জগদ্বিখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ লবক্ (Sir John Lubbock, Lord Avebury) প্রস্তরের যুগকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়াছেন; প্রস্তরযুগের প্রথম ভাগের নাম প্রত্ন-প্রস্তরের যুগ (Paloeolithic Age) ও দ্বিতীয় ভাগের নাম নব্য প্রস্তরের যুগ (Neolithic Age)। আদিম মানবের যে সমস্ত প্রহরণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা সাধারণতঃ দুইভাবে বিভক্ত হইতে পারে; (ক) প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্র–ইহাতে মানবের শিল্পচাতুর্য্যের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় না। ইহা দেখিয়া এইমাত্র বুঝিতে পারা যা যে, ইহা ভূপৃষ্ঠে অন্বেষণলব্ধ প্রস্তরখণ্ড মাত্র নহে; (খ) নব্যপ্রস্তরযুগের অস্ত্র–নব্যপ্রস্তরের যুগে বর্ষাফলক, শরফলক, কুঠারফলক, ছুরিকা প্রভৃতি নানাবিধ সুদৃশ্য ও সযত্ননির্ম্মিত অস্ত্র দেখিতে পাওয়া যায়; এই যুগের অস্ত্র দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায় যে, আদিম মানব সেই সময়ে শিলা খণ্ড হইতে অস্ত্রনির্ম্মাণে অভ্যস্ত হইয়াছিল।
——————-
(৫) “Eolith means an instrument not chipped into any intentional form, but only natural forms utilised at once. Nature, Aug. 31st. 1905.”
০৪. যুগবিপ্লব – আদিম মানবের স্বভাব পরিবর্ত্তন
ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, মানবজাতির পরিবর্ত্তন আরদ্ধ হইয়াছে; পৃথিবীর কোন্ ভাবে, কোন সময়ে, যুগবিপ্লবের ফলে, নিরামিষাশী আদিম মানবকে মাংসাশী হইতে হইয়াছিল, এবং তীক্ষ্ণনখদন্তের অভাবে, মৃগয়োপযোগী অস্ত্রানবেষণে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছিল, তাহা অদ্যপি নির্ণীত হয় নাই। বর্ত্তমান সময়ে এই মাত্র বলা যাইতে পারে যে, পৃথিবীর সর্ব্বত্র একই সময়ে যুগবিপ্লব হয় নাই। ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন জাতীয় মানব এখনও সময়ে অবস্থায় উন্নীত হইতে পারে নাই। অদ্যাপি জগতে এমন মনুষ্য আছে, যাহারা ধাতুর ব্যবহার জানে না। ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে জ্ঞানের উন্নতির সহিত, মানবজাতির উন্নতি হইয়াছে, এবং প্রত্ন-প্রস্তরের যুগ আরম্ভ হইয়াছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, ইউরোপখণ্ডে এই যুগ খৃষ্টের জন্মের পঞ্চদশ লক্ষ বৎসর পূর্ব্বে আরম্ভ হইয়াছিল। ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিত কগিন ব্রাউন অনুমান করেন যে ভারতবর্ষের প্রাচীন প্রস্তরের যুগই ইউরোপের প্রত্ন-প্রস্তরযুগের সমসাময়িক হইলেও হইতে পারে (৬)।
—————–
(৬) It is not, however, safe in the present stage of knowledge to argue that the chipped implements of Bengal are of such a high antiquity, though it is within the bounds of possibility that they may be. –J. Gogging Brown–Note Subpplied for the Author’s use.
০৫. বাঙ্গালা দেশে আবিষ্কৃত নিদর্শন – বঙ্গবাসী ও মাদ্রাসবাসী আদিম মানব
বাঙ্গালাদেশে প্রত্ন-প্রস্তরযুগে যে কয়টি শিলানির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার সকলগুলিই দেশের ভিন্ন ভিন্ন সীমান্তে পাওয়া গিয়াছে। বাঙ্গালা দেশ পলিমাটীর দেশ; ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইহা বয়সে নবীন। কিন্তু এই নবীন দেশের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব্ব সীমান্তে অতি প্রাচীন ভূমি আছে; এই সকল প্রদেশেই বাঙ্গালাদেশের প্রত্ন-প্রস্তরযুগের পাষাণনির্ম্মিত আয়ুধ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দক্ষিণ-পূর্ব্বসীমান্তে, চট্টগ্রামের পার্ব্বত্য-প্রদেশে, যে সমস্ত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা আকারে প্রত্ন-প্রস্তরযুগের ন্যায় হইলেও, ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণের মতানুসারে অপেক্ষাকৃত আধুনিক। আর্য্যাবর্ত্তের উত্তর-সীমান্তে হিমালয়ের পাদমূলে ও পার্ব্বত্য উপত্যকা সমূহে, আদিম মানবের বাসের কোন চিহ্নই অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বঙ্গদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তস্থিত পার্ব্বত্যপ্রদেশে দুইটি মাত্র প্রত্ন-প্রস্তরযুগের শিলানির্ম্মিত আয়ুধ আয়ুধ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত এই জাতীয় আর একটি অস্ত্র প্রায় পঞ্চাশৎ বৎসর পূর্ব্বে বঙ্গদেশের সমতলক্ষেত্রে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে ভূতত্ত্ববিদ বল্ হুগলী-জেলার গোবিন্দপুর গ্রামের এগার মেইল দক্ষিণ-পশ্চিমে কুণ্কুণে গ্রামে একটি হরিতাভ প্রস্তরনির্ম্মিত কুঠারফলক (Boucher or celt) আবিষ্কার করিয়াছিলেন। এই সময়ে রাণীগঞ্জের নিকটা বোথারোর কয়লার খনিতে এই জাতীয় আর একটু কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল (৭)। ইহার দুই বৎসর পরে সীতারামপুরের নিকটবর্ত্তী ঝরিয়ার কয়লার খনিতে আর একটি কুঠারফলক আবিষ্কৃত হইয়াছিল, ইহাই এখন কলিকাতা মিউজিয়ামে দেখিতে পাওয়া যায় (৮)। পূর্ব্বোক্ত অস্ত্রদ্বয় বোধ হয় ইংলণ্ডে প্রেরিত হইয়াছে। প্রত্ন-প্রস্তরযুগের এই তিনটি প্রহরণ ব্যতীত উত্তরাপথের পূর্ব্বখণ্ডে আর চারিটি মাত্র শিলানির্ম্মিত প্রাচীন অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই চারিটি অস্ত্র উড়িষ্যা-প্রদেশের ঢেঁকানাল, আঙ্গুল, তালচের ও সম্বলপুরে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। সুবিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিত ভিন্সেন্ট্ বল্ মাদ্রাজে আবিষ্কৃত প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্রসমূহের সহিত বঙ্গদেশের ও উড়িষ্যারেই যুগের নিদর্শনসমূহের তুলনা করিয়া দেখাইয়াছেন যে, এই উভয় প্রদেশের প্রাচীন শিলানির্ম্মিত প্রহরণের মধ্যে বিশেষ সাদৃশ্য আছে। ইহা হইতে তিনি অনুমান করেন যে, দক্ষিণাপথবাসী আদিম মানবগণের সহিত উত্তরাপথবাসী প্রাচীন মানবজাতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মাদ্রাজে ও বাঙ্গালায় আবিষ্কৃত প্রত্ন-প্রস্তরযুগের অস্ত্রসমূহের সাদৃশ্য কেবল আকারগত নহে, অনেক সময়ে উভয় দেশে আবিষ্কৃত অস্ত্রের পাষাণ একই জাতীয়। যে স্থানে এই জাতীয় প্রস্তর পাওয়া যায়, সে স্থান বাঙ্গালাদেশ হইতে শত শত ক্রোশ দূরে অবস্থিত। ভিন্সেন্ট্ বল্ অনুমান করেন যে আদিম মানবগণ প্রত্ন-প্রস্তরযুগে এই সকল প্রাচীন অস্ত্র দক্ষিণাপথ হইতে উত্তরাপথের পূর্ব্বখণ্ডে আনয়ন করিয়াছিলেন (৯)।