যুবক প্রফুল্লবদনে কহিল, “মা, এতদিনে বোধ হয় ভগবান্ মুখ তুলিয়া চাহিলেন।”
“আর এতদিনে বোধ হয় ললিতার দুঃখ ঘুচিল।”
“আসদ্খাঁর কোন সংবাদ পাইলে?”
“না, তবে শুনিলাম যে ফিদাই খাঁ নিকট হইতে খাজনা লইয়া দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায় আগ্রায় আসিতেছেন।”
“আসদ্ খাঁ না আসিলে বাদশাহের দরবারে সুবিধা হইবে না।”
“দেখ বাবা, এইবার তুমি ললিতাকে বিবাহ কর।”
“বাঙ্গালী পুরোহিত পাইব কোথায়?”
“বাদশাহ বেগম বলিয়াছেন যে বৃন্দাবন হইতে একজন বাঙ্গালী গোস্বামী আনাইয়া দিবেন। তিনি ললিতাকে দেখিতে চাহিয়াছেন, আমি বলিয়াছি যে বিবাহের পরে লইয়া আসিব।”
যুবক উত্তর দিল না, তাহা দেখিয়া প্রৌঢ়ার নয়নদ্বয় আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। নৌকা সহরের দিকে চলিয়া গেল। তখন জহাঙ্গীরি মহলে শুভ্র মর্ম্মরাচ্ছাদিত গৃহতলে বসিয়া পূর্ব্ব পরিচিতা যুবতী তাতারীর সহিত পরামর্শ করিতেছিলেন। যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, “যে স্ত্রীলোকটা নৌকায় গিয়া উঠিল, তাহাকে তুই চিনিস?” তাতারী কছিল “চিনি।” “ও কে?” “ও বাঙ্গালী, ভাল সূঁচের কাজ করিতে জানে, দুই দিন অন্তর হজরৎ বাদশাহ বেগমের নিকটে আসে।” “উহার নাম কি?” “সে আমি বলিতে পারিব না, হয় বিন্দিনী নয় বিন্দানী।” “বিনোদিনী কি?” “হাঁ, আপনি ঠিক কাফেরের মত কথা বলিতে পারেন।” “আমি যে, অনেক দিন বাঙ্গালা মুলুকে ছিলাম।” “উহাকে কি আপনি চেনেন?” “না, তোকে যা বলিতেছি শোন, নৌকার কাছে যে বসিয়াছিল সে আমার খসম। তুই তাহার সন্ধান করিতে পারিস্?” “কেন পারিব না? ছুটি পাইলেই হয়, তবে কিছু খরচ আছে।” “যত টাকা লাগে দিব, তুই কি সহরের পথ ঘাট চিনিস্?” “আমি চিনি না বটে, তবে সহরে আমার এক দোস্ত আছে”—তাতারী এই বলিয়া ঈষৎ হাসিল—“সে আগ্রা সহরের প্রত্যেক লোককে চেনে, কিন্তু বেগম সাহেব, তাহার একটু ঘন ঘন তৃষ্ণা পায়!” “আমি খান্সামানের উপরে হুকুমনামা দিতেছি, তুই তাহাকে ইরাণী ও ফিরিঙ্গি আরকে ডুবাইয়। রাখিস।”
তাতারী দীর্ঘ সেলাম করিয়া কহিল, “তাহা হইলে এক হপ্তামধ্যে বেগম সাহেবের খসমের সন্ধান আনিয়া দিব।”
“তাহাকে ধরিয়া আনিতে হইবে।”
“কোথায় আনিব?”
“কেন, মহল্ সরার মধ্যে।” “তাহা হইলে কাহারও মাথা থাকিবে না।” “কেন?” “শুনিয়াছি, নুরজহাঁ বেগমের আমলে দুই এক জন মরদ্ আওরত্ সাজিয়া মহল্ সরার ভিতরে আসিত, কিন্তু হজরৎ আরজ্মন্দ্ বানু বেগম সাহেবার আমলে তাহা হইবার উপায় নাই।”
“তবে আমি বেগম সাহেবার হুকুম লইয়া রাখিব।”
“দোহাই বেগম সাহেবা, এখন হজরৎ বাদসাহ বেগমকে কিছু বলিও না, তাহা হইলে খসমের দেখা পাইবে না। বেগম সাহেব তোমার খসম্ পলাইয়াছে শুনিলে তাহাকে বাঁধিয়া আনিবার হুকুম দিবেন, সহরে গোল হইয়া যাইবে, কোটওয়ালের ফৌজ সাজিতে সাজিতে তোমার থসম্ সংবাদ পাইয়া পালইবে। তুমি ব্যস্ত হইও না, আমি আগে সন্ধান লইয়া আসি।”
“সেই ভাল।”
“বেগম সাহেব, সর্বতের কিছু খরচা আর বখ্শিসের কিছু বায়না দিলে ভাল হয়।”
“কত দিব?”
“দশটা কি পনেরটা আশ্রফি দিয়া ফেল না?“
“পোড়ার মুখি, অতগুলা টাকা লইয়া কি করিবি?”
“কেন, বেগম সাহেবকে দোয়া করিব, দুই দোস্তে সরাব খাইব, আর গর হাজির খসম্কে সোয়াবগাহে হাজির করিয়া দিব?”
“পনের আশরফির সরাব খাইবি?”
“বেগম সাহেব, এ তোমার কর্ম্ম নয়; এ আগ্রা সহর, কথায় বলে দার্-উল-মুল্ক আগ্রা। বেগম সাহেব, বাদশাহী কিল্লায় বসিয়া কৃপণ হইলে চলিবে না, যদি খসম চাও মুঠ মুঠা আশরফি ছাড়।”
“তোর যত টাকা লাগিবে দিব, কিন্তু তুই পনের আশরাফী কি করিবি?”
“দুইটা আশরাফী দোস্তকে বায়না দিব, একটা আশরাফী এক বেটা ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ্কে ঘুস্ দিয়া দশ কার্ফা আরক চোলাই করিয়া লইব, তাহাতে আন্দাজ দশ আশরাফী খরচ হইবে। সহরের খরচের জন্য মোট দুইটা আশরাফী রহিল।”
যুবতী তাতারীকে কাগজ কলম আনিতে বলিল। কাগজ আসিলে তাহাকে এক পত্র লিখিয়া দিল, মুখে বলিল, “জুম্মা মসজিদের পার্শ্বে আমার আমিল্ নাজীর আহম্মদ খাঁ আছে, তাহাকে এই রোকা দিলে তোকে পনের আশরাফী দিবে।” তাতারী আশরাফী লইয়া সেলাম করিল এবং কহিল, “এইবার হজরৎ বাদশাহ বেগমের নিকট ছুটি পাইলেই হয়।” যুবতী জিজ্ঞাসা করিল, “কয় দিনের ছুটি চাই?”
“এক হফ্তা।”
“এক হফ্তা ত মদই খাইবি, তবে আমার খসম্ খুজিবি কখন?”
“বেগম সাহেব, কাল্মক্ তাতারের পেটে ফিরিঙ্গির আরক যতক্ষণ তাজা থাকিবে ততক্ষণ সে অসাধ্য সাধন করিবে, কিন্তু নেশা ছুটিলেই সর্ব্বনাশ! আর নড়িতে চাহিবে না। আরক আর পায় না বলিয়াই যত তাতার ও তাতারী আফিম ধরিয়াছে।” “তুই কি কাল্মক্ না কি?” “না আমি য়াকুৎ, আমার দোস্ত কাল্মক্।”
এই সময়ে চতুর্দ্দশবর্ষীয়া পরম সুন্দরী একটি বালিকা জহাঙ্গীরি মহলে প্রবেশ করিয়া যুবতীকে কহিল, “গুল্রুখ্, মা তোমাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন।” যুবতী ব্যস্ত হইয়া কহিল, “যাই বেগম সাহেব, হজরৎ বাদশাহ বেগম কোথায়?” বালিকা কহিল, “মা যোধবাই মহলে আছেন।” যুবতী তাতারীর সহিত দ্রুতপদে যোধবাই মহলের দিকে গমন করিল।
১৬. দেওয়ান-ই-আম
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
দেওয়ান-ই-আম
এই ঘটনার দুই তিন দিবস পরে একদিন প্রথম প্রহরের শেষে য়ামিন্উদ্দৌলা নবাব আসফ খাঁ হস্তিপৃষ্ঠে দরবার আমে গমন করিতেছিলেন। আসফ্ খাঁ নুরজঁহা বেগমের ভ্রাতা, আরজ্ মন্দ্ বাণু বেগমের পিতা, বাদশাহ শাহজহানের শ্বশুর, তিনি মোগল বাদশাহের দরবারে একজন প্রধান ব্যক্তি। তাঁহার নিজের অশ্বারোহী ও পদাতিক সেনা তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া যাইতেছিল। হস্তীর পশ্চাতে এক শ্বেতবর্ণ সিন্ধুদেশীয় অশ্বপৃষ্ঠে জনৈক গৌরবর্ণ যুবক ধীরে ধীরে চলিতেছিল। হস্তী জুম্মা মসজিদের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, নবাব হস্তী হইতে অবতরণ করিলেন। মস্জিদের সম্মুখে আগ্রা দুর্গের প্রধান তোরণ, তোরণের সম্মুখে এক জন পাঁচ হাজারি মনসবদারের শিবির, এই শিবিরের সম্মুখে বাদশাহ অথবা তাঁহার পুত্রগণ ব্যতীত অপর সকলকেই যান পরিত্যাগ করিতে হইত। আসফ্ খাঁ যুবকের সহিত ফটকের সম্মুখে আসিলেন, সেই স্থানে একজন তুরাণী মন্সব্দার পাহারায় ছিল, সে বাদশাহের শ্বশুরকে অভিবাদন করিয়া পথ ছাড়িয়া দিল। ফটকের উপরে নৌবৎ বাজিতেছিল, কারণ বাদশাহ তখন দরবারে, তিনি যতক্ষণ দরবারে থাকিতেন ততক্ষণ আগ্রা দুর্গের দিল্লী ও অমরসিংহ ফটকে নৌবত বাজিত।