- বইয়ের নামঃ বাঙ্গালার ইতিহাস – ১ম খণ্ড
- লেখকের নামঃ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
০১. প্রাগৈতিহাসিক যুগ
০১. যুগ বিভাগ – মানবের অস্তিত্বের সর্ব্বপ্রাচীন নিদর্শন
জগতে, সর্ব্বপ্রথমে, কোন্ যুগে কত কাল পূর্ব্বে, মানবের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহা এখনও অজ্ঞাত রহিয়াছে। প্রাণিতত্ত্ববিদ্গণ স্থির করিয়াছেন যে, বর্ত্তমান সময়ের সকল জীবের পরে মানবের আবির্ভাব হইয়াছিল। ভূতত্ত্ববিদ্গণ বলিয়া থাকেন যে, নব্যজীবক যুগের শেষভাবে মানবের অস্তিত্বের চিহ্ন লক্ষিত হয় (১)। অত্যাধুনিক উপযুগ হইতে ভূপৃষ্ঠে মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়, কিন্তু ইহার পূর্ব্ববর্ত্তী দুইটি উপযুগে মানবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ভূতত্ত্ববিদগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন যে, মধ্যাধুনিক ও বহ্বাধুনিক উপযুগে মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া যায়; কিন্তু কেহ কেহ এই সকল নিদর্শনের সহিত মানবের সম্পর্ক স্বীকার করে না (২)। কেহ কেহ বলেন যে বহ্বাধুনিক উপযুগে মানবের অস্তিত্বের নিদর্শন আবিষ্কৃত হইবে ইহা আশা করা যাইতে পারে, কিন্তু মধ্যাধুনিক যুগে মানবের অস্তিত্ব প্রমাণ করিবার কোন আশাই নাই। মাদ্রাজ প্রদেশে কর্ণুল নামক স্থানে একটি পর্ব্বতগুহায় জীবাশ্মের (Fossil) সহিত আদিম মানুষের অস্তিত্বের নিদর্শন আবিষ্কৃত হইয়াছে। ভূতত্ত্ববিদগণ অনুমান করেন যে, এই সকল জীবাশ্ম বহ্বাধুনিকযুগের স্তন্যপায়ী জীবের অস্থি (৩)। ব্রহ্মদেশে বহ্বাধুনিকযুগের লুপ্ত স্তন্যপায়ী জীবের অস্থির সহিত আদিম মানব কর্ত্তৃক ব্যবহৃত প্রস্তরনির্ম্মিত অস্ত্র আবিষ্কৃত হইয়াছে (৪)। অন্ত্যাধুনিক ও উপাধুনিক যুগে মানবের অস্তিত্ব সম্বন্ধে মনীষিগণের মতদ্বৈধ নাই।
——————-
(১) ভূতত্ত্ববিদগণ পৃথিবীর বয়সকে প্রথমতঃ প্রত্নজীবক, মধ্যজীবক ও নব্যজীবক এই তিন যুগে বিভক্ত করিয়াছেন। প্রত্যেক যুগ তিন বা ততোধিক উপযুগে বিভক্ত হইয়াছেঃ–
(ক) প্রত্নজীবক (Paleozoic)
– আদিম (Archaean)
– কাম্ব্রিক (Cambrian)
– অর্দোভিসীয় (Ordovician)
– সিলিউরিক (Silurian)
– ডিভোনিক (Devonian)
– অঙ্গারবহ (Carboniferous)
– পার্মিক (Permian)
(খ) মধ্যজীবক (Mesozoic)
– ত্রায়াসিক (Triassic)
– জুরাসিক (Jurassic)
– খটিক (Cretaceous)
(গ) নব্যজীবক (Cainozoic)
– প্রাগাধুনিক (Eocene)
– অল্পাধুনিক (Oligocene)
– মধ্যাধুনিক (Miocene)
– বহ্বাধুনিক (Pliocene)
– অন্ত্যাধুনিক (Pleistocene)
– উপাধুনিক (Sub-holocene)
– আধুনিক (Holocene)
(২) That man esisted in Western Europe during the period of the Mamoth and the Rhinoceros, Tichorhinus, no longer, I thing admits of a doubt; but when we come to Pliocene and still more to Micocene times, the evidence is less conslusive :- Pre-historic Times, p.399
(৩) Records of the Geological Survey of India, Vol. XVII. p.201,203,205
(৪) Neotling–Memories of the Geological Survey of India, Vol. XXVIII. 1884. Pre-historic Times, p.402
হায়দরাবাদে নিজামের রাজ্যে গোদাবরী নদীর উপত্যকায় অধুনা লুপ্ত অতিকার জীবের অস্থির সহিত একখানি বহুমূল্য এগেট (agate) প্রস্তর নির্ম্মিত ছুরিকা (Flake) আবিষ্কৃত হইয়াছিল–Memories of the Geological Survey of India, Vol. I. p.65. প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র দাশগুপ্ত মহাশয় এই সংবাদ সংগ্রহ করিয়া দিয়াছেন।
০২. আদিম-মানব নিরামিষাশী
ভূতত্ত্ববিদ ও প্রাণিতত্ত্ববিদগণ স্থির করিয়াছেন যে, মানবজাতির শৈশবে আদিম মানবগণ উদ্ভিদভোজী ছিলেন। মানবের জন্মের ইতিহাস এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন, সমগ্র মানবজাতির পূর্ব্বপুরুষগণ একই সময়ে একই স্থানে উৎপন্ন হইয়াছিলেন কি না তাহা বলিতে পারা যায় না, তবে ইহা স্থির যে, মানবজীবনের প্রারম্ভে আমাদিগের পূর্ব্বপুরুষগণ নিরামিষাশী ছিলেন। যুগপরিবর্ত্তনের ফলে, মানবের ক্রমশঃ, অথবা সহসা, শীতপ্রধান হইয়াছিল। তাহার ফলে, আদিম মানবের লীলাক্ষেত্রসমূহে, জীবনধারণোপযোগী ফলমূলের অভাব হইয়াছিল। এই পরিবর্ত্তনের যুগে আদিম মানবকে বাধ্য হইয়া ফলমূলের পরবর্ত্তে পশুমাংস-ভোজনে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছিল। জগতে মাংসাশী জীবসমূহের জন্মকাল হইতে যেরূপ তীক্ষ্ণনখদন্ত থাকে, কোন অবস্থাতেই মানবের তাহা ছিল না, এই কারণে আদিম মানবকে জীবনযাত্রানির্ব্বাহের জন্য পশুহত্যার উপযোগী আয়ুধ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হইতে হইয়াছিল। আদিম মানব তখনও কৃত্রিম উপায়ে অগ্ন্যুৎপাদিন করিতে শিক্ষা করে নাই, সুতরাং ধাতুর ব্যবহার অজ্ঞাত ছিল। এই যুগবিপ্লবের সময়ে, আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ যে আয়ুধ বা প্রহরণ সংগ্রহ করিয়াছিলেন, তাহা তীক্ষ্ণধার প্রস্তরখণ্ড মাত্র।
০৩. মানবের প্রথম অস্ত্র – প্রস্তরের যুগ – প্রত্ন-প্রস্তরের যুগ
মানবজাতির সর্ব্বপ্রাচীন অস্ত্র, ভূপৃষ্ঠে অন্বেষণলব্ধ, প্রস্তরখণ্ডের বর্ত্তমান নাম প্রাগায়ুধ (Eolith) (৫)। ইহাতে মানবের শিল্পের কোন নিদর্শন নাই, এই জন্য কোন কোন ভূতত্ত্ববিদ ইহা আদিম মানব কর্ত্তৃক ব্যবহৃত অস্ত্র নহে বলিয়া সন্দেহ করেন। আদিম মানবগণ প্রাগায়ুধ হস্তে ধারণ করিয়া মৃগয়ায় প্রবৃত্ত হইতেন এবং আমমাংস ভক্ষণ করিয়া জঠরজ্বালা নিবৃত্তি করিতেন। ক্রমশঃ জ্ঞানবৃদ্ধির সহিত ভল্ল বা বর্শার ব্যবহার আরম্ভ হয়। যুগবিপ্লবের বহুকাল পরে, আদিম মানবগণ ভূপৃষ্ঠলব্ধ প্রস্তরখণ্ডের অগ্রভাগ, দ্বিতীয় প্রস্তরের আঘাতে তীক্ষ্ণতর করিয়া, তাহা দণ্ডের অগ্রভাগে, বনজাত লতায় বন্ধনপূর্ব্বক ভল্ল বা বর্শার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কৃত্রিম উপায়ে অগ্ন্যুৎপাদন মানবজাতির দ্বিতীয় আবিষ্কার। নবাবিষ্কৃত অগ্নি ও ভল্লের সাহায্যে আদিম মানবগণ সেই প্রাচীনযুগের অতিকায় ভীষণ হিংস্রজন্তুসমূহের আক্রমণ হইতে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, এবং ক্রমশঃ সমগ্র জীবজগতের উপরে স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। মানবজাতির শৈশবে, অগ্ন্যৎপাদনের উপায় আবিষ্কৃত হইলেও, আদিম মানবসমাজে বহুকালযাবৎ ধাতুর ব্যবহার ছিল। ধাতব অস্ত্রনির্ম্মাণপদ্ধতির আবিষ্কারকালপর্য্যন্ত, তীক্ষ্ণধার পাষাণখণ্ডই আদিম মানবের একমাত্র প্রহরণ ছিল। পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ, ধাতবঅস্ত্রনির্ম্মাণকালপর্য্যন্ত সময়ের, প্রস্তরের যুগ (Stone Age) নাম দিয়াছেন।