“তুমি কি বন্দীদিগকে যন্ত্রণা দিতে আরম্ভ করিয়াছ?”
“এই দুইজন বন্দী শয়তানের অনুচর, ইহাদিগের জন্য ভারতবর্ষের লোকে প্রকৃত ধর্ম্ম গ্রহণ করিতেছে না।”
যুবা অগ্রসর হইয়া চক্রে আবদ্ধ বৈষ্ণব ও তাহার পার্শ্বে ধূলায় ললুণ্ঠিত ব্রাহ্মণকে দেখিয়া অঙ্গুলী হেলন করিল। পাদ্রীর অনুচরদ্বয় তৎক্ষণাৎ চৈতন্যদাসের বন্ধন মোচন করিল, কিন্তু চৈতন্যদাস দাঁড়াইতে পারিল না, তাহার দেহ ধূলায় লুণ্ঠিত হইল। তাহা দেখিয়া যুবা পাদ্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, “ইহাকে কি হত্যা করিয়াছ?” পাদ্রী কহিল, আপনি শাসনকর্ত্তা সেই জন্য সম্মান করিতেছি, আমি আমার কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতেছি, কোনও শাসনকর্ত্তার নিকটে আমি কৃত কার্য্যের জন্য দায়ী নহি, স্বয়ং রাজাও আমার কার্য্যের হস্তক্ষেপ করিতে পারেন না। ঈশ্বরের প্রতিনিধি আমার একমাত্র প্রভু।”
“পাদ্রী, তুমি জান, ইহা স্পেন্ নহে, ইহা ভারতবর্ষ? জান যে এই দুইজন পৌত্তলিক আমাদের প্রজা নহে?” “জানি।” “তুমি জান এই হুগলী বন্দর সমর বিভাগের কর্ত্তৃত্বাধীন? তুমি জান যে এখানে তোমাদিগের আইন প্রচলিত নহে?” “জানি।” “তোমার স্মরণ আছে যে তুমি সত্য ধর্ম্ম প্রচার করিতে আসিয়াছ, নরহত্যা করিতে বা দেশ শাসন করিতে আস নাই?” “জানি।” “তবে তুমি নরহত্যা করিয়াছ কেন?” “সত্য ধর্ম্ম প্রচারের জন্য যাহা আবশ্যক তাহা করিয়াছি। ডিসুজা, এখন তুমি আমীরাল, স্মরণ রাখিও যে একদিন স্পেনে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে হইবে।”
“পাদ্রী, আমি সৈনিক, সর্ব্বদা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে প্রস্তুত। ভরসা করি, তোমার রাজত্বে প্রত্যাবর্ত্তন করিবার পূর্ব্বে আমার মৃত্যু হইবে। আলভারেজ্, তুমি নরঘাতী পিশাচ, ঈশার পবিত্র ধর্ম্ম তোমার ন্যায় চণ্ডালের জন্য ভারতবর্ষে নিন্দিত ও ঘৃণিত হইয়াছে, একদিন তোমাদিগের জন্য পর্ত্তুগীজ্ সাম্রাজ্য বিনষ্ট হইবে। যাহা করিয়াছ তাহা আমার অধিকারে দ্বিতীয় বার হইবে না।” “কেন হইবে না?” “আমার আদেশ।” “কোনও খৃষ্টান্ আমার আদেশ অবহেলা করিতে ভরসা করিবে না।” “পাত্রী, আমার আদেশের বিরুদ্ধে হুগলীর কোন পর্ত্তুগীজ্ তোমার আজ্ঞা পালন করিবে না।” “যাহারা পালন না করিবে তাহারা সমুচিত দণ্ড পাইবে।”
এই সময়ে আর একজন ফিরিঙ্গি যুবা দ্বারে দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমীরাল্ কি এখানে আছেন?” ডিসুজা কহিলেন, “আছি, কি হইয়াছে?” যুবা কক্ষে প্রবেশ করিয়া কহিল, “আমীরাল্, কল্য ডাকুন্হা যে বজরা মারিয়াছিল তাহা নবাব সাহ নওয়াজ খাঁর বজরা, আমি কারাগারে গিয়া তাঁহাকে দেখিয়া আসিয়াছি।” “সাহ নওয়াজ খাঁ কে?” “শাহজাদা শাহজহানের একজন প্রধান অনুচর। এখনই তাঁহাকে মুক্ত করুন, নতুবা মুহূর্ত্ত মধ্যে ভারতবর্ষে পর্ত্তুগীজ অধিকার বিলুপ্ত হইবে।”
ডিসুজা পাদ্রীর অনুচরদ্বয়কে কহিলেন, “এই দুইজন বন্দীকে বিনোদিনী বৈষ্ণবীর গৃহে লইয়া যাও। পাদ্রী আলভারেজ্ এখন হইতে বন্দী, তাঁহার অঙ্গে হস্তক্ষেপ করিও না, কিন্তু তাঁহাকে নজরবন্দী রাখিও।”
ডিসুজা আগন্তুকের সহিত কক্ষ পরিত্যাগ করিল। একজন ফিরিঙ্গি চৈতন্যদাসকে ক্রোড়ে উঠাইয়া লইল, দ্বিতীয় ব্যক্তি ব্রাহ্মণের দেহ স্পর্শ করিল। ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাইতে ইইবে?” ফিরিঙ্গি অঙ্গুলী দিয়া দ্বার দেখাইল, ব্রাহ্মণ ফিরিঙ্গিগণের সহিত কক্ষ ত্যাগ করিল।
১৩. ভাগ্যচক্র
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ভাগ্যচক্র
সপ্তগ্রামের দুর্গমধ্যে তোরণের পশ্চাতে আমীর-উল-বহর আসদ্ খাঁ বিষন্ন বদনে দাঁড়াইয়া আছেন, তাঁহার পশ্চাতে রাদন্ দাজখাঁ, আলীনকী খাঁ প্রমুখ মুসলমান সেনানায়ক ও শেঠ গোকুলবিহারী, তাহার পুত্র গোষ্ঠবিহারী, চিন্তামণি মজুমদার, হরিনারায়ণ শীল প্রভৃতি সপ্তগ্রামের প্রধানগণ দাঁড়াইয়া আছেন। সকলের মুখই বিষন্ন, আহত সেনাগণ আসদ্ খাঁর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, আসদ্ খাঁ তখনও ময়ূখের সন্ধান করিতেছেন। গোকুলবিহারী বলিলেন, “হুজুর, সপ্তগ্রামের লোকে যখন শুনিল যে ফিরিঙ্গির ভয়ে ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ পলাইয়াছেন, তখন লোকে সমস্ত আশা ভরসা বিসর্জ্জন দিয়া মরণের জন্য প্রস্তুত হইল। ফৌজদারী সেনা পলায়নের উদ্যোগ করিতেছিল, তখন সেই সিংহবিক্রম যুবা সাহস দিয়া ভরসা দিয়া সপ্তগ্রাম রক্ষার ব্যবস্থা করিয়াছিল; সেই ডাকুন্হার তোপ দখল করিয়াছিল, তাহার ভয়ে কুটিন্হোর বহর কিল্লার সম্মুখে আসিতে পারে নাই; সেই জন্য ত্রিবেণী রক্ষা হইয়াছিল; তাহারই উপদেশে আমি ডিসুজাকে আক্রমণ করিতে গিয়াছিলাম। কে জানিত যে আর তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না!” আসদ্ খাঁ কহিলেন, “হরিনারায়ণ, সেই যুবা কে জান?”
হরি। না হুজুর।
আসদ্। সে দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র।
চিন্তামণি। কে? ভীমেশ্বরের মহারাজ দেবেন্দ্রনারায়ণ?
আসদ্। হাঁ, যাঁহার বীরত্ব দেখিয়া একদিন শাহজাদা খুর্রমও বিস্মিত হইয়াছিলেন।
এই সময়ে একজন হরকরা আসিয়া কহিল, “বন্দানওয়াজ, হকিম্ আবুতোরাব খাঁ জনাবের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন।” আসদ্ খাঁ কহিলেন, “লইয়া আইস।” ক্ষণকাল পরে হরকরার সহিত সেই বৃদ্ধ হকিম আসিয়া আসদ্ খাঁকে অভিবাদন করিলেন। আসদ্ খাঁ কহিলেন, “হকিম সাহেব, আজি সপ্তগ্রামে হকিমের বড়ই প্রয়োজন।”