বিনোদিনী বৈষ্ণবী মালা লইয়াই নবাগতকে দেখিতে চলিল; তাহার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশী স্ত্রী পুরুষ অনেকেই চলিল। সকলে গঙ্গাতীরে গিয়া দেখিল যে হরিৎবর্ণ কোমল শম্পশয্যায় একটি গৌরবর্ণ যুবক পড়িয়া রহিয়াছে। যুবকের সর্ব্বাঙ্গে অস্ত্রাঘাতের চিহ্ন, তাহা বহু রক্তাক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্ত্রখণ্ডে আবদ্ধ। মৃতদেহ মনে করিয়া কেহই তাহার নিকটবর্ত্তী হইল না, কেবল পাগলিনী তাহার পার্শ্বে গিয়া বসিল। সে আহত যুবকের দক্ষিণ হস্ত উঠাইয়া লইয়া কহিল, “মরে নাই, তোমরা দূরে দাঁড়াইয়া আছ কেন? মা, ইহাকে বাড়ী লইয়া চল।”
পাগলিনীর নিকট আশ্বাস পাইয়া বৈষ্ণবী ধীরে ধীরে যুবকের নিকটে আসিল এবং তাঁহার মস্তক ক্রোড়ে উঠাইয়া লইল। সে পরীক্ষা করিয়া দেখিল যে যুবক সত্য সত্যই মরে নাই, তখনও ধীরে ধীরে শ্বাস বহিতেছে। বৈষ্ণবীর অনুরোধে দুই চারি জন পুরুষ আসিয়া আহত ব্যক্তিকে পরীক্ষা করিল, সকলেই বলিল যে হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া তখনও বন্ধ হয় নাই; তখন সকলে মিলিয়া যুবককে বৈষ্ণবীর গৃহে লইয়া গেল।
যুবক তাহার গৃহে আসিলে বৈষ্ণবী তাহাকে নিজের পালঙ্কে শোয়াইল, এবং তাহার ক্ষত স্থান পরিষ্কার করিয়া শুষ্ক বস্ত্র পরাইয়া দিল। পাগলিনীকে রোগীর শিয়রে বসাইয়া বিনোদিনী হকিম ডাকিতে গেল। তাহা শুনিয়া একজন প্রতিবেশিনী কহিল, “ফিরিঙ্গি মহলে ত বিনোদিনীর একচেটিয়া পসার, একটা ফিরিঙ্গি হকিম ডাকিয়া আনিল না কেন?, তাহা হইলে দুদিনে সারিয়া যাইত।” পাগলিনী ব্যগ্র হইয়া তাহাকে কহিল, “মা, তুমি গিয়া ফিরিঙ্গি হকিম ডাকিয়া আন না।” উত্তরে প্রতিবেশিনী হাত নাড়িয়া, মুখ নাড়িয়া, কঙ্কন বলয় নাড়িয়া, সরলা পাগলিনীকে বুঝাইয়া দিল যে জন্য বিনোদিনী বৈষ্ণবীর হুগলীর ফিরিঙ্গি মহলে এত পসার তাহা তাহার পুণ্যময় বংশে ঊর্দ্ধতন বা অধস্তন চতুর্দ্দশ পুরুষে হইবে না। প্রতিবেশিনী গর্জ্জন করিতে করিতে চলিয়া গেল; পাগলিনী আহত যুবককে লইয়া বসিয়া রহিল।
বহুক্ষণ পরে যুবক চক্ষু মেলিল, তখন পাগলিনী তাহার শিয়রে বসিয়া ব্যজন করিতেছিল। যুবক তাহাকে দেখিয়া কহিল, “ললিতা, তবে স্বপ্ন নহে?” পাগলিনী তাহার কথা বুঝিতে না পারিয়া বিস্মিতা হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। যুবক আবার কহিল, “তুমি এ বেশ কোথায় পাইলে ললিতা?”
একমাস পাগলিনীকে কেহ ললিতা বলিয়া সম্বোধন করে নাই। বহুদিন পরে নাম শুনিয়া ললিতার সম্মুখ হইতে যেন একটা ঘন আবরণ ধীরে ধীরে সরিয়া যাইতে লাগিল। নাম শুনিয়া তাহার মনে পড়িয়া গেল যে তাহারই এই নাম। পাগলিনী বা ললিত কহিল, “তুমি কি বলিতেছ আমি বুঝিতে পারিতেছি না।” যুবক জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি পেশোয়াজ ও ওড়না কোথায় ফেলিলে? তোমাকে বড় সুন্দর দেখাইতেছিল।” ললিতা বিস্মিত হইয়া বলিল, “তুমি কি বলিতেছ? সে কাহাকে বলে?” “তুমিত বজরায় পেশোয়াজ পরিয়া আসিয়াছিলে? তোমার হাতে সেতারে সিন্ধু, ভূপালী বড় মিষ্ট লাগিতেছিল। ললিতা, তুমি সেতার বাজাইতে শিখিলে কবে?” “আমিত সেতার বাজাইতে জানি না!” “বজরায় কেমন করিয়া বাজাইতেছিলে?” “বজ্রা? কোথায় বজ্রা?” “তবে কি সমস্তই স্বপ্ন?”
আহত যুবকের ক্ষীণ মানসিক শক্তি এই কঠিন সমস্যা পূরণ করিতে পারিল না। যুবক চক্ষু মুদ্রিত করিল; তাহার কর্ণে শত ভ্রমরগুঞ্জন শব্দ বাজিতে লাগিল, সে ক্রমে অচেতন হইয়া পড়িল। অর্দ্ধদণ্ড পরে যখন ময়ূখের চেতনা ফিরিল, তখনও ললিতা তাহার শিয়রে বসিয়া ব্যজন করিতেছিলেন। ময়ূখ চক্ষু মেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ললিতা, আমি কি ঘুমাইয়া ছিলাম?” ললিত কহিলেন, “হাঁ।” “কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম?” “প্রায় অর্দ্ধদণ্ড।” “ললিতা, আমরা কোথায় আসিয়াছি? এ কি ভীমেশ্বর না গৌরীপুর?”
ভীমেশ্বর! গৌরীপুর!! ললিতার স্মৃতিপটের সন্মুখ হইতে যবনিকা আরও কিঞ্চিৎ সরিয়া গেল। ভীমেশ্বর, গৌরীপুর, কলনাদিনী জাহ্নবী, জীর্ণ পুরাতন ঘাট, সর্ব্বনাশ। ফিরিঙ্গি, তাহার পরে কুয়াসা, ঘন অন্ধকার, তাহার পরে ললিতা আর কিছুই জানে না।
এই সময়ে বিনোদিনী বৈদ্য লইয়া ফিরিয়া আসিল। বৈদ্যকে দেখিয়া ললিতা অবগুণ্ঠন টানিয়া দিলেন। বৈষ্ণবী তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইল; কিন্তু কিছু বলিল না। বৈদ্য আসিয়া রোগীর নাড়ি টিপিল, প্রলেপ ও ঔষধের ব্যবস্থা করিল, এক আস্রফি দক্ষিণা লইয়া বিদায় হইল। তখন বৈষ্ণবী কহিল, “মা, হুগলী সহরের নেড়ে হকিম গুলা সব মরিয়াছে; সপ্তগ্রামের হাঙ্গামার ভয়ে হুগলী সহর ছাড়িয়া পলাইয়াছে; তাই একটা বৈদ্য ধরিয়া আনিলাম। কিন্তু পাগ্লী মা, আজ যে তুই বড় মাথায় কাপড় দিয়াছিস?”
হৃদয়ের উদ্বেগ আর বাধা মানিল না; মৃণালকোমল ভুজযুগলে আশ্রয়দাতৃর কণ্ঠালিঙ্গন করিয়া রোদন করিতে করিতে ললিতা কহিলেন, “মা, তুই কে মা? আমি কোথায় আসিয়াছি? এতদিনে আমার চোখের সম্মুখ হইতে পর্দা সরিয়া গিয়াছে; আমি গৌরীপুরের রাধামোহন গোস্বামীর কন্যা, ভীমেশ্বরের ঘাট হইতে হার্ম্মাদে আমাকে ধরিয়া আনিয়াছিল; আমি কোথায় আসিয়াছি মা?”
বৈষ্ণবী তাহার কথা শুনিয়া শিরে করাঘাত করিয়া বসিয়া পড়িল।
১২. রোমক স্বর্গের পথ
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
রোমক স্বর্গের পথ