—————-
(৭) V. Ball–Stone implements found in Bengal, Proceedings of the Asiatic Society of Bengal, 1865, PP.127-28.
(৮) Ibid, 1887, p.143; Catalogue Rainsonne of the Pre-historic Antiquities in the Indian Museum by J. Goggin Brown, M. Sc. F.G.S. p.86
(৯) Proceeding of the Royal Irish Academy, 2nd series, Vol, I. p.394.
০৬. নব্য প্রস্তর যুগ – বাঙ্গালাদেশে আবিষ্কৃত নিদর্শন
লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরিয়া পাষাণখণ্ড হইতে অস্ত্র নির্ম্মাণ করিয়া আদিম মানব, যে যুগে এই জাতীয় অস্ত্রনির্ম্মাণে পারদর্শী হইয়া উঠিল, সেই যুগের নাম নব্য-প্রস্তরযুগ। এই যুগে দূর হইতে অস্ত্র বর্ষণ করিবার উপায় আবিষ্কার করিয়া মানবজাতি জীবগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। ধনুর সাহায্যে গুটিকা বা শর নিক্ষেপের কৌশল আবিষ্কার করিয়া, আদিম মানবগণ অযথা বলক্ষয় বা শোণিতস্রাব না করিয়াও শত্রু নিপাত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। নূতন শক্তিলাভ করিয়া তাঁহারা প্রাচীন জগতের অতিকায় দুর্জ্জেয়, হিংস্র জীবসমূহের ধ্বংসসাধন করিয়া পৃথিবী মানবের বাসোপযোগী করিয়াছিলেন; বস্তুতঃ এই যুগ হইতেই মানবের সভ্যতা আরদ্ধ হইয়াছে। নব্য-প্রস্তরযুগের আয়ুধসমূল, প্রত্ন-প্রস্তরযুগের তুলনায় সংখ্যায় অধিক, কলানৈপুণ্যের পরিচায়ক এবং আকারে ও প্রকারে বহুবিধ। বঙ্গদেশের যে প্রদেশে প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, সে প্রদেশেই নব্য-প্রস্তরযুগের অস্ত্রশস্ত্র পাওয়া গিয়াছে। সর্ব্বপ্রথমে সিংহভূম জেলায় চাইবাসা নগরে নব্য-প্রস্তরযুগের অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ১৮৬৮ খৃষ্টাব্দে কাপ্তেন বীচিং (Captain Beeching) সিংহভূম জেলার চাইবাসা নগরে ও চক্রধরপুরের আট ক্রোশ দূরবর্ত্তী একটি নদীতীরে প্রস্তরনির্ম্মিত ছুরিকা আবিষ্কার করিয়াছিলেন (১০)। ভিন্সেন্ট্ বল্ এই সমস্ত স্থান পরীক্ষা করিয়া স্থির করেন যে, আবিষ্কৃত পাষাণখণ্ডগুলি মানব কর্ত্তৃক নির্ম্মিত ও ব্যবহৃত অস্ত্র (১১)।
এই সময়ে বল্ ছোটনাগপুরের বুড়াণ্ডিহ গ্রামে একটু সুন্দর, সুগঠিত ছেদনাস্ত্র (celt) আবিষ্কার করিয়াছিলেন। ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে, তিনি পার্শ্বনাথপর্ব্বরের পাদমূলে আর একখান ছেননাস্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন (১২)। ১৮৮২ খৃষ্টাব্দে মানভূম জেলার বরাহভূম পরিগণায়, ধাদ্কা কয়লার খনির নিকটে দেওঘা গ্রামে একখানি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল (১৩)। ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে চট্টগ্রামের নিকট সীতাকুণ্ডপর্ব্বতে অশ্মীভূত কাষ্ঠ (Petrified or fossilized wood) নিম্মিত একখানি কৃপাণ আবিষ্কৃত হইয়াছিল (১৪)। ১৯৮৮ খৃষ্টাব্দে রাঁচি জেলায় শত শত প্রস্তর নির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছিল। এই স্থানে অস্ত্র তীক্ষ্ণ করিবার প্রস্তর (Polishing stone), গদাফলক (ring stone), কুঠার ফলক বা ছেদনাস্ত্র (Boucher or celt), ছুরিকা (flake), মুষল (grinder) আবিষ্কৃত হইয়াছিল (১৫)। ১৯১০ খৃষ্টাব্দে হাজারীবাগের শ্রীযুক্ত নবীনচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহাশয় পার্শ্বনাথপর্ব্বতের নিকটে ও হাজারীবাগের অন্যান্য স্থানে পাঁচটি নব্য-প্রস্তরযুগের অস্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন (১৬)।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক, শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র দাশগুপ্ত এম্ এ, আসামে আবিষ্কৃত নূতন প্রকারের দুইটি কুঠারফলকের বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন (১৭)। ভিন্সেন্ট্ বল্ ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে, সিংহভূম জেলার ধলভূম পরগণায় এই জাতীয় কুঠারফলক আবিষ্কার করিয়াছিলেন (১৮)। সম্প্রতি শ্রীযুক্ত কগিন্ ব্রাউন আসামে এক নূতন ধরণের মুষলের (Grooved hammer) বিবরণ প্রকাশ করিয়াছেন (১৯)।
নব্য-প্রস্তর যুগে আদিম মানবগণ ধাতের ব্যবহার জানিতেন না। ধাতু আবিষ্কৃত হইলে, মানবগণ যখন জানিতে পারিলেন যে, ধাতুর অস্ত্র পাষাণনির্ম্মিত অস্ত্রাপেক্ষা তীক্ষ্ণধার, তখন তাঁহারা ক্রমশঃ শিলানির্ম্মিত আয়ুধ পরিত্যাগ করিয়া ধাতুনির্ম্মিত অস্ত্র ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন। সুধীগণ অনুমান করেন যে, আদিম মানবগণ সুবর্ণের সৌন্দর্য্যে আকৃষ্ট হইয়া সর্ব্বপ্রথমে এই ধাতু সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সুবর্ণের পরে তাম্র আবিষ্কৃত হইয়াছিল। মানবজাতির সর্ব্বপ্রাচীন ধাতব অস্ত্রসমূহ তাম্রনির্ম্মিত। তাম্রনির্ম্মিত তীক্ষ্ণধার, কিন্তু সুকঠিন নহে। টিন্ আবিষ্কৃত হইবার পরে, তাম্রনির্ম্মিত দ্রব্যাদি কঠিন করিবার জন্য নয়ভাগ তাম্রের সহিত একভাগ টিন্ মিশ্রিত হইত, এই মিশ্রধাতুর নাম ব্রঞ্জ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ইতিহাসে নব্য প্রস্তরের যুগের পরবর্ত্তিকালকে তাম্রের যুগ (Copper age) আখ্যা প্রদান করা হইয়াছে। তাম্রের যুগের শেষভাগের নাম ব্রঞ্জের যুগ। উত্তরাপথে বা দক্ষিণাপথে অদ্যাবধি এই নূতন মিশ্রধাতু-নির্ম্মিত কোন অস্ত্র আবিষ্কৃত হয় নাই এবং এই জন্য পণ্ডিতগণ অনুমান করিয়া থাকেন যে, ভারতবাসী আদিম মানবগণ মিশ্রধাতুর ব্যবহার জানিতেন না। নব্য-প্রস্তরের যুগ ও তাম্রের যুগে, এমন কি লৌহের যুগে (Iron age) পর্য্যন্ত শিলানির্ম্মিত অস্ত্রের ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায় (২০)।
ভারববর্ষের নানা স্থানে নানাবিধ তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাম্রনির্ম্মিত কুঠার বা পরশু, তরবারি, ছুরিকা বা কৃপাণ, ভল্ল বা বর্ষার শীর্ষ বক্রদন্তযুক্ত ভল্ল (Harpoon) এবং নানাবিধ ছেদনাস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। কলিকাতা মিউজিয়ামে কাণপুরের নিকটস্থিত বিঠুর, আগ্রার নিকটস্থিত মৈনপুরী, ফরক্কাবাদের নিকটস্থিত ফতেপুর এবং মধ্যপ্রদেশের বালাঘাট জেলায় অবস্থিত গঙ্গেরিয়া প্রভৃতি নানা স্থানের নানাবিধ তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্র আছে। বাঙ্গালা দেশে মাত্র তিন স্থানের তাম্রনির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে হাজারীবাগ জেলার পচম্বা মহকুমার একটি গিরিশীর্ষে কতকগুলি অসম্পূর্ণ কুঠার বা পরশুফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল (২১)। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে, মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে ঝাটিবনি পরগণায় তামাজুরী গ্রামে একখানি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল (২২)। ত্রিশ বৎসরের অধিককাল পূর্ব্বে ডাঃ সইস্ (Dr. Saise) বারাগুণ্ডা তামার খনির নিকটে বহু তাম্রনির্ম্মিত অলঙ্কার ও অস্ত্র আবিষ্কার করিয়াছিলেন; ইহার মধ্যে একখানি বৃহৎ কুঠার বা পরশুফলক এবং একখানি কঙ্কণ মাদ্রাজের চিত্রশালায় আছে।