বিনোদিনী মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে বসিল; ক্ষণকাল পরে কহিল, “ললিতা যখন আমার আশ্রয়ে আসিয়া পড়িয়াছে তখন আমি তাহাকে ফেলিয়া দিতে পারিব না। এখানে থাকিলেও তাহাকে রক্ষা করিতে পারিব না। বাবা, আমরা আগ্রা যাইব, আর কোথাও ফিরিঙ্গীর হাত হইতে ললিতাকে বাঁচাইতে পারিব না। বাবা, তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাইবে?
ময়ূখ বলিলেন, “যাইব।”
সেই দিন হইতে বিনোদিনী আর ললিতাকে ঘরের বাহির হইতে দিল না। ময়ূখ সুস্থ হইলে সে এক নিশীথ রাত্রিতে তাহার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কু্টীর দ্বারারুদ্ধ করিয়া ললিতা ও ময়ূখের সহিত পলায়ন করিল। তাহার দুইদিন পরে ফৌজদারী সিপাহীর সহিত তর্করত্ন মহাশয় ও ভুবন আসিয়া ময়ূখ বা ললিতাকে দেখিতে পাইলেন না।
নাজিম্ আসদ্ খাঁ ভুবনের মুখে ময়ূখের সংবাদ পাইয়া, তর্করত্ন মহাশয় ও ভুবনকে সন্ধান লইবার জন্য গোপনে হুগলী প্রেরণ করিয়াছিলেন। তর্করত্ন যখন সপ্তগ্রামে ফিরিলেন তখন শাহ্ওয়াজ খাঁ, আলীনকী খাঁ ও আসদ্ খাঁ পরামর্শ করিতেছিলেন। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ নবাব নাজীমকে জানাইলেন যে, ময়ূখ জীবিত আছেন, রাধামোহন গোস্বামীর কন্যা ও তিনি হুগলীতে বিনোদিনী বৈষ্ণবীর গৃহে আশ্রয় পাইয়াছিলেন, কিন্তু দুই তিন দিন পূর্ব্বে বিনোদিনী রাত্রিযোগে তাহাদিগকে লইয়া পলায়ন করিয়াছে, কোথায় গিয়াছে কেহ বলিতে পারে না। সংবাদ শ্রবণ করিয়া শাহ্নওয়াজ খাঁ ও আসদ্ খাঁ বিষন্ন বদনে চিন্তা করিতে লাগিলেন। বহুক্ষণ পরে আসদ খাঁ কহিলেন, “নবাব, আপনি বাদশাহের দরবারে ফিরিয়া যান। শাহান্শাহ, বাদশাহের আদেশে অপর কেহ যতক্ষণ বাঙ্গালার নাজিম নিযুক্ত না হইবেন, ততক্ষণ আমি জহাঙ্গীর নগরে থাকিতে বাধ্য, নূতন সুবাদার আসিলে আমিও আকবরাবাদ যাইব।” শাহ্নওয়াজ খাঁ দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, “তাহাই হউক, রাদন্দাজ্ ও আমি কল্যই সপ্তগ্রাম পরিত্যাগ করিব।”
“দেবেন্দ্র নারায়ণের যে কয়জন পুরাতন ভৃত্য ময়ূখের সন্ধানে আসিয়াছিল, তাহাদিগকে আপনার সহিত লইয়া যান, পথে মখ্সুসাবাদে তাহাদিগকে ছাড়িয়া দিবেন। কাফের, তোমরা নবাব সাহেবের সহিত ফিরিয়া যাও, দেবেন্দ্র নারায়ণের পুত্র যদি কখনও ফিরিয়া আসে, তাহা হইলে ভীমেশ্বরে সংবাদ পাঠাইব।”
তর্করত্ন মহাশয় কহিলেন, “হুজুর, আমি ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ জাতি হিন্দুদিগের মধ্যে দেওয়ানা ফকীর বিশেষ। সংসারে আপনার বলিতে আমার কেহই নাই। যে দিন ভীমেশ্বর পরিত্যাগ করি, সেইদিন ভীমেশ্বর স্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম যে, যদি কখন প্রভুপুত্রের সহিত ফিরিতে পারি তাহা হইলে ভীমেশ্বরে ফিরিব, নতুবা কাশীবাস করিব। নবাব সাহেব আগ্রায় ফিরিবেন, আমাদের কয়জনকে সঙ্গে লইয়া গেলে বড়ই বাধিত হইব।”
“কাফের, তুমি আগ্রায় গিয়া কি করিবে?”
“বাদশাহের দরবারে ফিরিঙ্গির অত্যাচারের কথা নিবেদন করিব।”
শাহ্নওয়াজ খাঁ বলিলেন, “উত্তম কথা, আমিও ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদের অত্যাচারের সাক্ষী বাদশাহের দরবারে উপস্থিত করিতে চাহি। এই কাফের মোল্লা আমার সহিত যাইতে প্রস্তুত আছে; পাদ্রী যে কাফের ফকীরকে পীড়ন করিয়াছিল তাহাকেও লইয়া যাইতে পারিলে ভাল হয়।”
আসদ্ খাঁ বলিলেন, “উত্তম।”
গুলরুখ্ সপ্তগ্রামে ফিরিয়া আসিয়া রাদন্দাজ্ খাঁর গৃহে বাস করিতেছিলেন, তাঁহার ভৃত্যবর্গ একে একে ফিরিয়া আসিয়াছিল। গৃহে ফিরিয়া শাহ্নওয়াজ খাঁ গুলরুখকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, আমরা কল্য আগ্রা যাত্রা করিব, তোমরা কোথায় যাইবে?” যুবতী কহিল, “কোথায় যাইব তাহাত স্থির করি নাই? মনে করিতেছি, আপনার সহিত আগ্রায় যাইব।”
“চল, আমরা কল্য প্রভাতে যাত্রা করিব।” “আমিও যাইব। আমার স্বামীর কোন সন্ধান পাওয়া গিয়াছে কি?” “গিয়াছে, তিনি হুগলীতে এক কাফের রমণীর গৃহে আশ্রয় লইয়াছিলেন, পরে সে স্থান হইতে পলায়ন করিয়াছেন। মা, তোমার স্বামী কি কাফের ছিলেন?”
“ছিলেন, তিনি আমাকে বিবাহ করিবার জন্য মুসলমান হইয়াছিলেন।” “তুমি কি তাহার পূর্ব্ব পরিচয় জান?” “না।” “তিনি রাঢ়দেশের এক জমীদারের পুত্র।” “হার্ম্মাদ অত্যাচারের জন্য বাঙ্গালা দেশ নিরাপদ নহে; সেই জন্য মনে করিতেছি আগ্রায় গিয়া বাদশাহের দরবারে সমস্ত দুঃখ নিবেদন করিব। আমি আশ্রয়হীনা অনাথিনী,—একাকী বাঙ্গালা দেশে থাকিয়া স্বামীকে উদ্ধার করিতে পারিব না।”
পরদিন শাহ্নওয়াজ খাঁ, রাদন্দাজ্ খাঁ ও তাঁহার পত্নী, গুলরুখ্, ফতেমা, নাজীর আহমদ্ খাঁ, হবীব, চৈতন্যদাস বৈরাগী, তর্করত্ন মহাশয় ও ভুবন জলপথে আগ্রায় যাত্রা করিলেন।
১৫. যমুনাতীরে
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
যমুনাতীরে আগ্রা দুর্গের সম্মুখে একজন গৌরবর্ণ যুবা পুরুষ একখানি নৌকার সম্মুখে বসিয়াছিল। তখনও যমুনা কিল্লা হইতে দূরে সরিয়া যায় নাই, দুর্গের সম্মুখে একটিও বৃক্ষ জন্মায় নাই। ভীষণ রৌদ্র, বাদশাহ তখন আগ্রায়; সুতরাং দুর্গের সম্মুখে ছত্র ব্যবহার করিবার উপায় নাই। যুবক মধ্যে মধ্যে রুমাল দিয়া রৌদ্র হইতে আত্মরক্ষার চেষ্টা করিতেছিল, আবার তৎক্ষণাৎ দুর্গের দিকে চাহিয়া তাহা নামাইয়া লইতেছিল। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি নামিয়াছে, তথাপি রৌদ্রের তেজ অতীব প্রখর। দুর্গ মধ্যে শুভ্র মর্ম্মরনির্ম্মিত অসংখ্য প্রাসাদশ্রেণীর অগণিত বাতায়নপথ সুবর্ণখচিত বহুবর্ণের যবনিকায় আবৃত। বাদশাহ তখন দুর্গমধ্যে, সেইজন্য হরিৎ বর্ণের পতাকা উড়িতেছে, দুর্গের চারিপার্শ্বে এক একজন সেনাপতি সহস্র হস্ত ব্যবধানে সেনানিবাস স্থাপন করিয়াছেন। সর্ব্বদা সুসজ্জিত সৈন্যগণ দুর্গের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। দুর্গমধ্যে যমুনাতীরে প্রাসাদের অন্তঃপুর, সে স্থানে তাতারী ও তুর্কী প্রতীহারীগণ ভীষণ রৌদ্রে শূন্যমস্তকে দশহস্ত ব্যবধানে দাঁড়াইয়া আছে। দুই তিন জন প্রহরী আসিয়া যুবককে অপেক্ষা করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিল, কিন্তু যুবকের নিকটে বাদশাহী পঞ্জা দেখিয়া দূরে সরিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে দুই দণ্ড অতীত হইয়া গেল, যুবকের নিদ্রাকর্ষণ হইল। এই সময়ে দুর্গমধ্যে জহাঙ্গীরি মহলে সেতার বাজিতে আরম্ভ হইল। যুবক মনে করিল যে, বহুদূর বঙ্গদেশে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী-সঙ্গমে সে একখানি বৃহৎ বজরার কক্ষে গজদন্তনির্ম্মিত খট্টায় শয়ন করিয়া আছে, আর তাহার পার্শ্বে বসিয়া এক অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী সেতার সিন্ধু ভূপালী বাজাইতেছে। ক্ষণকাল পরে যুবকের তন্দ্রার ঘোর ছাড়িয়া গেল; সে চমকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কিন্তু তথাপি সেতারের আওয়াজ আসিতে লাগিল; যুবক চক্ষু মার্জ্জনা করিল। তখনও সিন্ধু ভূপালী বাজিতেছিল। হঠাৎ জহাঙ্গীরি মহলের একটি গবাক্ষের যবনিকা সরিয়া গেল, তাহাতে তাতারী প্রতীহারী ও একটি যুবতীর মুখ দৃষ্ট হইল। যুবক সেই দিকে চাহিল, মুহূর্ত্তের জন্য রমণীদ্বয়ের মুখমণ্ডল তাহার নয়নগোচর হইল। তাতারী নিমক্হারাম্ নহে, সে তৎক্ষণাৎ যবনিকা টানিয়া দিল, যুবকের মনে হইল যে দ্বিতীয়ার মুখ তাহার নিকট অপরিচিত নহে। গবাক্ষের যবনিকা সরিল না। ক্ষণকাল পরে দরিয়াই ফটক হইতে একজন খোজা ও একটি পরিচারিকার সহিত এক প্রৌঢ়া বাহির হইয়া আসিল। তাহাকে নৌকায় তুলিয়া লইয়া যুবক মাঝিদিগকে নৌকা ছাড়িয়া দিতে বলিল। আগ্রার কিল্লা দূরে সরিয়া গেলে, প্রৌঢ়া অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া কহিল, “বাবা, আজি সংবাদ শুভ; বাদশাহ বেগমকে রাজি করিয়া আসিয়াছি, তুমি কল্য নবাব আসফ্ খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করিও, তিনি তোমাকে দেওয়ান-ই-খাসে লইয়া যাইবেন।”