তখন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চক জনশূন্য, মতি মসজিদ, টাঁকশাল, ও নাকারাখানা জনশূন্য, দেওয়ান-ই-আমের প্রকাণ্ড চত্তর জনশূন্য। চত্তরের চারিদিকে মন্সবদারদিগের কাছারিতে অনেকগুলি আলোক জ্বলিতেছে, দুই একজন মনসবদার বখ্শীর আদেশের অপেক্ষায় তখনও প্রতীক্ষা করিতেছে। ময়ূখ ও তাঁহার সঙ্গী নাকারাখানা হইতে পশ্চিম দিকে গমন করিয়া দেওয়ান-ই-আমের বামদিকে একটি ক্ষুদ্র দ্বারে প্রবেশ করিলেন। সেই দ্বারের পশ্চাতে উলঙ্গ কৃপাণ হস্তে একজন হাবসী খোজা পাহারা দিতেছিল, আসফ্ খাঁর অনুচর তাহাকে উজীরের মোহরাঙ্কিত পত্র দেখাইল, খোজা পথ ছাড়িয়া দিল। দ্বারের পশ্চাতে সোপানশ্রেণী ছিল, তাহা অবলম্বন করিয়া ময়ূখ উপরে উঠিলেন। সম্মুখে রক্তবর্ণপ্রস্তরনির্ম্মিত দ্বিতল গৃহ, তাহাতে অসংখ্য চোপদার, হরকরা, খোজা ও পরিচারক অপেক্ষা করিতেছিল। ময়ূখ ও তাঁহার সঙ্গী সে মহল পার হইয়া দেওয়ান-ই-খাসের চত্তরে প্রবেশ করিলেন। প্রবেশ দ্বারে খাস্ চৌকীর দারোগা সায়েস্তা খাঁ অপেক্ষা করিতেছিলেন, ময়ূখকে তাঁহার নিকট পৌঁছাইয়া দিয়া তাঁহার সঙ্গী চলিয়া গেল।
সায়েস্তা খাঁ ময়ূখের আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করিয়া একজন খোজাকে ইঙ্গিত করিলেন। খোজা ময়ূখকে লইয়া দেওয়ান-ই-খাসের চত্তরে প্রবেশ করিল। আগ্রাদুর্গের পাণি ফটকের পশ্চাতে শ্বেতমর্ম্মরনির্ম্মিত প্রশস্ত ছাদ, তাহার একদিকে একখানি কৃষ্ণমর্ম্মরনির্ম্মিত ও অপরদিকে শুভ্রমর্ম্মরনির্ম্মিত এক একখানি সুখাসন। ছাদের উত্তরদিকে দেওয়ান-ই-খাস, শ্বেতমর্ম্মরনির্ম্মিত ক্ষুদ্র গৃহ। এই ক্ষুদ্র গৃহের প্রাচীরে যত বহুমূল্য প্রস্তর ও মণিমুক্তা চিত্রাঙ্কনের জন্য সন্নিবিষ্ট হইয়াছিল, লোকে বলিত যে তাহা ব্যয় করিলে আর একটা আগ্রা সহর নির্ম্মিত হইতে পারে। বাদশাহ্ তখনও আসেন নাই, দেওয়ান-ই-খাসের সম্মুখে উজীর আসফ্ খাঁ মীরবখ্শী নূরউল্লাখাঁর সহিত পরামর্শ করিতেছিলেন। ময়ূখ আসফ্ খাঁকে অভিবাদন করিয়া প্রাচীরের চিত্র পরীক্ষা করিতে লাগিলেন।
পান্নার ময়ূর, চুনি ও পোখ্রাজ-খচিত বিচিত্র পুচ্ছ বিস্তার করিয়া মুক্তার আঙ্গুর গুচ্ছে চঞ্চু দিয়া আঘাত করিতেছে। সে চিত্র এখন আর নাই, বহুপূর্ব্বে জাঠ দস্যু সুরজমল তাহা লুণ্ঠন করিয়া লইয়া গিয়াছে। ময়ূখ চিত্র দেখিতেছেন, এমন সময়ে এক ব্যক্তি তাঁহার স্কন্ধে হস্তার্পণ করিল। ময়ূখ ফিরিয়া দেখিলেন যে তাঁহার পার্শ্বে আসদ্ খাঁ দাঁড়াইয়া আছেন। ময়ূখ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া অভিবাদন করিলেন, আসদ্ খাঁ তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, “ময়ূখ, তুমি দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র, আমার জীবনদাতা, বহুদিন পরে তোমার দর্শন পাইয়া আজ বড়ই আনন্দ লাভ করিয়াছি। তুমি কি করিবে?”
“বাদশাহের অধীনে চাকরী পাইলে গ্রহণ করিব।”
“এতদিন কোথায় ছিলে?”
ময়ূখ সপ্তগ্রামের যুদ্ধের পরে তাহার যে অবস্থা হইয়াছিল, তাহা যতদূর জানিতেন বলিলেন, তখন আসদ্ খাঁ পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “ময়ূখ, তুমি কত দিন আগ্রায় আসিয়াছ?”
“প্রায় তিন বৎসর হইল।”
“এতদিন কি করিতেছিলে?”
“জীবিক অর্জ্জনের উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। বাদশাহ দরবারে কোনও পরিচিত ব্যক্তি ছিল না বলিয়া এতদিন কিছু সুবিধা করিতে পারি নাই।”
“আজি কি উপায়ে আসিলে?”
“সেই বৈষ্ণবী হজ্রৎ বাদশাহ বেগমকে সূঁচের কাজ শিখাইতে যায়, তিনি নবাব আসফ্ খাঁকে পত্র দিয়াছিলেন, সেই জন্য উজীর স্বয়ং আমাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছেন।”
“অদ্য খোদা ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদের বিনাশের উপায় জুটাইয়া দিয়াছেন, নূতন ফিরিঙ্গি দিয়া পুরাতন ফিরিঙ্গি বিনাশ করিব।”
ময়ূখ বিম্মিত হইয়া আসদ্ খাঁর মুখের দিকে চাহিলেন। সহসা নাকারাখানায় নাকারা বাজিয়া উঠিল, আসদ্ খাঁ ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। ময়ূখ দেখিলেন যে, দেওয়ান-ই-খাসের পশ্চাতে একটি সুবর্ণনির্ম্মিত কবাট খুলিয়া গিয়াছে, বাদশাহ্ ক্ষুদ্র হস্তিদন্তনির্ম্মিত তঞ্জামে আরোহণ করিয়া প্রবেশ করিতেছেন। সমবেত সভাসদ্গণ তিন বার ভূমি স্পর্শ করিয়া অভিবাদন করিল, তাহা দেখিয়া ময়ূখও তদ্রূপ করিলেন। বাদশাহ্ উপবেশন করিলে উজীর আসফ্ খাঁ, বখ্শী নূরউল্লা খাঁ, আসদ্ খাঁ, শাহ্নওয়াজ খাঁ, প্রভৃতি সভাসদ্গণ সিংহাসন বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইলেন। আসফ্ খাঁ সর্ব্ব প্রথমে ময়ূখকে বাদশাহের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। বাদশাহ শাহ্জহান প্রসন্নবদনে কহিলেন, “বাঙ্গালী বাহাদুর, তোমার কথা বিস্মৃত হই নাই, কিন্তু তোমার অগ্রে ফিরিঙ্গি।” আসফ্ খাঁ ষিবণ্ণ বদনে কহিলেন, “জনাব, এই যুবা আগ্রা সহরে তিন বৎসর বেকার বসিয়া আছে, ইহার পিতা জিন্নৎমকানী বাদশাহ্ জহাঙ্গীরের জমানায় সরকারের বহুৎ খিদ্মৎ করিয়াছে—”
“সাহেব, অদ্যই ইহার ব্যবস্থা করিব। ফিরিঙ্গি দূত কোথায়?”
“উপস্থিত আছে।”
অল্পক্ষণ পরে সায়েস্তা খাঁ জনৈক বয়স্ক ফিরিঙ্গিকে লইয়া দেওয়ান-ই-খাসে প্রবেশ করিলেন। ফিরিঙ্গি ভূমি চুম্বন করিয়া বাদশাহকে অভিবাদন করিল। উজীর আসফ্ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ফিরিঙ্গি, তোমার নাম কি?”
ফিরিঙ্গি পুনরায় অভিবাদন করিয়া কহিল,—“আমার নাম ওয়াইল্ড, আমি সুরট বন্দরে ইংরাজ কোম্পানীর প্রধান।”