তখন বিলাতে পিস্তলের ব্যবহার অল্পদিন আরম্ভ হইয়াছে, একটি দুইটি মাত্র হিন্দুস্থানে আসিয়াছে। পিস্তলের আওয়াজ হইল, একজন ফিরিঙ্গি আহত হইয়া পড়িয়া গেল; তাহা দেখিয়া পাদ্রী ও দ্বিতীয় ফিরিঙ্গি দূরে আর এক বৃক্ষকাণ্ডের পার্শ্বে আশ্রয় লইল। ময়ূখ ছুটিয়া বাহির হইয়া আহত ফিরিঙ্গির বন্দুক কাড়িয়া লইয়া পুনরায় বৃক্ষতলে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ফিরিয়া আসিবার সময়ে দ্বিতীয় ফিরিঙ্গির বন্দুকের আর একটী গুলি আসিয়া তাঁহার বামহস্তে বিদ্ধ হইল। ময়ূখ তাহা গ্রাহ্য না করিয়া মুসলমানকে কহিলেন, “আপনার বন্দুক ধরা অভ্যাস আছে?” মুসলমান হাসিয়া কহিল, “আছে, আমি যুদ্ধ ব্যবসায়ী।” মুসলমান বন্দুক হাতে লইয়া কহিল, “গুলি ও বারুদ কই?” ময়ূখ কহিলেন, “অপেক্ষা করুন লইয়া আসি।” মুসলমান তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করিয়া কহিল, “কাফের, তুমি আহত হইয়াছ, এই বার আমার পালা। ফিরিঙ্গি যদি মুখ বাড়ায় তাহা হইলে গুলি চালাইও। যদি আমি মরি তাহা হইলে ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁকে বলিও যে জহাঙ্গীরী আমলের একজন আমীর ফিরিঙ্গির হাতে মরিয়াছে।” মুসলমান উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া ছুটিয়া বাহির হইল; তাহা দেখিয়া ফিরিঙ্গি যেমন মুখ বাড়াইল অমনই ময়ূখের পিস্তলের গুলি তাহার ললাটে বিদ্ধ হইল। তখন হিন্দুর পরিত্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া স্থূলকায় লম্বোদর পাদ্রী হুগলীর দিকে পলায়ন করিল।
যুদ্ধ শেষ হইয়াছে দেখিয়া ময়ূখ বৃক্ষকাণ্ডের আশ্রয় পরিত্যাগ করিয়া মুসলমানকে কহিলেন, “সাহেব, এখন আপনি নিশ্চিন্ত মনে গমন করুন, আমি গৃহে চলিলাম।” মুসলমান বন্দুকে বারুদ ভরিতে ভরিতে কহিলেন, “কাফের, তুমি বীর, অদ্য তুমি আমার জীবন রক্ষা করিয়াছ; সুতরাং তুমি আমার দোস্ত। তোমাকে এখন ছাড়িব না, তুমি আমার সহিত কিল্লায় ফিরিয়া চল। তুমি ফিরিঙ্গির রক্তপাত করিয়াছ, সুবা বাঙ্গালা তোমার পক্ষে নিরাপদ স্থান নহে। তুমি কে? কোথা হইতে আসিতেছ?” “সাহেব, বিশেষ কারণে আপনাকে পরিচয় দিতে পারিব না। ফিরিঙ্গি আমার দুষমন্, তাহারা আমার এক আত্মীয়াকে হরণ করিয়া অনিয়াছে; আমি তাহারই উদ্ধারের চেষ্টায় সপ্তগ্রামে আসিয়াছি।”
“যুবক, আমি তোমার পিতার বয়সী, আমার নিকট সত্য গোপন করিয়া ভাল করিতেছ না। তুমি আমার জন্য ফিরিঙ্গি হত্যা করিয়াছ, সুবা বাঙ্গালায় বাস করিতে হইলে, তোমাকে আমার সহিত বাস করিতে হইবে। আমি বাদশাহী নাওয়ারার আমীর, আমার নাম আসদ্ খাঁ।”
যুবা বিম্মিত হইয়া আমীরের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন, এবং ক্ষণকাল পরে কহিলেন, “খাঁ সাহেব, আপনি আমার পিতৃবন্ধু, আপনার নিকট পরিচয় গোপন করিব না। আমার নাম ময়ূখ, পরগণা বারবক্ সিংহের ভূতপূর্ব্ব জমীদার মহারাজ দেবেন্দ্রনারায়ণ রায় আমার পিতা—”
“তুমি দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্র! সপ্তগ্রামে আসিয়াছ, আমাকে সংবাদ দাও নাই কেন? অনুপনারায়ণ খানাজাদ্ খাঁর আমলে বারবক সিংহ বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছে, তখন যদি তোমার তরফের কোন উকিল জহাঙ্গীর নগরে উপস্থিত থাকিত, তাহা হইলে তুমি তোমার পিতার জমীদারী পাইতে। তুমি এখন কি করিতেছ?” “সাহেব, শৈশবে মাতৃহারা হইয়াছি, আমার ভ্রাতা ভগিনী কেহই নাই। পিতার মৃত্যুর সময়ে আমার বয়স মাত্র চতুর্দ্দশ বৎসর ছিল, তখন খুড়া মহাশয় গোপনে বাদশাহের সনন্দ আনাইয়া সম্পত্তি দখল করিয়াছেন। পিতার মৃত্যুর পরে চারি বৎসর শাস্ত্র ও শস্ত্র শিক্ষা করিয়াছি, ভাবিতেছিলাম জীবিকা অর্জ্জন চেষ্টায় বাহির হইব, এমন সময়ে ফিরিঙ্গির সহিত বিবাদ বাধিল।”
ময়ূখ ললিতার হরণবৃত্তান্ত আমূল আসদ্ খাঁকে শুনাইলেন। ময়ূখ গোকুলবিহারীর আশ্রয় পাইয়াছেন শুনিয়া আসদ্ খাঁ সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “উত্তম করিয়াছ, গোকুলের ন্যায় পরাক্রান্ত হিন্দু সপ্তগ্রামে কেহ নাই। কিন্তু তুমি এখন একাকী মীনাবাজারে ফিরিতে পাইবে না। আমার সহিত কিল্লায় চল, সেখান হইতে সঙ্গে পাহারা দিয়া পাঠাইয়া দিব।”
ময়ূখ ও আসদ্ খাঁ কিল্লায় ফিরিলেন। ফৌজদার কলিমুল্লা খাঁ আহারান্তে অহিফেণ সেবন করিয়া ঝিমাইতেছিলেন; ময়ূখকে আসদ খাঁ লইয়া ফৌজদারের বারদুয়ারীতে প্রবেশ করিলেন। ভয় পাইয়া বুড়া ফৌজদার চৌকি হইতে পড়িতে পড়িতে বাঁচিয়া গেল। আসদ্ খাঁ প্রবেশ করিয়াই কহিলেন, “খাঁ সাহেব, এখনই একদল আহদী ও দশটা ভারি তোপ বন্দেলের পথে পাঠাইয়া দাও।” বুড়া আফিম্চী কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, “যো হুকুম খোদাবন্দ, কি হইয়াছে?”
“শাহনশাহ বাদশাহ দীন ও দুনিয়ার মালিক নূরুদ্দিন জহাঙ্গীর বাদশাহের রাজ্যে প্রকাশ্য পথে দিনের আলোকে ফিরিঙ্গি আমার উপরে গুলি চালাইয়াছে।” বৃদ্ধ ফৌজদার কাঁপিতে কাঁপিতে পড়িয়া গেল।
০৭. সপ্তগ্রামের যুদ্ধ
সপ্তম পরিচ্ছেদ
সপ্তগ্রামের যুদ্ধ
সন্ধ্যা আগত প্রায়, পশ্চিমে আম্রপণসের কুঞ্জে ভগবান্ মরীচিমালী আশ্রয় লাভ করিয়াছেন, বিশাল সপ্তগ্রাম নগরের অসংখ্য পথে সহস্র সহস্র দীপ জ্বলিয়া উঠিয়াছে। একটি প্রশস্ত রাজপথের পার্শ্বে দ্বিতল অট্টালিকার উপরে বারাণ্ডায় বসিয়া আমাদের পরিচিতা যুবতী সেতার বাজাইতেছিলেন, তাহার পার্শ্বে একখানি গালিচার উপরে বসিয়া ফতেমা চাঁদির বাটা লইয়া পান সাজিতেছিল এবং নাজীর আহমদ্ সঙ্গত করিতেছিল; বারাণ্ডার এক কোণে দাঁড়াইয়া বুড়া হবিব চাঁদির কলিকায় ফুঁ দিতেছিল। পুরবী কেদারা পুরিয়া ও গৌরী দুই তিন বার বাজিয়া গেল। অন্য দিন সপ্তগ্রাম সহরের মধ্যস্থলে প্রকাশ্য রাজপথে রূপসী যুবতীর সেতারের আওয়াজ শুনিলে লোক জমিয়া যাইত; কিন্তু আজি সপ্তগ্রামের পথে অসম্ভব জনতা, নগরের চারিদিক হইতে ভীষণ কোলাহল উত্থিত হইতেছে, সেতারের মিঠা আওয়াজ কাহারও কাণে পৌঁছিতেছে না। কোলাহল ক্রমশঃ বাড়িতে লাগিল, যুবতী বিরক্ত হইয়া সেতার রাখিল। এই সময়ে ভীষণ কোলাহল ভেদ করিয়া “ফিরিঙ্গি আসিল, ফিরিঙ্গি আসিল, বাজার লুটিবে” শব্দ উঠিল। দোকানদারগণ দোকানপাট বন্ধ করিতে আরম্ভ করিল। ফিরিঙ্গি আসিতেছে শুনিয়া যুবতী, ফতেমা ও নাজীর আহমদ্ উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল; সহসা নাজীর আহমদ বলিয়া উঠিল, “বিবি সাহেব, সর্ব্বনাশ হইয়াছে, আমার ত আফিম ফুরাইয়াছে, আমাকে এখনই একবার বাজারে যাইতে হইবে।” যুবতীর মুখ শুকাইয়া গেল, সে কহিল, “সে কি নাজীর? এই হাঙ্গামার মধ্যে আমাদের ফেলিয়া কোথায় যাইবে?” বুড়া হাতযোড় করিয়া কাতর কণ্ঠে কহিল, “দোহাই বিবি সাহেব, বুড়া মানুষ আফিম না পাইলে এখনই মরিয়া যাইব, দোকান পাট সব বন্ধ হইয়া গেল।” বুড়া বারাণ্ডার দুয়ারের দিকে অগ্রসর হইল, তাহা দেখিয়া যুবতী তাহার হাত ধরিল এবং কাতর কণ্ঠে কহিল, “নাজীর, এমন সময়ে আমাদের একা ফেলিয়া যাইও না।” সে শব্দ পাছে তাহার কর্ণে প্রবেশ করে সেই ভয়ে বৃদ্ধ কাণে আঙ্গুল দিয়া হাত ছাড়াইয়া পলাইল। তখন যুবতী হতাশ হইয়া বসিয়া পড়িল। নগরের কোলাহল বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, দেখিতে দেখিতে সপ্তগ্রামের অসংখ্য বিপণির সহস্র সহস্র দীপ নিবিয়া গেল। কিয়ৎক্ষণ নিঃশব্দে রোদন করিয়া যুবতী প্রৌঢ়াকে কহিল, “ফতেমা, এখন কি করিব? কোথায় যাইব? কি উপায় হইবে?” ফতেমা কপালে করাঘাত করিয়া কহিল, “উপায় খোদার হাতে। তুমি কথা শুনিতে চাহ না, সপ্তগ্রামে না থাকিয়া আজি যদি জাহাঙ্গীর নগরে যাইতে তাহা হইলে কি এ বিপদে পড়িতে?”