চতুর্থ অধ্যায় : ধনসম্বল
জাতি এবং দেশ হইতেছে সমাজ-রচনার ঐতিহ্য ও পরিবেশ। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, সমাজ-সৌধের বস্তুভিত্তি হইতেছে ধন। কাজেই প্রাচীন বাঙলার ধনসম্বল কী ছিল, ধনোৎপাদনের কী কী উপায় ছিল, কী কী ছিল উৎপন্ন বস্তু, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদি কিরূপ ছিল এইসব তথ্য বাঙালীর ইতিহাসের তৃতীয় কথা। এই তিন কথা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের বস্তুভিত্তি এবং এই ভিত্তির উপরই গড়িয়া উঠিয়াছিল প্রাচীন বাঙালীর সমাজবিন্যাস।
পঞ্চম অধ্যায়; ভূমিবিন্যাস
এইমাত্র বলিলাম, প্রাচীন বাঙলায় কৃষি ছিল ধনোৎপাদনের অন্যতম প্রথম ও প্রধান উপায়। কৃষির সঙ্গে দেশের ভূমিব্যবস্থা জড়িত। এই ভূমিব্যবস্থার উপরই দেশের অগণিত জনসাধারণের মরণ বাচন নির্ভর করিত, এখনও যেমন করে। ভূমি কয় প্রকার ছিল, ভূমির উপর রাজার অধিকারের স্বরূপ কী ছিল, প্রজার অধিকারই বা কতটুকু ছিল, ভূমির মূলগ্রাহী কে ছিলেন, ভূমিদানের প্রেরণা কী ছিল, ভূমির সীমানা নির্দেশের ৬ায়ক ছিল। রাজস্ব কিরূপ ছিল, প্রজার দায়িত্ব কী ছিল, খাসপ্রজা, নিম্নপ্রজা, ভূমিহীন প্রজা ইত্যাদি ছিল কিনা, এক কথায় ভূমিব্যবস্থার কথা বাঙালীর ইতিহাসের পঞ্চম এবং সমাজবিন্যাসের প্রথম কথা। –
ষষ্ঠ অধ্যায় : বর্ণবিন্যাস
খাচীন ও বর্তমান বাঙলার সমাজবিন্যাসের দিকে তাকাইলে যে জিনিস সর্বপ্রথম দৃষ্টিগোচর হয় তাহা বর্ণ-উপবর্ণের নানা স্তর-উপস্তরে বিভক্ত সুনির্দিষ্ট সীমায় সীমিত বাঙালীর বর্ণসমাজ। পাওলাদেশে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য নাই, প্রাচীনকালেও ছিল বলিয়া মনে করিবার যথেষ্ট প্রমাণ নাই; আল্পসংখ্যক থাকিলেও তাহদের কোনও প্রাধান্য ছিল বলিয়া মনে হয় না। ইহার কারণ কী? বাহ্মণদের প্রাধান্য বাঙলাদেশে কিভাবে কখন প্রতিষ্ঠিত হইল ঃ বৈদ্য-কায়স্থ বৃত্তিধারী লোকেরাই লা কী করিয়া কখন বর্ণশুদ্ধ হইলেন? এবং ব্রাহ্মণদের পরেই তাহদের স্থান নিণীত হইল কিরূপে? অন্যান্য সংকর পর্যায়ের বিচিত্র জাতের এবং ম্লেচ্ছ পতিত-অন্ত্যজ পর্যায়ের যে সব লোকদের কথা প্রাচীন লেখমালায় ও সাহিত্যগ্রন্থাদিতে পাওয়া যায় তাহাদের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্ধ কিরূপ, প্রত্যেকের স্বরূপ কী, বৃত্তি কী, দায় কী, অধিকার কী ছিল? বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর সম্বন্ধ কিরূপ ছিল, রাষ্ট্রে বিভিন্ন বর্ণের স্থান কিরূপ ছিল, রাজবংশের এবং রাষ্ট্রের সঙ্গে লণবিন্যাসের সম্বন্ধ কী ছিল ইত্যাদি সকল কথাই বাঙালীর ইতিহাসের কথা। এই কথা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসে ষষ্ঠ অধ্যায়।
সপ্তম অধ্যায় : শ্রেণীবিন্যাস
আগে যে বাঙলার জনসাধারণের কথা বলিয়াছি তাহারা সকলেই তো কিছু কৃষক বা ক্ষেত্রকর ছিলেন না। এখনকার মতো তখনও বৃহৎ একটা চাকুরিজীবী সম্প্রদায়ও ছিল। ইঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন রাজকর্মচারী। তাহা ছাড়া, ছোট ছোট মানপ বা দোকানদার হইতে আরম্ভ করিয়া বড় বড় বণিক, শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, ব্যাপার ইত্যাদির সংখ্যাও কম ছিল না। কৃষক বা ক্ষেত্রকররা তো ছিলেনই। তাহা ছাড়া, অধ্যাপনা, দেবপূজা, পৌরোহিত্য, নীতিপাঠ, ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চা প্রভৃতি নানা বৃত্তি লইয়া ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণেরও স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী ব্যক্তি ছিলেন। সকলের শেষে সমাজের নিম্নতম বর্ণস্তর শ্রেণীতে চণ্ডাল পর্যন্ত অন্যান্য অকীর্তিত লোকও ছিলেন অগণিত। প্রাচীন বাঙালী সমাজ এইসব নানা শ্রেণীতে বিন্যস্ত ছিল। এইসব বিভিন্ন শ্রেণীর বৃত্তি, তাহদের পরস্পর সম্বন্ধ, তাহদের দায় ও অধিকার ইত্যাদি সম্বন্ধে যে স্বল্প কথা জানা যায় তাহা লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের সপ্তম অধ্যায়।
অষ্টম অধ্যায় : গ্রাম ও নগরবিন্যাস
বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর অগণিত জনসাধারণ বাস করিতেন হয় গ্রামে না হয় নগরে ৷ এখনকার মতো তখনও বোধ হয় বর্তমান কালাপেক্ষাও অধিকসংখ্যক লোক গ্রামেই বাস করিতেন। জনসাধারণ বলিতে তখন প্রধানত এই অগণিত গ্রামবাসীদেরই বুঝাইত, এমন মনে করা অযৌক্তিক নয়। এক-একটা গ্রাম কী করিয়া গড়িয়া উঠিত তাহার দুই-একটি প্রমাণ পাওয়া যায়। গামের সংস্থান কিরূপ ছিল, নগরের সংস্থান কিরূপ ছিল? ইঁহাদের বিশেষ বিশেষ রূপ কী ছিল? গ্রাম ও নগর এই দুয়ের সভ্যতার পার্থক্য কিরূপ ছিল? ধর্ম ও শিক্ষা-কেন্দ্র বাণিজ্যকেন্দ্রগুলির চেহারা কিরূপ ছিল? সমস্ত প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলিবে না; তবু যতটুকু জানা যায় ততটুকু জানাই প্রাচীন বাঙলাদেশ ও বাঙালীকে জানা। এই জানার চেষ্টায় বাঙালীর ইতিহাসের অষ্টম
নবম অধ্যায় : রাষ্ট্রবিন্যাস
এই যে বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্ণের বিচিত্র জনসাধারণ, ইঁহাদের দৈনন্দিন জীবনের যে বিচিত্র কর্ম, বিচিত্র দায় ও অধিকার, তাহা ইহারা নির্বিবাদে পরস্পরের স্বার্থের সংঘাত বাঁচাইয়া নির্বাহ করিতেন কী করিয়া? ক্ষেত্রকর যে হলচালনা করিতে গিয়া নিজের জমির সীমা ডিঙাইয়া প্রতিবেশীর জমি লোভ করবেন না, তাহা দেখিবে কে যে বণিক পুণ্ড অথবা চম্পাপুরী-পাটলিপুত্র হইতে গোরুর গাড়ির লহরে অথবা নদীপথে সপ্তডিঙ্গায় পণ্য সাজাইয়া চলিয়াছেন তাম্রলিপ্তি, পথে দসু তাঁহাকে হত্যা করিয়া পণ্য লুটিয়া লইবে না, এই আশ্বাস তাহাকে দিবে কে? প্রত্যেকে স্বধর্মে ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া আপন আপন রুচি ও কর্তব্যানুযায়ী জীবন যাপন করিয়া যাইতে পারবেন, এই আশ্বাস সমাজ দিতে না পারিলে সমাজবিন্যাস সম্ভব হইতে পারে না। এই আশ্বাস দিবার, প্রত্যেককে স্বধর্মে ও স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত রাখিবার যন্ত্রও হইতেছে রাষ্ট্র। ভিতর ও বাহিরের হাত হইতে দেশ ও রাজ্যকে রক্ষা করিবার যন্ত্রও এই রাষ্ট্র। সমাজ নিজের প্রয়োজনেই এই রাষ্ট্রযন্ত্র সৃষ্টি করে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান পরিচালককে রাজা বা প্রধান বা নায়ক বলিয়া স্বীকার করে, তাহার ও র্তাহার রাজপুরুষদের এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ম-নির্দেশ মানিয়া চলে, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার ব্যয়ভার নির্বাহ করে, রাজাকে শ্রদ্ধাদান করে, এবং তাহার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বপ্রকার বাধ্যতা স্বীকার করে। ইহাই মহাভারতের শান্তিপর্ব বর্ণিত রাজধর্ম, অষ্টাদশ শতাব্দীর যুরোপের সামাজিক শর্তের মূল সূত্র। প্রাচীন বাঙলায় এই রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বরূপ কী ছিল? রাষ্ট্রপ্রধান কাহারা ছিলেন, রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা কাহারা করিতেন। রাষ্ট্রের আয়ব্যয় কী ছিল? রাজস্ব কী কী ছিল, কিরূপ ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্ণ ও শ্রেণীর সম্বন্ধ কী ছিল, গ্রাম ও নগরগুলির সম্বন্ধ কী ছিল, ধনোৎপাদনে ও বন্টনে রাষ্ট্রের আধিপত্য কতটুকু ছিল? রাষ্ট্রের আদর্শ বিভিন্ন কালে কিরূপ ছিল? রাষ্ট্রের সঙ্গে সামাজিক সংস্কৃতির যোগ কিরূপ ছিল? এইসব বিচিত্র প্রশ্নের যথালভ্য উত্তর লইয়া বাঙালীর ইতিহাসের নবম অধ্যায়।