বাঙলাদেশের লিপিগুলি কালানুযায়ী সাজাইলে খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক দ্বিতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া তুর্কী বিজয়েরও প্রায় শতবর্ষ কাল পর পর্যন্ত বিস্তৃত করা যায়। তবে খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক হইতে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্তই ধারাবাহিকভাবে পাওয়া যায়, এবং এই সাত-আট শত বৎসরের সামাজিক ইতিহাসের রূপই কতকটা স্পষ্ট হইয়া চোখের সম্মুখে ধরা দেয়। পঞ্চম শতকের আগে আমাদের জ্ঞান প্রায় অস্পষ্ট এবং অনেকটা অনুমানসিদ্ধ। লিপিগুলির সাক্ষ্যপ্রমাণ ব্যবহারের আর-একটু বিপদও আছে। খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতকে উৎকীর্ণ দামোদরপুরে (পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি) প্রাপ্ত কোনও তাম্রপট্টে ভূমিব্যবস্থা অথবা রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্বন্ধে যে খবর পাওয়া যায় তাহা যে দশম অথবা একাদশ শতকে সমতলমণ্ডল অথবা খাড়িমণ্ডল, কিংবা পুণ্ডবর্ধনভূক্তির অন্য কোনও মণ্ডল বা বিষয় সম্বন্ধে সত্য হইবে, এমন মনে করিবার কোনও কারণ নাই। এমন-কি, সেই শতকেরই বাঙলার অন্য কোনও ভুক্তি অথবা বিষয় সম্বন্ধে সত্য হইবে, তাহাও বলা যায় না। কাজেই যে-কোনও লিপিবর্ণিত যে-কোনও অবস্থা সমগ্রভাবে বাঙলাদেশ সম্বন্ধে অথবা সমগ্র প্রাচীনকাল সম্বন্ধে প্রযোজ্য না-ও হইতে পারে। বস্তুত, দেখা যায়, একই সময়ে বাঙলার বিভিন্ন স্থানে একই বিষয়ে বিভিন্ন ব্যবস্থা, রীতি ও পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এইজন্যই সাক্ষ্যপ্রমাণ উল্লেখ করিবার সময় ইচ্ছা করিয়াই আমি লিপিবর্ণিত স্থান ও কালের উল্লেখ সর্বত্রই করিয়াছি; এবং সেই স্থান ও কালেই বর্ণিত বিষয় প্রযোজ্য, এইরূপ ইঙ্গিত করিয়াছি। তারপর বিশেষ কোনও নিয়ম বা পদ্ধতি কতটুকু অন্য কাল ও অন্য স্থান সম্বন্ধে প্রযোজ্য, কী পরিমাণে সমগ্র বাঙলাদেশ সম্বন্ধে প্রযোজ্য তাহা লইয়া পাঠক অনুমান যদি করিতে চান তাহাতে ঐতিহাসিকের দায়িত্ব কিছু নাই।
৪. এই গ্রন্থের যুক্তিপর্যায়
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
চতুর্থ পরিচ্ছেদ । এই গ্রন্থের যুক্তিপর্যায়
দ্বিতীয় অধ্যায় : বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা
সমাজবিন্যাসের ইতিহাস বলিতে হইলে প্রথমেই বলিতে হয় নরতত্ত্ব ও জনতত্ত্বের কথা এবং তাহারই সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিজড়িত ভাষাতত্ত্বের কথা। সেইজন্য বাঙালীর ইতিহাসের গোড়ার কথা বাঙালীর নরতত্ত্বের কথা, বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর ভাষার কথা, বাঙালীর জন, ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির অস্পষ্ট উষাকালের কথা। বাঙালীর আর্যত্ব কতখানি? পণ্ডিতেরা আর্যভাষাভাষী নরগোষ্ঠীর যে একাধিক তরঙ্গের কথা বলেন, যদি তাহা সত্য হয়, তাহা হইলে সেই আর্যত্ন কি ঋগ্বেদীয় আর্যভাষীদের না পামীর মালভূমি ও তবলামাকান মরুভূমি হইতে আগত আলপাইন আর্যভাষীদের নর্ডিক না প্রাচ্য আর্যভাষীদের, না আর কাহারও? আর্যপূর্ব জনদের কাহারা বাঙলাদেশের অধিবাসী ছিলেন; এই আর্যপূর্ব বাঙালীদের মধ্যে নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, বা ভূমধ্যীয় নরগোষ্ঠীর আভাস কতটুকু দেখা যায়, কোথায় কোথায় দেখা যায়? মোঙ্গোলীয় ও ভোট-চীন নরগোষ্ঠীর কিছু আভাস বাঙালীর রক্তে, বাঙালীর দেহগঠনে আছে কি? থাকিলে কতটুকু এবং বাঙলার কোন কোন জায়গায়? আর্য ও আর্যপূর্ব জাতিদের রক্ত ও দেহগঠন বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠনে কতটুকু, কী পরিমাণে সহায়তা করিয়াছে? ঐতিহাসিক কালে ভারতবর্ষের বাহিরের ও ভিতরের অন্যান্য প্রদেশের কোন কোন নরগোষ্ঠীর লোক বাঙলাদেশে আসিয়াছে এবং বাঙালীর রক্ত ও দেহগঠন কতখানি রূপান্তরিত করিয়াছে? বাঙলাদেশে যে বর্ণবিভাগ দেখা যায় তাহার সঙ্গে নরতত্ত্বের সম্বন্ধ কতটুকু?
ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ইত্যাদি বর্ণের লোকেরা কোন নরগোষ্ঠী? সমাজে জলচল ক্ষুদ্রবর্ণের লোকেরা কোন নরগোষ্ঠী? জল-অচল নিম্ন বা অন্ত্যজ পর্যায়ের যে অসংখ্য লোক তাহারাই বা কোন নরগোষ্ঠী? রজক, নাপিত, কর্মকার, সূত্রধর ইত্যাদিরাই বা কে? সব প্রশ্নের উত্তর বাঙলার নরতত্ত্ব-গবেষণার বর্তমান অবস্থায় পাওয়া যাইবে না; তবু, যতটুকু নির্ধারিত হইয়াছে তাহারই বলে মোটামুটি একটা কাঠামো গড়িয়া তোলা যাইতে পারে। বাঙালীর জন-গঠনের এই গোড়াকার কথাটা না জানিলে প্রাচীন বাঙলার শ্রেণী ও বর্ণ বিভাগ, রাষ্ট্রের স্বরূপ, এক কথায় সমাজের সম্পূর্ণ চেহারাটা ধরা পড়িবে না।
তৃতীয় অধ্যায় : দেশ-পরিচয়
বাঙালীর ইতিহাসের দ্বিতীয় কথা, বাঙলার দেশ-পরিচয়। বাঙলাদেশের নদ-নদী পাহাড়প্রান্তর বনজনপদ আশ্রয় করিয়া ঐতিহাসিক কালের পূর্বেই যে সমস্ত বিভিন্ন কোম একসঙ্গে দানা বাধিয়া উঠিতেছিল তাহদের বন্ধনসূত্র ছিল পূর্বভারতের ভাগীরথী-করতোয়া লৌহিত্য-বিধৌত বিন্ধ্য-হিমালয়-বাহুবিধৃত ভূভাগ। এই সুবিস্তীর্ণ ভূভাগের জল ও বায়ু এই দেশের অধিবাসীদিগকে গড়িয়াছে; ইহার ভূমির উর্বরতা কৃষিকে ধনোৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপায় করিয়া রচনা করিয়াছে; ইহার অসংখ্য মৎস্যবহুল নদনদী, তাহাদের শাখা ও উপনদীগুলি অন্তর্বাণিজ্যের সাহায্য করিয়া ধনোৎপাদনের আর একটি উপায় সহজ ও সুগম করিয়াছে। ইহার সমুদ্রোপকূল শুধু যে বহির্বাণিজ্যের সাহায্য করিয়াছে, তাহাই নয়, দেশের কোনও কোনও উৎপন্ন দ্রব্যের স্বরূপও নির্ণয় করিয়াছে। তাহা ছাড়া, এই দেশের প্রাচীন যে রাষ্ট্র ও জনপদ-বিভাগ তাহাও কিছুটা নিণীত হইয়াছে বাঙলার নদ-নদীগুলির দ্বারা। বাঙলার এই নদ-নদীগুলি, এই বন ও প্রান্তর, ইহার জলবায়ুর উষ্ণ জলীয়তা, ইহার ঋতু-পর্যায়, ইহার বিধৌত নিম্নভূমিগুলি, বনময় সমুদ্রোপকূল সমস্তই এই দেশের সমাজবিন্যাসকে কমবেশি প্রভাবান্বিত করিয়াছে। কাজেই বাঙলাদেশের সত্য ভৌগোলিক পরিচয়ও বাঙালীর ইতিহাসেরই কথা।