নবাব নাজিম্, আলীনকী খাঁ ও গোষ্ঠবিহারী দুর্গ হইতে যাত্রা করিলেন। দুর্গের তোরণে একজন বৃদ্ধ ধীবর নবাব নাজিমকে অভিবাদন করিল। আহদীরা তাহাকে তাড়াইয়া দিতে ছিল, কিন্তু আসদ্ খাঁ তাহাদিগকে নিষেধ করিয়া কহিলেন, “বৃদ্ধ কি বলিতে আসিয়াছে বলিতে দাও।” তখন বৃদ্ধ অগ্রসর হইয়া কহিল, “হুজুর, আমি বুড়া মানুষ, চোখে ভাল দেখিতে পাই না। আমি ভীমেশ্বরের স্বর্গীয় মহারাজ দেবেন্দ্রনারায়ণের নৌকায় ছিলাম, বড় বিপদে পড়িয়া আপনার নিকটে আসিয়াছি।”
আসদ্ খাঁ বিস্মিত হইয়া কহিলেন, “দেবেন্দ্রনারায়ণ? তুমি কি তাহার পুত্রের সহিত আসিয়াছিলে?” উত্তর দিবার পূর্ব্বে ভুবন আসদ্ খাঁর মুখের দিকে ভাল করিয়া চাহিল, তাহার পরে ধীরে ধীরে কহিল, “হুজুর, আমি বুড়া মানুষ, ছোটলোক, আমার অপরাধ গ্রহণ করিবেন না। আপনি কি আসদ্ খাঁ? পিপলী ও আকবরনগরের যুদ্ধে আপনাকে দেখিয়াছি।” আসদ্ খাঁ হাসিয়া কহিলেন, “আমিই আসদ্ খাঁ। তুমি দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্রের সংবাদ বলিতে পার?”
ভুবন আসদ্ খাঁ পদতলে লুটাইয়া পড়িয়া কহিল, “হুজুর, সেই সংবাদ লইয়াই আসিয়াছি।”
ভুবন গৌরীপুরের ঘাট হইতে ললিতাহরণের কাহিনী, ময়ূখের যাত্রা প্রভৃতি সমস্ত বলিয়া গেল। অবশেষে সে কহিল, “সেই বুড়া আমীরের নৌকা হইতে মহারাজ যখন আমাকে ডাকিলেন তখনই হার্ম্মাদের কেল্লার গোলা বজ্রা ও আমাদের নৌকা ডুবাইয়া দিল। আমাদের নৌকার ভট্টাচার্য্য মহাশয়, এক বৈরাগী ও দুই তিন জন লোক ধরা পড়িয়াছিল, কিন্তু বজ্রার সকলেই বন্দী হইয়াছে।” আসদ্ খাঁ জিজ্ঞাসা করিলেন, “বজ্রা হুগলীতে গেল কেন?”
“হার্ম্মাদের ছিপ্ ধরিয়া লইয়া গিয়াছিল।” “আলীনকী খাঁ, সমস্তই শুনিলে, এখন হুগলী আক্রমণ করা ব্যতীত উপায় নাই।”
এই সময়ে আসদ্ খাঁ দেখিলেন যে, দূরে একজন বৃদ্ধ মুসলমান রাদন্দাজ খাঁর সহিত দ্রুতপদে অগ্রসর হইতেছেন। নাজিম বলিয়া উঠিলেন, “শোভান আল্লা, নবাব শাহ্নওয়াজ খাঁ ফিরিঙ্গির হাত হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছেন।” শাহ্নওয়াজ খাঁ আসিয়া বলিলেন যে ফিরিঙ্গি আমীর-উল্-বহর ডিসুজা তাঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিয়াছেন। তখন আসদ্ খাঁ দুর্গে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন।
১৪. পরিচয়
চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ
পরিচয়
বিনোদিনীকে আর্ত্তনাদ করিয়া বসিয়া পড়িতে দেখিয়া, ললিতা ছুটিয়া আসিয়া তাহার কণ্ঠালিঙ্গন করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে মা? এমন করিলি কেন মা?” বিনোদিনী উত্তর দিল না, ললিতাকে আলিঙ্গন করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তাহা দেখিয়া ললিতার চক্ষুও জলে ভরিয়া আসিল, উভয়ে অনেকক্ষণ নিঃশব্দে রোদন করিল। ময়ূখ কিছু বুঝিতে না পারিয়া ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ললিতা, কাঁদিতেছ কেন? তোমাদের কি হইয়াছে?” উত্তর না পাইয়া তিনি পুনর্ব্বার ঐ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন বিনোদিনী চক্ষু মুছিয়া কহিল, “মা, সমস্ত পরিচয় দিতেছি, আগে তোমাদের পরিচয় লই। উনি কি জামাই?”
ললিতার মুখ লজ্জায় রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, সে অবগুণ্ঠন টানিয়া দিয়া কহিল, “ছি, তা কেন? উনি ভীমেশ্বরের রাজার ছেলে। গৌরীপুরের ঘাটে যখন আমাকে হার্ম্মাদে ধরে, তখন উনি নৌকায় বসিয়া মাছ ধরিতেছিলেন।” “তবে তুই যে বড় উহাকে লইয়া আসিলি?”
ললিতার রক্তবর্ণ মুখ লজ্জায় আরও লাল হইয়া উঠিল, সে কহিল, “তাহা বলিতে পারি না।” এই বলিয়া ললিতা মুখ ফিরাইল, বিনোদিনী তখন আর প্রশ্ন করিল না। ময়ূখ বুঝিলেন যে হুগলীতে তাঁহার উপস্থিতির কারণ নির্দ্দেশ করার আবশ্যক হইয়াছে। তিনি খাটের উপর হইতে ললিতাহরণের বৃত্তান্ত বলিতে আরম্ভ করিলেন। ময়ূখের কথা শেষ হইলে বিনোদিনী দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “মা, রাধাবিনোদ তোমাকে রক্ষা করিয়াছেন, তুমি ফিরিঙ্গীর হাতে পড়িয়াই পাগল হইয়া গিয়াছিলে, সেই জন্য গঞ্জালিস্ তোমাকে ছাড়িয়া দিয়াছিল। তোমাকে একলা হুগলীর পথে বেড়াইতে দেখিয়া আমি লইয়া আসিয়াছিলাম।”
“তুমি কে মা? তুমি আমার পরিচয় শুনিয়া কাঁদিয়া উঠিলে কেন?”
বিনোদিনী ললিতার প্রশ্ন শুনিয়া পুনরায় কাঁদিয়া উঠিল এবং তাহাকে বক্ষে টানিয়া লইয়া কহিল, “মা, যে দিন তোকে ধূলা কাদা মাখিয়া রুক্ষ কেশে হুগলীর পথে পথে বেড়াইতে দেখিয়াছিলাম সেই দিনই বুঝিয়াছিলাম যে তুই আমার আত্মীয়া, আমি খড়দহের তারানাথ ভট্টাচার্য্যের কন্যা, তোর গর্ভধারিণী আমার সহোদরা।”
ললিতা বিস্মিতা হইয়া বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, “মাসিমা, আপনি এখানে কেন? মায়ের মুখে কখনও মামার বাড়ীর নাম শুনি নাই, শুনিয়াছি আমার এক মামা ছিলেন, তিনি চৌদ্দ বৎসর পূর্ব্বে সন্ন্যাসী হইয়া গিয়াছেন।”
“চৌদ্দ বৎসর পূর্ব্বে গঞ্জালিস্ আমাকে ও আমার ভ্রাতৃজায়াকে খড়দহ হইতে ধরিয়া আনিয়াছিল। আমি বাল-বিধবা, তোমার মামী মরিয়া স্বর্গে গিয়াছেন, আর আমি পাপের পসরা বহিয়া মরিতেছি।” বিনোদিনী এই বলিয়া পুনরায় রোদন করিয়া উঠিল, ললিতা কি বলিবে স্থির করিতে না পারিয়া নিঃশব্দে ক্রন্দন করিতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে শান্ত হইয়া বিনোদিনী কহিল, “মা, এখন তোমার জ্ঞান হইয়াছে, ফিরিঙ্গীরা এ সংবাদ পাইলে এখনই তোমাকে ধরিয়া লইয়া যাইবে। তোমাকে এখন পলাইতে হইবে।” তাহার পরে ময়ূখের দিকে ফিরিয়া কহিল, “বাবা, তুমি যখন ললিতার জন্য এত করিয়াছ, তখন আর একটু উপকার কর, তুমি ইহাকে লইয়া ভীমেশ্বরে ফিরিয়া যাও।” ময়ূখ ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমি উঠিতে পারিলেই লইয়া যাইব।” তাহা শুনিয়া ললিতা বলিয়া উঠিল, “মাসিমা, ভীমেশ্বরে কোথায় যাইব? পিতা কি আমাকে গৃহে স্থান দিতে ভরসা করিবেন?” বলিতে বলিতে ললিতার আকর্ণবিশ্রান্ত নীলেন্দীবরতুল্য নয়নযুগল জলে ভরিয়া আসিল। ময়ূখ কহিলেন, “ললিতা, গোস্বামী ঠাকুর তোমাকে গৃহে লইতে সম্মত হইলেও গ্রামের লোকে দিবে কি না সন্দেহ। হরিনাথ গঙ্গোপাধ্যায় আছে, মাধব গঙ্গোপাধ্যায় আছে, কালিদাস চট্টোপাধ্যায় আছে, তাহারা নিশ্চিন্ত থাকিবে না।” বিনোদিনী দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “তাহাও ত বটে, তবে কি উপায় হইবে? বাবা, তুমি যখন ললিতাকে উদ্ধার করিতে আসিয়াছিলে তখন মনে কি স্থির করিয়াছিলে?” “মা, এ সকল কথা একবারও মনে হয় নাই।”