বিদেশে দূত প্রেরণ গিয়াসুদ্দীনের একটি অভিনব ও প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। জৌনপুরের সুলতান মালিক সাওয়ারের কাছে তিনি দূত পাঠাইয়াছিলেন এবং তাঁহাকে হাতি উপহার দিয়াছিলেন। চীনদেশের ইতিহাস হইতে জানা যায়, চীন সম্রাট য়ুং-লোর কাছে গিয়াসুদ্দীন ১৪০৫, ১৪০৮ ও ১৪০৯ খ্রীষ্টাব্দে উপহার সমেত দূত পাঠাইয়াছিলেন। য়ুং-লো ইহার প্রত্যুত্তরস্বরূপ কয়েকবার গিয়াসুদ্দীনের কাছে উপহার সমেত দূত পাঠান।
কিন্তু গিয়াসুদ্দীন যে সমস্ত ব্যাপারেই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা নহে। কোন কোন ব্যাপারে তিনি শোচনীয় ব্যর্থতারও পরিচয় দিয়াছেন। যেমন, যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে তিনি মোটেই সুবিধা করিতে পারেন নাই। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে তাঁহার পিতার সহিত তাঁহার যে বিরোধ ও যুদ্ধ হইয়াছিল তাহাতে রাজ্যের সামরিক শক্তি বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছিল। সিংহাসনে আরোহণের পর গিয়াসুদ্দীন যে সমস্ত যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছিলেন, তাহাতেও সামরিক শক্তির অপচয় ভিন্ন আর কোন ফল হয় নাই। কোন কোন ক্ষেত্রে তাঁহাকে পরাজয় বরণ করিতে হয়। কথিত আছে, শাহেব খান (?) নামে এক ব্যক্তির সহিত গিয়াসুদ্দীন দীর্ঘকাল নিষ্ফল যুদ্ধ চালাইয়া প্রচুর শক্তি ক্ষয় করিয়াছিলেন, অবশেষে নূর কুত্ত্ব আলম উভয় পক্ষে সন্ধি স্থাপনের চেষ্টা করেন, কিন্তু সন্ধির কথাবার্তা চলিবার সময় গিয়াসুদ্দীন শাহেব খানকে আক্রমণ করিয়া বন্দী করেন এবং এই বিশ্বাসঘাতকতা দ্বারা কোনক্রমে নিজের মান বাঁচান। গিয়াসুদ্দীন কামরূপ-কামতা রাজ্যের কিছু অংশ সাময়িকভাবে অধিকার করিয়াছিলেন। কথিত আছে, গিয়াসুদ্দীন কামতা-রাজ ও অহোম-রাজের মধ্যে বিরোধের সুযোগ লইয়া কামতা রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন; কিন্তু তাঁহার আক্রমণের ফলে কামতা-রাজ অহোম-রাজের সঙ্গে নিজের কন্যার বিবাহ দিয়া সন্ধি করেন এবং তাঁহার পর উভয় রাজা মিলিতভাবে গিয়াসুদ্দীনের বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। তাঁহার ফলে গিয়াসুদ্দীনের বাহিনী কামতা রাজ্য হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হয়। মিথিলার অমর কবি বিদ্যাপতি তাঁহার একাধিক গ্রন্থে লিখিয়াছেন যে তাঁহার পৃষ্ঠপোষক শিবসিংহ একজন গৌড়েশ্বরকে পরাজিত করিয়াছিলেন; যতদূর মনে হয়, এই গৌড়েশ্বর গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ।
গিয়াসুদ্দীন যে তাঁহার শেষ জীবনে হিন্দুদের সম্বন্ধে ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন ও তাঁহার জন্যই শেষ পর্যন্ত তিনি শোচনীয় পরিণাম বরণ করিয়াছিলেন, তাহা মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে। মুজাফফর শামস্ বলখির ৮০০ হিজরায় (১৩৯৭ খ্রী) লেখা চিঠিতে পাই তিনি গিয়াসুদ্দীনকে বলিতেছেন যে মুসলিম রাজ্যে বিধর্মীদের উচ্চ পদে নিয়োগ করা একেবারেই উচিত নহে। গিয়াসুদ্দীন বলখিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিতেন ও তাঁহার উপদেশ অনুসারে চলিতেন। সুতরাং তিনি যে এই ব্যাপারে বখির অভিপ্রায় অনুযায়ী চলিয়াছিলেন অর্থাৎ রাজ্যের সমস্ত উচ্চ পদ হইতে বিধর্মী হিন্দুদের অপসারিত করিয়াছিলেন, ইহাই সম্ভব। ইহার স্বপক্ষে কিছু প্রমাণও আছে। গিয়াসুদ্দীন ও তাঁহার পুত্র সৈফুদ্দীন হজা শাহের রাজত্বকালে কয়েকবার চীন-সম্রাটের দূতেরা বাংলার রাজদরবারে আসিয়াছিলেন। তাঁহারা দেখিয়াছিলেন যে বাংলার সুলতানের অমাত্য ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সকলেই মুসলমান, একজনও অমুসলমান নাই। এই কথা জনৈক চীনা রাজপ্রতিনিধিই লিখিয়া গিয়াছেন।
ফিরিশতার মতে হিন্দু রাজা গণেশ ইলিয়াস শাহী বংশের একজন আমীর ছিলেন। আবার ‘রিয়াজ’-এর মতে এই রাজা গণেশের চক্রান্তেই গিয়াসুদ্দীন নিহত হইয়াছিলেন। মনে হয়, বখির অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করিয়া গিয়াসুদ্দীন রাজা গণেশ প্রমুখ সমস্ত হিন্দু আমীরকেই পদচ্যুত করিয়াছিলেন, তাঁহার ফলে রাজা গণেশ গিয়াসুদ্দীনের শত্রু হইয়া দাঁড়ান এবং শেষপর্যন্ত তিনি চক্রান্ত করিয়া গিয়াসুদ্দীনকে হত্যা করান। গিয়াসুদ্দীন যে শেষজীবনে সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন হইয়াছিলেন, তাঁহার আর একটি প্রমাণ–তাঁহার রাজত্বকালে আগত চীনা রাজদূতদের কেবলমাত্র বাংলার মুসলমানদের জীবনযাত্রাই দেখানো হইয়াছিল, বাংলার হিন্দুদের সম্বন্ধে তাঁহারা কোন বিবরণই লেখেন নাই।
গিয়াসুদ্দীন যে কবি ও কাব্যামোদী ছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইরানের কবি হাফিজের সঙ্গে তাঁহার যোগাযোগ ছিল, কিন্তু কোন ভারতীয় কবির সহিত তাঁহার কোন সম্পর্ক ছিল কিনা, সে সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। “বিদ্যাপতি কবি”-র ভণিতাযুক্ত একটি পদে জনৈক “গ্যাসদীন সুরতান”-এর প্রশস্তি আছে। অনেকের মতে এই বিদ্যাপতি কবি” মিথিলার বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতি (জীবঙ্কাল আ. ১৩৭০-১৪৬০ খ্রী) এবং “গ্যাসদীন সুরতান (সুলতান)” গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ। কিন্তু এই মত সমর্থন করা যায় না। বাংলা ‘ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের রচয়িতা শাহ মোহাম্মদ সগীরের আত্মবিবরণীর একটি ছত্রের উপর ভিত্তি করিয়া অনেকে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ সগীরের সমসাময়িক ও পৃষ্ঠপোষক নৃপতি ছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ পিতার মৃত্যুর পর কুড়ি বৎসর রাজত্ব করিয়া ১৪১০ ১১ খ্রীষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন।