কোচবিহার ও ত্রিপুরার রাজবংশের উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। কোচবিহারের প্রথম রাজা বিশু অথবা বিশ্বসিংহ চন্দ্রবংশীয় হৈহয় রাজকুলে এবং শিবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন; এই বংশীয় দ্বাদশ রাজকুমার পরশুরামের ভয়ে, ‘মেচ জাতীয় এই পরিচয়ে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। ত্রিপুরার ‘রাজমালার আরম্ভ এইরূপ
চন্দ্রবংশে মহারাজা যযাতি নৃপতি।
সপ্তদ্বীপ জিনিলেক এর রথে গতি ॥
তান পঞ্চসুত বহু গুণযুত গুরু।
যদুজ্যেষ্ঠ তুর্বসু দ্ৰহু অনু পুরু ॥
দ্রুহ্যু কিরাত রাজ্যের রাজা হইলেন। দ্রুর বংশে দৈত্য রাজার পুত্র ত্রিপুর স্বীয় নামানুসারে রাজ্যের নাম (কিরাত) পরিবর্তন করিয়া ত্রিপুর রাখিলেন।
বলা বাহুল্য যে এই সমুদয় কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক মূল্য নাই। এই দুইটি রাজ্যের আদিম অধিবাসী ও রাজবংশ যে মঙ্গোলীয় জাতির শাখা এবং বাঙালী হিন্দুর সংস্পর্শে আসিয়া ক্রমশ হিন্দু ধর্ম ও সভ্যতা গ্রহণ করেন সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। উভয় রাজ্যের রাজারাই যে বাংলা দেশ হইতে বহু হিন্দুকে নিয়া নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করিয়াই ইহার পথ সুগম করিয়াছিলেন তাহা এই দুটি রাজ্যের কাহিনীতে বর্ণিত হইয়াছে।
২
কোচবিহার
কোচবিহার নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। তন্মধ্যে কোচ জাতির বাসস্থান বা বিহারক্ষেত্র হইতে কোচবিহার নামের উৎপত্তি–ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। প্রাচীন হিন্দুযুগে এই অঞ্চল প্রাগজ্যোতিষ ও কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলার মুসলমান রাজগণ, বখতিয়ার খিলজী, গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ (এই গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদই), এবং ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করেন তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এই শতাব্দেই শান জাতীয় আহোমগণ ব্রহ্মপুত্র নদীর উপত্যকার পূর্বাংশ অধিকার করে এবং ইহার নাম হয় আসাম। এই সময়েই কামরূপ রাজ্যের পশ্চিমাংশে এক নূতন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমান কোচবিহার শহরের সন্নিকটে কামতা বা কামতাপুর নামক স্থানে ইহার রাজধানী ছিল এবং এইজন্য ইহা কামতা রাজ্য নামে পরিচিত। বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ১৪৯৮-৯৯ খ্রীষ্টাব্দে কামরূপ ও কামতা জয় করেন।
কামতা ও কামরূপ রাজ্য পতনের পরে ভূঁঞা উপাধিধারী বহু নায়ক এই অঞ্চলে ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ইঁহাদেরই একজন, কোচজাতীয় হরিয়া মণ্ডলের পুত্র বিশু, অন্য নায়কদিগকে পরাজিত করিয়া আনুমানিক ১৫১৫ (মতান্তরে ১৪৯৬ অথবা ১৫৩০) খ্রীষ্টাব্দে কামতায় একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ইহার রাজধানীর নাম হইল কোচবিহার (কুচবিহার)। বিশু রাজা হইয়া বিশ্বসিংহ’ এই নাম গ্রহণ করেন এবং ঐ অঞ্চল হইতে মুসলমান প্রভাব সম্পূর্ণরূপে দূর করেন। তিনি ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীর দিয়া অগ্রসর হইয়া পূর্বে গৌহাটি পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার করেন। তাঁহার রাজ্যের পশ্চিম সীমা ছিল করতোয়া নদী। বিশ্বসিংহ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের আচার-ব্যবহার গ্রহণ করেন এবং ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে ক্ষত্রিয় বলিয়া স্বীকার করেন। মুসলমানেরা কামতেশ্বরীর মন্দির ধ্বংস করিয়াছিল, বিশ্বসিংহ উহা পুনরায় নির্মাণ করেন এবং বিদেশ হইতে অনেক ব্রাহ্মণ আনাইয়া স্বীয় রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন।
আনুমানিক ১৫৪০ (মতান্তরে ১৫৩৩) খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বসিংহের মৃত্যু হইলে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র নরসিংহ রাজা হইলেন। অল্পকাল রাজত্ব করার পর তাঁহার মৃত্যু হইলে তাঁহার ভ্রাতা মল্লদেব নরনারায়ণ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতা শুক্লধ্বজকে মন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি পদে নিযুক্ত করিলেন। এই সময়ে পূর্ব আসামে সৈন্য চলাচল করিবার পথ অতি দুর্গম ছিল। আহোমদিগকে পরাজিত করিবার জন্য রাজা তাঁহার ভ্রাতা গোহাঁই (গোসাই) কমলকে সৈন্য ও যুদ্ধসম্ভার প্রেরণের উপযোগী একটি পথ প্রস্তুত করিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে কমল ভুটানের পর্বতমালা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যবর্তী ভূভাগের উপর দিয়া কোচবিহার হইতে সুদূর পরশুকুণ্ড (মতান্তরে নারায়ণপুর) পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ মাইল দীর্ঘ যে রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন তাঁহার কোন কোন অংশ এখনও আছে এবং ইহা “গোঁসাই কমল আলী” নামে পরিচিত। নরনারায়ণ ও শুক্লধ্বজ ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরস্থ এই পথে গোয়ালপাড়া ও কামরূপের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইলেন। আহোমদিগকে কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে পরাজিত করিয়া তাহারা ডিক্রাই বা ডিহং নদী পর্যন্ত পৌঁছিলে এই নদীর তীরে দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হয়। ‘দরংরাজবংশাবলী’ অনুসারে সাতদিন যুদ্ধের পর আহোমগণ পলায়ন করে এবং নরনারায়ণ আহোম রাজধানী অধিকার করেন। কিন্তু আহোম বুরঞ্জীর মতে কোচ সৈন্য প্রথম প্রথম জয় লাভ করিলেও পর পর দুইটি যুদ্ধে হারিয়া পশ্চাৎপদ হয়। এই যুদ্ধে শুক্লধ্বজ বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন করায় ‘চিলা রায় নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। চিলের মত ছোঁ মারিয়া অকস্মাৎ শত্রু সৈন্য বিপর্যস্ত করার জন্যই সম্ভবত তাঁহার এইরূপ নামকরণ হয়। কাহারও কাহারও মতে তিনি অশ্বপৃষ্ঠে ভৈরবী নদী পার হইয়াছিলেন বলিয়া চিলা রায় নামে খ্যাত হইয়াছিলেন।