নায়কের অাদেশে বন্দিগণ মুক্ত হইল, সপ্তগ্রামবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা পর্ত্তুগীজ নৌসেনাধ্যক্ষ ডি মুজাকে আশীর্ব্বাদ করিতে করিতে যে যেদিকে পথ পাইল পলাইল। ফিরিঙ্গি সেনা শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিয়া গেল; বৃদ্ধ ওমরাহ, তাঁহার পুত্রবধূ, ফতেমা ও যুবতী দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, এখন কোথায় যাইবে?” যুবতী কহিল, “নিকটেই আমার গৃহ, সেইখানেই যাইব।” “সেখানে তোমার কে আছে?” “কেহই নাই। সেই বৃদ্ধ ভৃত্য যদি না মরিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে সেই আছে।” “চল তাহাকে দেখিয়া আসি।”
বৃদ্ধ রমণীগণকে লইয়া যুবতীর গৃহে প্রবেশ করিলেন। হবিব্, মূর্চ্ছিত হইয়াছিল, ফতেমা ও যুবতীর শুশ্রূষায় তাহার চেতনা ফিরিয়া আসিল। তখন বৃদ্ধ কহিলেন, “মা, অদ্য রজনীতে নগর নিরাপদ নহে, চল সপ্তগ্রাম ছাড়িয়া অন্যত্র আশ্রয় লই।” যুবতী কহিল, “ত্রিবেণীর ঘাটে আমার বজরা আছে।” বৃদ্ধ কহিলেন, “চল ত্রিবেণীতেই যাই।” গৃহ পরিত্যাগ করিয়া সকলে পুর্ব্বদিকে যাত্রা করিলেন।
কিয়দ্দুর গিয়া বৃদ্ধ এক প্রশস্ত রাজপথে উপস্থিত হইলেন। পথের চারিদিকে স্তূপীকৃত মৃতদেহ পড়িয়াছিল, কামানের গোলায় চারিদিকে আগুন লাগিয়া গিয়াছিল, বৃদ্ধ সেই স্থানে দাঁড়াইয়া পথ নিরূপণের চেষ্টা করিতেছিলেন। যুবতী সহসা আর্ত্তনাদ করিয়া এক হিন্দু সৈনিকের দেহের উপরে পতিত হইল। বৃদ্ধ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মা, এ তোমার কে?” যুবতী রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “আমার খসম্।” ফতেমা বিস্মিতা হইয়া যুবতীর মুখের দিকে চাহিল, তাহা দেখিয়া যুবতী পুনরায় কহিল, “আমার খসম্ রাগ করিয়া আমায় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন।” বৃদ্ধ পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিল, “মা, তুমি যে বলিয়াছিলে, তোমাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই?” যুবতী ময়ূখের উপরে মুখ দিয়া অম্লান বদনে মিথ্যা কহিল, সে কহিল, “আমার খসম্ যে সপ্তগ্রামে ছিলেন তাহা আমি জানিতাম না।” বৃদ্ধ পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন যে, যুবকের প্রাণবায়ু তখনও নির্গত হয় নাই। তিনি ও হবিব্ আহত যুবককে বহন করিয়া লইয়া ত্রিবেণীর দিকে যাত্রা করিলেন।
০৮. ঘূর্ণ বাত্যা
অষ্টম পরিচ্ছেদ
ঘূর্ণ বাত্যা
জহাঙ্গীর নগরের দুর্গমধ্যে নদীতীরের একটি কক্ষে বসিয়া বাঙ্গালার সুবাদার মোকরম্ খাঁ বিশ্রাম করিতেছিলেন। ভীষণ গ্রীষ্ম, একজন বাঁদী নবাবের পদসেবা করিতেছিল, দুই জন ময়ূরপুচ্ছ লইয়া ব্যজন করিতেছিল, এবং চতুর্থা সুশীতল পানীয় লইয়। কক্ষের কোণে দাঁড়াইয়াছিল। এই সময়ে একজন খোজা কক্ষের দুয়ারে দাঁড়াইয়া নবাবকে অভিবাদন করিল। নবাবের নিদ্রাকর্ষণ হইতেছিল, তিনি বিরক্ত হইয়া আলস্যবিজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি চাহ?” খোজা পুনর্ব্বার অভিবাদন করিয়া কহিল, “বন্দানওয়াজ, দেওয়ান হরেকিযণ সদরে অপেক্ষা করিতেছেন।” “হরেকিষণ অসময়ে কেন আসিল?” “বন্দা তাহাকে জানাইয়াছিল, যে সুবাদার এখন খোয়াবগাহে, কিন্তু দেওয়ান সাহেব বলিলেন, যে বাদশাহের দরবার হইতে জরুরী পাঞ্জা লইয়া একজন সওয়ার আসিয়াছে।”
নবাব বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “হরেকিষণকে গোসলখানায় অপেক্ষা করিতে বল, আমি আসিতেছি।” খোজা পুনরায় অভিবাদন করিয়া প্রস্থান করিল। ‘
সদরখালিসার দেওয়ান হরেকৃষ্ণ রায়, বঙ্গজ কায়স্থ, খর্ব্বাকৃতি, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। তিনি বুদ্ধিবলে সামান্য অবস্থা হইতে উন্নত হইয়া এই উচ্চপদ লাভ করিয়াছিলেন। তখন সামান্যবংশজাত হিন্দুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা উচ্চতর রাজপদ লাভ করা প্রায় সম্ভব হইত না। বাদশাহের সওয়ার তখনও দেওয়ানখানায় অপেক্ষা করিতেছিল, সেই জন্য হরেকৃষ্ণ অধীর হইয়া ইতস্ততঃ পাদচারণ করিতেছিলেন। বাদশাহের পত্র অথবা ফর্ম্মাণ স্বয়ং সুবাদার ব্যতীত আর কেহ গ্রহণ করিতে পারিত ন। হঠাৎ তাঁহার সম্মুখে মনুষ্যের ছায়া পড়িল, দেওয়ান ভীত হইয়া দুইপদ পিছু হটিয়া গেলেন। তখন দেওয়ানখানার একটি স্তম্ভের অন্তরাল হইতে গুরুগম্ভীর স্বরে উচ্চারিত হইল, “হরেকৃষ্ণ, ভয় নাই।” দেওয়ান চাহিয়া দেখিলেন যে গৈরিকবসন-পরিহিত একজন দীর্ঘাকার সন্ন্যাসী স্তম্ভের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। হরেকৃষ্ণ ব্যস্ত হইয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রভু, সমস্ত কুশল ত?” “কুশল জিজ্ঞাসা পরে করিও, আমি বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকায় আসিয়াছি, তুমি আমাকে সুবাদারের সহিত পরিচিত করিয়া দাও।” “কি পরিচয় দিব? আপনার প্রকৃত পরিচয়?” “না, বলিও যে আমি তোমার গুরু।” “আপনি যে আমার গুরু সে কথা ত মিথ্যা নহে, সুমার ও খাজানার কার্য্য—” “ও সকল কথা থাক। আমার এক বন্ধুর কন্যাকে ফিরিঙ্গি হারমাদ্ হুগলীতে ধরিয়া লইয়া গিয়াছে, তুমি সুবাদারকে অনুরোধ করিয়া তাহার মুক্তির ব্যবস্থা করিয়া দাও।” “প্রভু, বড়ই কঠিন কার্য্য।” “তাহা আমি জানি।” “ফিরিঙ্গিগণ সুবাদারের বড়ই প্রিয় পাত্র।” “তাহাও আমি অবগত আছি।” “তবে কি উপায় করিব প্রভু?” “নবাবকে বল যে আমার অনুরোধ রক্ষা না করিলে একথা এক মাসের মধ্যে বাদশাহের কানে উঠিবে।” “বলেন কি? এমন কাজ কে করিবে?” “নুরজাহান বেগম অথবা আসক্ খাঁ।” “প্রভু, আপনার অসাধ্য কার্য্য নাই।” “হরেকৃষ্ণ, আমার আর একটি অনুরোধ আছে।” “কি আদেশ প্রভু?” “অদ্য নবাবের বজরায় পদার্পণ করিও না, করিলে বিপদে পড়িবে।” “যে আজ্ঞা।”