বজ্রা হুগ্লীর দুর্গের সম্মুখে পৌঁছিলে, ছিপ্ হইতে একটি হাউই ছুটিল; তাহা আকাশে উঠিলে, তাহা হইতে একটি নীল একটি লাল ও একটি শ্বেত তারকা ফুটিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ দুর্গ হইতে আর একটি হাউই উঠিল, তাহা হইতেও ঐরূপ তিনটি তারা ফুটিয়া উঠিল। বজরা আবার চলিতে আরম্ভ করিল। দুর্গের সম্মুখে সেই উত্তরদেশীয় নৌকাখানি দাঁড়াইয়াছিল, বজরা দেখিয়া সেই ব্রাহ্মণ নৌকার কর্ণধারকে কহিলেন, “ভুবন, এত সেই বজ্রা, সপ্তগ্রামে না গিয়া হুগ্লীতে আসিল কেন? নিশ্চয়ই ফিরিঙ্গি হার্ম্মাদের নিকট বন্দী হইয়াছে।” ভুবন কহিল, “ঠাকুর, পথে ত ফিরিঙ্গির ছিপ্ বা কোশা দেখিতে পাইলাম না?” “হয়ত অন্ধকারে লুকাইয়া গিয়াছে। ভুবন বজরা মার।”
“সহসা ষাটজন বলিষ্ঠ ধীবর একসঙ্গে দাঁড় ফেলিল,.নৌকার আরোহিগণ একলম্ফে বজ্রার উপরে গিয়া পড়িল। ফিরিঙ্গিগণ সতর্ক ছিল না; তাহারা অনায়াসে বন্দী হইল। তখন ভুবন উচ্চৈঃস্বরে কহিল, “বজ্রার মুখ ফিরাইয়া দে, সপ্তগ্রামে যাইবে।” তাহার কণ্ঠস্বর শুনিয়া বজ্রার অভ্যস্তর হইতে সেই আহত যুবক ডাকিল, “ভুবন?” সে স্বর শ্রবণ করিয়া ভুবনের সমস্ত দেহ কম্পিত হইল, সে আবেগরুদ্ধকণ্ঠে উত্ত দিল, “মহারাজ, যাই।”
সহসা দুর্গের উপরে বিশাল অগ্নিকুণ্ড জ্বলিয়া উঠিল, তীব্র আলোকে নদীবক্ষ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, ভীষণ শব্দে দুই তিনটি তোপ গর্জ্জিয়া উঠিল। আলোক নিবিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে বজরা ও নৌকা গঙ্গাগর্ভে নিমগ্ন হইল। তখন চারিদিক হইতে পাঁচ সাত খানি ছিপ্ আসিয়া আরোহী ও নাবিকগণকে বন্দী করিল।
১১. বিনোদিনী বৈষ্ণবী
একাদশ পরিচ্ছেদ
বিনোদিনী বৈষ্ণবী
হুগলী দুর্গের পার্শ্বে গোময়লিপ্ত একখানি ক্ষুদ্র সুন্দর কুটীর ছিল, তাহাতে প্রায় বিগতযৌবনা এক বৈষ্ণবী বাস করিত। বৈষ্ণবী যৌবনে সুন্দরী ছিল, সে সৌন্দর্য্য সে এখনও বাঁধিয়া রাখিবার চেষ্টা করে। লোকে বলিত সে বৈষ্ণবী ব্রাহ্মণের কন্যা, ফিরিঙ্গিরা তাহাকে দূরদেশ হইতে ধরিয়া আনিয়াছিল। একজন ফিরিঙ্গি সেনানায়ক তাহার যৌবনলাবণ্যে মুগ্ধ হইয় তাহাকে স্বীয় অঙ্কশায়িনী করিয়াছিলেন। ফিরিঙ্গি স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিলে, সে দুর্গের বাহিরে আসিয়া বাস করিয়াছিল। তাহার যৌবন গতপ্রায় হইলেও, হুগলীর ফিরিঙ্গি মহলে তাহার যথেষ্ট পসার ছিল; সেইজন্য হুগলীর হিন্দুজাতীয় আবালবৃদ্ধবনিতা তাহাকে যমের ন্যায় ভয় করিত। লোকে বলিত যে বিনোদিনী বৈষ্ণবী হুগলী কেল্লার বাহিরে ফিরিঙ্গি কেল্লার ফৌজ্দার।
প্রভাতে বৈষ্ণবী তাহার গৃহের অঙ্গনে তুলসীমঞ্চের সম্মুখে বসিয়া জপ করিতেছিল; তাহার চারিদিকে তিন চারিটি বিড়াল বসিয়াছিল; কুটীরদ্বারে একটা বিলাতী কুকুর নিজগাত্র লেহন করিতেছিল। এমন সময়ে শিশিরস্নাত মল্লিকার ন্যায় একটি সুন্দরী যুবতী স্নান করিয়া আর্দ্রবস্ত্রে গৃহে প্রবেশ করিল। তাহাকে দেখিয়া বৈষ্ণবী মালা রাখিয়া কহিল, “আসিলি মা? এত কি বিলম্ব করিতে হয়? তোর জন্য আমার একদণ্ডও শান্তি নাই। মাথার কাপড়টাও টানিয়া দিস্ নাই?” যুবতী অবগুণ্ঠনশূন্যা, কিশোরীর ন্যায় তাহার বস্ত্রাঞ্চল কটিদেশে আবদ্ধ; যুবতী লজ্জাশূন্যা; তাহার ন্যায় রূপসী ষোড়শীর এমন লজ্জাহীনতা বঙ্গদেশে তখনও দেখা যাইত না। যুবতী হাসিয়া কহিল, “মাথায় কেন কাপড় দিব মা?” বৈষ্ণবী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিল “তোকে কি বুঝাইব মা? তুই যে পাগল হইয়াছিস্ ভালই হইয়াছে, নহিলে এই রূপের ডালি লইয়া হার্ম্মাদের সহরে তোর অশেষ দুর্গতি হইত। তুই যা, কাপড় ছাড়িয়া ফুল তুলিতে যা।” যুবতী উন্মাদিনী, তাহার কলহাস্য ক্ষুদ্র কুটীর মুখরিত করিল; সে জিজ্ঞাসা করিল, “কেন মা? আমার রূপ কোথা হইতে আসিল? আমি কেন পাগল হইলাম?” বৈষ্ণবী পুনরায় দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “যিনি তোকে দয়া করিয়া পাগল করিয়াছেন তিনিই তোকে এই দেবদুর্লভ রূপরাশি দিয়াছিলেন। কথায় কাজ নাই, অামার জপ শেষ হয় নাই, তুই ফুল তুলিতে যা।”
যুবতী কুটীরমধ্যে প্রবেশ করিল, ও মুহূর্ত্তমধ্যে একখানি গৈরিকরঞ্জিত বস্ত্র পরিয়া ফুলের সাজি লইয়া চলিয়া গেল। বিনোদিনী পুনরায় তুলসীমঞ্চের সম্মুখে জপ করিতে বসিল। অর্দ্ধদণ্ড পরে পাগলিনী দূর হইতে মা মা রবে চীৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল, বৈষ্ণবী আবার উঠিয়া দাঁড়াইল। দূর হইতে পাগলিনীর কাতর আহ্বান শুনা যাইতেছিল, বিনোদিনীর মুখ শুকাইয়া গেল। পাগলিনী ছুটিয়া আসিয়া বৈষ্ণবীর কণ্ঠলগ্না হইল, সঙ্গে সঙ্গে পল্লীর স্ত্রী পুরুষে ক্ষুদ্র অঙ্গন ভরিয়া গেল। বিনোদিনী বৈষ্ণবীর পালিতা কন্যা বলিয়া অনেকে তাহাকে চিনিত; তাহারা বিনোদিনীকে ভয় করিত, কিন্তু সে পাগল বলিয়া, তাহাকে ভালবাসিত। পাগলিনী বৈষ্ণবীর বুকে মুখ লুকাইয়া ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল; কিন্তু তাহার প্রতি চারিদিক হইতে যে অজস্র প্রশ্নবাণ বর্ষিত হইতেছিল সে তাহার উত্তর দিল না।
অনেকক্ষণ পরে বিনোদিনী তাহাকে ঘরে লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে মা? কাঁদিলে কেন?” পাগলিনী আবার কাঁদিয়া উঠিল, কিন্তু এইবার সে কথা কহিল। সে বলিল, “মা, সে আসিয়াছে।” বৈষ্ণবী সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “কে আসিয়াছে মা?” “সেই যে, সে।” “সে কে, সে তোমার কে হয়?” “তাহা জানি না, কিন্তু তাহাকে চিনি, সেই সে।” “তাহাকে কোথায় দেখিলে? সে কোথায়?” “গঙ্গার ধারে ঘাসের উপরে শুইয়া আছে।” “তাহাকে ডাকিয়া আনিলি না কেন মা?” “কত ডাকিলাম, সেত উঠিল না মা।” “তাহার নাম কি?” “তাহা মনে নাই।” “তাহার নিবাস কোথায়?” “কেন আমাদের গ্রামে?” “কোন্ গ্রামে?” “তাহা মনে নাই, সেও গঙ্গার ধারে।” “চল দেখি, তাহাকে দেখিয়া আসি।”