এই সময়ে কক্ষের দ্বারের পরদা অপসারিত হইল, পূর্ব্ব রাত্রির বৃদ্ধ দ্বারে দাঁড়াইয়া কহিলেন, “মা, হকিম আসিয়াছেন।”
যুবতী শয্যাপার্শ্ব ত্যাগ করিয়া কহিল, “হকিমকে লইয়া আসুন, আমি কক্ষেই থাকিব।” বৃদ্ধ হকিমকে লইয়া কক্ষে প্রবেশ করিলেন, হকিম রোগীকে পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, “আঘাত গুরুতর, তবে যুবা বয়স, সম্ভবতঃ আরোগ্য হইবেন। ইনি কোথায় আহত হইলেন?” বৃদ্ধ কহিলেন, “কল্য রাত্রির যুদ্ধে।” “ইনি কি বাদশাহী ফৌজের সেনা?” “হাঁ।” “শুনিয়াছি গোকুলবিহারীর একজন নায়ক বড় ভারি লড়াই করিয়াছে। আসদ্ খাঁ বলিতেছিলেন যে তাহার জন্যই সপ্তগ্রাম রক্ষা হইয়াছে।” “সে কি কাফের না মুসলমান?” “সে যুবা কাফের; হতভাগ্য হয় নিহত হইয়াছে, না হয় বন্দী হইয়াছে।” “ফিরিঙ্গির হস্তে বন্দী হওয়া অপেক্ষ মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়ঃ।” “খোদা মালিক নুরউদ্দীন জহাঙ্গীর বাদশাহের রাজ্যে এ অত্যাচার অসহ্য। একটা প্রলেপ পাঠাইয়া দিব তাহা ক্ষতস্থানে লেপন করিবেন; দুই প্রকার ঔষধ আসিবে, তাহা প্রতি প্রহরে সেব্য।” “রোগী বড়ই অস্থির, চাঞ্চল্য বাড়িলে ক্ষতস্থান হইতে রক্তস্রাব হয়।” একটা জাফ্রাণ বর্ণের চূর্ণ পাঠাইয়া দিব, অস্থির হইলে তাহা সরবতের সহিত মিশ্রিত করিয়া সেবন করাইয়া দিবেন।”
হকিম প্রস্থান করিলেন। বৃদ্ধ ফিরিয়া আসিয়া যুবতীর হস্তে একটা কৌটা দিয়া কহিলেন, “মা, তোমার স্বামী অস্থির হইলে এই ঔষধের একমাত্রা সরবতের সহিত মিশাইয়া সেবন করাইও।” বৃদ্ধ কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। যুবক এতক্ষণ নীরব ছিল, এইবার সে যুবতীকে ডাকিয়া কহিল, “ললিতা বৈদ্য দাড়ি রাখিল কবে? ব্রজনাথ সেন ত বৈষ্ণব, সে ত গোঁফ, দাড়ি,চুল সমস্তই কামাইয়া ফেলিত?” “বৈদ্য হইবে কেন? ইনি সপ্তগ্রামের প্রসিদ্ধ হাকিম, আশ্রফ্ আলী খাঁ।” যুবক হাসিল, কহিল, “তুমি কি সপ্তগ্রামের স্বপ্ন দেখিতেছ?”
“স্বপ্ন কেন? এ ত সত্য সত্যই সপ্তগ্রাম?” যুবক বিরক্তি প্রকাশ করিয়া কহিল, “হয় তুমি পাগল হইয়াছ ললিতা, নয় আমি পাগল হইয়াছি। এ সপ্তগ্রাম নহে ভীমেশ্বর, তুমি ললিতা আমি ময়ূখ। সন্ধ্যা হইয়াছে, চল তোমাকে গৃহে লইয়া যাই, রাধিকা দিদি কোথায় গেল?”
যুবক পুনরায় শয্যা ত্যাগ করিবার উপক্রম করিল, যুবতী তাহাকে বাহু পাশে আবদ্ধ করিয়া বহু কষ্টে নিবারণ করিল। তখন ফতেমা হকিমপ্রদত্ত ঔষধ সরবতের সহিত মিশ্রিত করিয়া লইয়া আসিল, যুবতীর হস্ত হইতে যুবক তাহা পান করিল ও তৎক্ষণাৎ নিদ্রিত হইয়া পড়িল।
যুবতী ধীরে ধীরে শয্যাপার্শ্ব হইতে উঠিয়া পার্শ্বে কক্ষে প্রবেশ করিল, সেই স্থানে এক বৃদ্ধ দুগ্ধফেননিভ শয্যার উপরে বসিয়া পত্র লিখিতেছিলেন, তিনি যুবতীকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কি হইয়াছে মা?” যুবতী কহিল, “কিছু নয়। আপনি কাহাকে পত্র লিখিতেছেন?” “আসদ্ খাঁকে। পুত্রকে লইয়া দিল্লী যাইব, ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ পলায়ন করিয়াছে। অাসদ্ খাঁর অনুমতি লইয়া পুত্রের সহিত দিল্লীতে ফিরিব, সেইজন্য অদ্য রাত্রিতে তাঁহাকে বজরায় আসিতে লিখিলাম।”;
বৃদ্ধের কথা শুনিয়া যুবতী প্রমাদ গণিল; সে ভাবিল যে যুবক যখন সৈনিক তখন সে নিশ্চয়ই আসদ্ খাঁর পরিচিত। আসদ্ খাঁ আসিলে বৃদ্ধের নিকট সমস্তই প্রকাশিত হইয়া পড়িবে। গুলরুখ্ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “পিতা, অদ্য আসদ্ খাঁকে পত্র লিখিয়া কাজ নাই, উনি মুক্ত বায়ুর জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন চলুন, বজ্রায় অল্পদূরে ভ্রমণ করিয়া আসি।” “চল।”
মাল্লারা বজরা ছাড়িয়া দিল, বজরা দক্ষিণদিকে চলিল। তখন সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছে, ঘন কুজ্ঝটিকায় গঙ্গাবক্ষ আচ্ছন্ন। গঙ্গাবক্ষ শূন্য, ফিরিঙ্গির ভয়ে একখানিও নৌকা সপ্তগ্রাম ত্যাগ করে নাই। সহসা বজরার পশ্চাতে বহু তরণ্ডের শব্দ শ্রুত হইল। বজরার মাঝি বৃদ্ধকে জানাইল যে পশ্চাতে একখানি বড় নৌকা দ্রুতবেগে আসিতেছে। বজরার মুখ ফিরিল, দেখিতে দেখিতে একখানি বৃহৎ নৌকা আসিয়া পড়িল। নৌকাখানি ছিপ্ নহে, পশ্চিমবঙ্গে পারাপারের জন্য যেরূপ বৃহৎ নৌকা ব্যবহৃত হইয়া থাকে ইহা সেইরূপ একখানি নৌকা। নৌকা বজরার পার্শ্বে আসিয়া পৌঁছিলে, বৃদ্ধ দেখিলেন যে তাহাতে পঞ্চাশ ষাটজন অস্ত্রধারী পুরুষ দাঁড় টানিতেছে, মাঝির পার্শ্বে একজন শুভ্রবসনপরিহিত বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ দাঁড়াইয়া আছেন। বৃদ্ধ নৌকা দেখিয়া বিম্মিত হইলেন এবং বজরার মাঝিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মাঝি, এ কোথাকার নৌকা?” মাঝি পূর্ব্ববঙ্গের অধিবাসী, সে কহিল, “হুজুর, মুই কতি পারিনে, উত্তরের নাও হবে।”
এই সময়ে নৌকা আসিয়া বজরার পার্শ্বে দাঁড়াইল; সেই ব্রাহ্মণ বৃদ্ধকে কহিলেন, “মহাশয়, আপনি বজরা লইয়া কোথায় যাইতেছেন?” বৃদ্ধ কহিলেন, “আমি সপ্তগ্রাম হইতে জলপথে ভ্রমণ করিতে আসিয়াছি, সপ্তগ্রামে ফিরিয়া যাইব।”
“তবে শীঘ্র ফিরিয়া যাউন, আমিও সপ্তগ্রাম হইতে আসিতেছি। বন্দরে শুনিলাম যে, সন্ধ্যার পরে ফিরিঙ্গিদের সমস্ত ছিপ্ নৌকা লুঠিতে বাহির হইবে।”
“কাফের, তোমরা কোথায় যাইতেছ?” “হুগ্লীর বন্দরে।” “ফিরিঙ্গিরা কি তোমাদের ছাড়িয়া দিবে?” “আমরা ইচ্ছা করিয়া ফিরিঙ্গির হাতে ধন দিতে যাইতেছি।” নৌকা ছাড়িয়া দিল। বজ্রা সপ্তগ্রামের দিকে ফিরিল; তখন সন্ধ্যা হইয়াছে, কিন্তু গঙ্গাতীরে কোন গ্রামে দীপ জ্বলে নাই। গঙ্গাবক্ষ শূন্য, নিস্তব্ধ, কুয়াসায় আচ্ছন্ন। তখন সমুদ্রের জলরাশি জোয়ারের বেগে নদীতে প্রবেশ করিয়া আবার ফিরিয়া চলিয়াছে। ভীষণ স্রোতের বিপরীতে বৃহৎ বজ্রা অতি ধীরে ধীরে চলিতেছিল। সহসা অন্ধকার ভেদ করিয়া একখানি বৃহৎ ছিপ্ বজ্রার পার্শ্বে আসিয়া লাগিল, বন্দুক হস্তে চারি পাঁচজন ফিরিঙ্গি বজ্রায় উঠিল এবং নাবিকদিগকে বাঁধিয়া ফেলিল; নৌকার সমস্ত আরোহী বন্দী হইল, বজ্রা হুগলীর দিকে চলিল।