সহস্র উষ্ট্র এবং সহস্র সুসজ্জিত অশ্ব বাদশাহকে অভিবাদন করিয়া চলিয়া গেল। তখন খাস চৌকীর মন্সবদারের সেনা বাদশাহের সম্মুখে আসিয়া অভিবাদন করিয়া স্বস্থানে প্রত্যবর্ত্তন করিল। দুর্গের বাহির হইতে দলে দলে অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনা নাকারাখানার পথে প্রবেশ করিয়া বাদশাহকে অভিবাদন করিতে আসিল। পঞ্চাশৎ সহস্র অশ্বারোহী ও লক্ষ পদাতিক আসিতে যাইতে দুই দণ্ড সময় লাগিল। এই অবসরে বাদশাহ আর্জী শুনিতে লাগিলেন। সমস্ত সৈন্যের অভিবাদন শেষ হইলে নাকারা থামিল, তখন আসফ্ খাঁ অস্ফুটস্বরে বাদশাহকে কি বলিলেন। বাদশাহ সম্মতি দিলেন, একজন চোপদার যুবককে রজতের রেলিংয়ের সম্মুখে আনিল। যুবক আসফ্ খাঁর ন্যায় অভিবাদন করিল।
বাদশাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “সাহেব, এই যুবা কে?” আসফ্ খাঁ অভিবাদন করিয়া কহিলেন, “ইহার নাম ময়ূখ, ইহার পিতা দেবেন্দ্রনারায়ণ সুবা বাঙ্গালার একজন জমিদার ছিল, জিন্নৎমকানী নূরউদ্দীন জহাঙ্গীর বাদশাহের সময় ইহার পিতা তখ্তের বহুৎ খিদ্মৎ করিয়াছে।”
বাদশাহ হাসিয়া কহিলেন, “স্মরণ আছে, আমি যখন বিদ্রোহী হইয়াছিলাম তখন উড়িষ্যা ও আক্বরাবাদে ইহার পিতা আমার সহিত লড়াই করিয়াছিল।”
“শাহান শাহ্ বাদশাহের হুকুমে দেবেন্দ্রনারায়ণ শাহজাদা খুর্রমের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিয়াছিল, ভরসা করি শাহার-উদ্দীন মহম্মদ্ শাহ্জহান্ বাদশাহ লাজী সাহিবি কিরাণমানি সে অপরাধ গ্রহণ করিবেন না।”
এই সময়ে তৃতীয় স্তরে ইফ্তিকার্-উল্-মুলক্ আসদ্ খাঁ ও দ্বিতীয় স্তরে মনিরুদ্দৌলা শাহ্নওয়াজ খাঁ অভিবাদন করিলেন। দেওয়ান-ই-আমের রীতি অনুসারে নকীব হাঁকিল, “রৌশন্-উল্ মুলক্ মুনিরুদ্দৌলা শাহ্নওয়াজ খাঁ হয়বৎ জঙ্গ হজরৎ জলালী।” বাদশাহ শাহ্নওয়াজ খাঁর দিকে চাহিলেন, বৃদ্ধ নবাব পুনরায় অভিবাদন করিয়া কহিলেন, “শাহান্ শাহ্, কাফের ফিরিঙ্গি যখন বাদশাহী বন্দর সপ্তগ্রাম আক্রমণ করিয়াছিল তখন এই কাফের যুবা সপ্তগ্রাম রক্ষা করিয়াছিল।” বাদশাহ আসদ্ খাঁর দিকে চাহিলেন, নকীব হাঁকিল, “ইফ্তিকার-উল্-মুলক সৈফ্উদ্দৌলা আমীর-উল্-বহর আসদ্ খাঁ শমসের জহাঙ্গীরী।” আসফ্ খাঁ অভিবাদন করিয়া বলিলেন, “জহাপনা, সুবাদার মোকরম্খাঁর আমলে সপ্তগ্রামে ফিরিঙ্গির সহিত যে লড়াই হইয়াছিল বন্দা সে সংবাদ পূর্ব্বেই নিবেদন করিয়াছে। ফিরিঙ্গির গোলার ভয়ে ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ পলায়ন করিলে, এই যুবা সপ্তগ্রামের এক বণিকের সেনা লইয়া বাদ্শাহী বন্দর রক্ষা করিয়াছিল।”
বাদশাহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুরাটের ফিরিঙ্গিদিগের দূত আসিয়াছে?”
উজীর কহিলেন, “জনাব আলী, আংরেজ ফিরিঙ্গির দূত নাকারাখানায় হাজির আছে, হুকুম হইলে দেওয়ান আমে উপস্থিত হইবে।”
“নবাব শাহ্নওয়াজ খাঁ, আসদ্ খাঁ ও ফিরিঙ্গি দূত গোসলখানায় আসিবেন। নবাব সাহেবের সহিত যে কাফের ফকীর আসিয়াছিল সে কি ফিরিয়া গিয়াছে?”
“শাহান্ শাহ, বাদশাহের হুকুম অনুসারে সে কাফের মথুরায় আছে।”
“তাহাকে তলব কর। আসদ্ খাঁ, নবাব সাহেব, রামিনউদ্দৌলা ও দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র দেওয়ান-ই-খাসে উপস্থিত হইবেন।”
বাদশাহ, তখ্ত পরিত্যাগ করিলেন, নাকারা বাজিয়া উঠিল, দরবার শেষ হইল।
১৭. মথুরার পুরোহিত
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
মথুরার পুরোহিত
সেই দিন তৃতীয় প্রহরে ময়ূখ ঘর্ম্মাক্ত কলেবরে সিকন্দরপুর মহল্লার একটি ক্ষুদ্র গৃহের দ্বারে করাঘাত করিলেন। ভিতর হইতে বামাকণ্ঠে প্রশ্ন হইল “কে?” “আমি, দুয়ার খোল।”
পুনরায় বাঙ্গালায় প্রশ্ন হইল “তুমি কে?” “আমি ময়ূখ, ভয় নাই, দুয়ার খোল।”
এই বার দুয়ার খুলিল, ময়ূখ গৃহে প্রবেশ করিলেন। দ্বারের পার্শ্বে বিনোদিনী দাঁড়াইয়াছিল, সে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, কি হইল?”
“দেওয়ান-ই-আমে গিয়াছিলাম, বাদশাহ্ দেওয়ান ই-খাসে যাইতে হুকুম করিয়াছেন, অদ্য সন্ধ্যাকালে যাইব।” “আমি গোবিন্দজীর পূজা তুলিয়া রাখিয়াছি। বাবা, বাদশাহ্ বেগমের বাঁদী আসিয়াছিল, আজি সন্ধ্যাকালে বৃন্দাবন হইতে বাঙ্গালী পুরোহিত আসিবেন। কালি অধিবাস, পরশু বিবাহ।”
ললিতা দ্বারের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া দরবারের কথা শুনিতে ছিলেন, বিবাহের নাম শুনিয়া ছুটিয়া পলাইলেন। ময়ূখ হস্ত মুখ প্রক্ষালন করিয়া বসিলেন, তখন বিনোদিনী আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাবা, কি বুঝিতেছ?” ময়ূখ বলিলেন, “মা, অদৃষ্ট বোধ হয় ফিরিতেছে, এত দিন আসদ্খাঁর সন্ধান করিয়া মরিলাম, আজি দেখি আসদ্খাঁ দেওয়ান-ই-আমে উপস্থিত।”
“কালি দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় আসিবেন।”
ময়ূখ গৃহে প্রবেশ করিলে, একজন দীর্ঘাকার কাল্মক্ তাতার ও অবগুণ্ঠনাবৃত এক মুসলমানী গৃহদ্বারে আসিয়া দাঁড়াইল। কাল্মক্ দূরে রহিল, রমণী গৃহদ্বারে কান লাগাইয়া কথোপকথন শুনিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণপরে কাল্মক্ জিজ্ঞাসা করিল, “কি শুনিলি?”
“বাঙ্গালা মুলুকের বুলি, কিছু বুঝিতে পারিতেছি না।”
“মরদ্টার নাম কি?”
“আ মর্, তাইত খুঁজিতেছি, সরাবের শিশিটা দে।”
“আর সরাব খাইলে টলিয়া পড়িয় যাইবি, তখন কোতয়ালীতে ধরিয়া লইয়া যাইবে।”
রাজধানীর জনাকীর্ণ পথে বহুলোক চলিতেছিল, ক্ষুদ্র গৃহদ্বারে দীর্ঘাকার সশস্ত্র কাল্মক্কে দেখিয়া কেহ কেহ বিস্মিত হইল; কিন্তু তাহার সহিত রমণীকে দেখিয়া কোনও সন্দেহ করিল না। সেই সময়ে বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “ময়ূখ, তুমি কখন্ দেওয়ান-ই-খাসে যাইবে?” ময়ূখ কহিলেন, “সন্ধ্যার পরে।”