকিয়া তাতার চিনিয়াছিলেন। তিনি ভয়ে শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি জানিতেন তাতারীর অসাধ্য কার্য্য নাই। তাতারী নিকটে আসিয়া বলিল, “জাগিয়াছিস? বড় জোর চোট লাগিয়াছিল, না? একটু সরাব পি।” রমণী বস্ত্রমধ্য হইতে চর্ম্মনির্ম্মিত আধার বাহির করিল, তাহার মুখে সুরার তীব্র গন্ধ, স্নানাভাবজনিত অঙ্গের দুর্গন্ধের সহিত মিশিয়া, তাহাকে অভিভূত করিয়া তুলিল; ময়ূখ মুখ ফিরাইয়া লইলেন। তাতারী হাসিয়া উঠিল এবং ময়ূখের মুখময় সুরা ছড়াইয়া দিল। তিনি তখন দুর্ব্বল, ধীরে ধীরে শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তখন রমণী আসিয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন করিল, ময়ূখ মুক্ত হইবার চেষ্টা করিলেন কিন্তু পারিলেন না। পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া তাতারী তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল। ময়ূখ ফিরিয়া দেখিলেন যে শয্যাপার্শ্বে দুইটি সুন্দরী যুবতী দাঁড়াইয়া আছে। প্রথমা বিদেশিনী, তাহার বর্ণ গোলাপের ন্যায় হইলেও উগ্র, কেশ পিঙ্গল বর্ণ এবং চক্ষুর মণি পীতবর্ণ; দ্বিতীয়া, স্নিগ্ধ পদ্মরাগবর্ণা, তাহার কুঞ্চিত আর্দ্র কৃষ্ণ কেশরাশি ভূমিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে এবং তাহার নীল নয়নদ্বয়ে চঞ্চল ভ্রমরবৎ কৃষ্ণ তারকা দুইটি সর্ব্বদাই যেন নৃত্য করিতেছে। ময়ূখ বিস্মিত হইয় তাঁহাদিগের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মনে হইল দ্বিতীয়া তাহার পরিচিত। জীবনের কোন এক তমসাচ্ছন্নযুগে বিস্মৃতির অন্ধকার মধ্যে এই সুন্দর মুখখানি উজ্জ্বল আলোকের ন্যায় ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সে কবে? সে কোথায়?