ব্রাহ্মণের ক্রোধ অধিকক্ষণ থাকে না। ব্রাহ্মণ প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, “বাবাজী, তুমি কি পাগল হইয়াছ, খ্রীষ্টানে কখন নরবলি দেয়?” বলি শুনিয়া বৈরাগী থুতু ফেলিতে যাইতেছিল, বহু কষ্টে আত্মসম্বরণ করিল। এই সময়ে সাত আটজন লাঠিয়াল আসিয়া ব্রাহ্মণকে প্রণাম করিল। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃদ্ধ কহিল, “ঠাকুর মহাশয়, কোন সংবাদই পাইলাম না। সারা সহর তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াছি, যত লোক মরিয়াছে অথবা জখম হইয়াছে তাহাদিগের সকলকেই দেখিয়া আসিয়াছি। মহারাজকে ত কোথাও দেখিলাম না।” ব্রাহ্মণ সংবাদ শ্রবণে চিন্তিত হইয়া কহিলেন, “তাই ত ভুবন, আমি ভারিয়াছিলাম এইবার সন্ধান পাইব। নৌকা কোথায় আছে?” “নিকটেই বাদশাহী পুলের নীচে।” “তোমাদের আহার হইয়াছে?”
তখন দিবা দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইয়াছে, ব্রাহ্মণের তখনও স্নানাহার হয় নাই। ভুবন তাঁহার মুখ দেখিয়া তাহা বুঝিতে পারিল এবং কহিল, “খাইব কি ঠাকুর মহাশয়? সকাল হইতে ত ঘুরিয়াই বেড়াইতেছি। চলুন নৌকায় ফিরিয়া যাই।”
বৈরাগী নৌকার কথা শুনিয়া সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল, “ঠাকুর মহাশয়ের কি নৌকা আছে? তাহা হইলে ত হুগলীতে যাইতে পারা যায়?” ব্রাহ্মণ হাসিয়া কহিলেন, “যায় বই কি, বাবাজী, তুমি আমাদিগের সহিত আইস, আমরা অপরাহ্নে হুগলী যাইব।” বাবাজী সানন্দে কহিল, “গৌরহরি, গৌরহরি; ঠাকুর মহাশয়, হুগলীতে আমার শিষ্যবাড়ী পায়ের ধূলা দিতে হইবে।” ব্রাহ্মণ জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার শিষ্য কি জাতি?” “আজ্ঞা, তন্ত্রবায়।” “বাবাজী, তোমার মঙ্গল হউক, আমি শূদ্রের গৃহে অন্ন গ্রহণ করিব কি প্রকারে?” “ফলাহার করিবেন; উত্তম চিড়া, ঘন ক্ষীর, বাথানের দধি, মর্ত্তমান রম্ভা এবং গোল্লা।”
বৈরাগীর সৃক্কণী বহিয়া লালা গড়াইয়া পড়িল; ব্রাহ্মণ তাহা দেখিয়া আর হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না, তিনি মন খুলিয়া হাসিয়া উঠিলেন। বৈরাগীর শিষ্য পার্শ্বে দাঁড়াইয়াছিল, সে ঘন ঘন সৃক্কণী লেহন করিতেছে দেখিয়া, ব্রাহ্মণ কহিলেন, “আমরা শূদ্রগৃহে ফলাহারও করি না। বাবাজী, তোমাদিগের বোধ হয় আহার হয় নাই?” “আজ্ঞা না।” “ভাল, অদ্য তোমরা আমার অতিথি।” “ঠাকুর মহাশয়ের অন্ন প্রসাদ পাইব না ফলাহার করিব?” “এবেলা অন্ন প্রসাদ পাইবে ওবেলায় ফলাহার করিও। ভুবন, মহারাজ হয় ত ফিরিঙ্গির হাতে বন্দী হইয়াছেন, আমরা আহারান্তে নৌকা লইয়া হুগলী যাইব, তুমি নৌকায় পাকের উদ্যোগ কর।” “যে আজ্ঞা।”
সকলে ভুবনের নৌকায় আরোহণ করিলেন।
১০. ত্রিবেণীতে মুকুন্দদেবের ঘাটের অনতিদূরে
দশম পরিচ্ছেদ
সেই দিন অপরাহ্নে ত্রিবেণীতে মুকুন্দদেবের ঘাটের অনতিদূরে একখানি বৃহৎ বজরা হইতে মধুর সঙ্গীতধ্বনি উখিত হইতেছিল; মধ্যে মধ্যে সঙ্গীতের পরিবর্ত্তে সেতারের মিঠা আওয়াজ শুনা যাইতেছিল। তীরে গীত বাদ্য শুনিবার জন্য লোক জমিয়া গিয়াছিল। বজ্রার মধ্যে একটি প্রশস্ত কক্ষে গালিচার উপরে বসিয়া একটি যুবতী সেতার বাজাইতেছিল, তাহার পার্শ্বে বসিয়া আর একটি যুবতী সঙ্গীত করিতেছিল, কক্ষের প্রান্তে একখানি ক্ষুদ্র হস্তিদন্তের খট্টায় একজন গৌরবর্ণ যুবক শয়ন করিয়াছিল। যুবক চেতনাহীন, তাহার সর্ব্বাঙ্গে ক্ষত চিহ্ন। ক্ষত স্থান সমূহ বহু বস্ত্র খণ্ডে আবদ্ধ, তাহা স্থানে স্থানে রক্তাক্ত। কিয়ৎক্ষণ পরে যুবক অস্ফুট স্বরে কি কহিল। তাহা শুনিয়া যুবতী সেতার রাখিল এবং শয্যাপার্শ্বে গিয়া দাঁড়াইল।
যুবক চক্ষুরুন্মীলন করিল এবং যুবতীকে দেখিয়া কহিল, “কে? ললিতা? কখন আসিলে?” যুবতী শয্যাপার্শ্বে উপবেশন করিয়া উভয় করে যুবকের দক্ষিণ হস্ত গ্রহণ করিল এবং জিজ্ঞাসা করিল, “কি বলিতেছ? আমাকে কি চিনিতে পারিতেছ না?” যুবকের অধরে হাস্যের ক্ষীণরেখা দেখা দিল, যুবক কহিল, “কেন পারিব না?”
“বল দেখি আমি কে?” “তুমি ললিতা।” “ললিতা কে? আমি যে গুলরুখ্।” “মিথ্যা কথা, তুমি ললিতা, এ ভীমেশ্বর। ললিতা, তুমি কখন আসিলে? আমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।”
“তুমি কি বলিতেছ? এ যে সপ্তগ্রাম, সরস্বতী গঙ্গার মোহানায় আমাদের বজ্রা লাগিয়াছে। আমি গুল্রুখ, তুমি কি এখনও আমাকে চিনিতে পার নাই?” “চিনিয়াছি। ললিতা, তুমি বুঝি একটা নূতন মুসলমানী নাম শিখিয়াছ?” “অধিক কথা কহিও না। তোমার এখনও জ্ঞান হয় নাই।” “ললিতে, এ আবার কি ছলনা? সন্ধ্যাবেলায় গোপালের মন্দিরে আরতি দেখিতে যাইব বলিয়াছিলাম, চল যাই।”
যুবক শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করিল, তাহা দেখিয়া যুবতী তাহাকে বলপূর্ব্বক চাপিয়া ধরিল এবং কহিল, “উঠিওনা, উঠিওনা, এখনই ক্ষতমুখে রক্তস্রাব আরম্ভ হইবে।” যুবক মুখ বিকৃত করিয়া কহিল, “বড় বেদনা, উঠিতে পারিলাম না, আমার কি হইয়াছিল ললিতা?” “ললিতা কে?” “তুমি কি ললিতা নহ?” “আমি যে গুলরুখ্; জীবনসর্ব্বস্ব, তুমি আমায় চিনিতে পারিতেছ না কেন?” “চিনিতে পারিব না কেন, তুমি নিশ্চয় ললিতা।” “তবে অামি ললিতা।” “এতক্ষণ দুষ্টামি করিতেছিলে কেন? ললিতা, আমার সর্ব্বাঙ্গে বেদনা কেন?” “তুমি যে যুদ্ধে আহত হইয়াছ ” “যুদ্ধ? কোথায় যুদ্ধ?” “কেন সপ্তগ্রামের যুদ্ধ?” “সপ্তগ্রাম? আমি কি ভীমেশ্বরে নাই? তবে কি স্বপ্ন সত্য?”