কিন্তু সুবিধার কথা যদি বলিলাম, অসুবিধার কথাও বলি। আগেই বলিয়াছি জনসাধারণের ইতিহাস-রচনার যে সব উপাদান আমাদের আছে, তাহার অধিকাংশ রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠীর আশ্রয়ে রচিত। রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠী সম্বন্ধে যাহা জ্ঞাতব্য তাহার অনেকাংশ এইসব উপাদানের মধ্যে পাওয়া যায়। কিন্তু সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর যে অগণিত জনসাধারণ তাহদের বা তাহাদের আশ্রয়ে রচিত কোনও উপাদানই আমরা পাই না কেন? যে বণিক-সম্প্রদায় দেশে-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতেন তাহারা মূখ বা নিরক্ষর ছিলেন না, এমন অনুমান সহজই করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সমৃদ্ধি যতদিন ছিল ততদিন সমাজে তাহদের স্থান বেশ উপরেই ছিল, রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনায় তাহদের প্রভুত্বও কম ছিল না; একথা অনুমান-সাপেক্ষ নয়, তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে; তথাপি তাহদের কথা বিশেষভাবে কেহ বলে নাই। শিল্পী ও ক্ষেত্রকর-সম্প্রদায় সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। আর, চণ্ডাল পর্যন্ত যে অকীর্তিত জনসাধারণ তাহদের কথা না-ই বলিলাম। ইহারা তো নিরক্ষরই ছিলেন; সমাজে ইঁহাদের আধিপত্য বা অধিকার বলিয়া কিছু ছিল, এমন প্রমাণও নাই। কাজেই, ইঁহাদের সম্বন্ধে যে বিশেষ কিছু জানি না তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। কিন্তু কি শিল্পী-মানপ-ব্যাপার-বণিক, কি ক্ষেত্রকর, কি নিম্নতম সম্প্রদায়, ইহার রাজসভা বা ধর্মগোষ্ঠী দ্বারা কীর্তিত কিংবা কীর্তনযোগ্য বিবেচিত না হইলেও, ইঁহাদের সকলের দৈনন্দিন সুখদুঃখের, জীবনসমস্যার, নিজের বৃত্তি-সম্পৃক্ত নানা প্রশ্নের, এবং সাফল্য-অসাফল্যের প্রকাশ ও পরিচয় তদানীন্তন বাঙালী সমাজের মধ্যে কোথাও না কোথাও ছিলই। হয়তো সকল শ্রেণীর প্রকাশ ও পরিচয় সমভাবে একত্র কোথাও হইত না; হয়তো বিশেষ শ্রেণীর জীবনধারার প্রকাশ ও পরিচয় শ্রেণীর জনসাধারণের মধ্যেই আবদ্ধ থাকিত। কিন্তু যেভাবেই তাহা হউক, তাহা কোথাও লিপিবদ্ধ হইয়া থাকে নাই; সভাকবি, রাজপণ্ডিত, অভিজাতসমাজপুষ্ট কবি ও লেখক, বা ধর্মগোষ্ঠীর নেতাদের কাছে এইসব প্রকাশ ও পরিচয় লিপিযোগ্য বা গ্রন্থনযোগ্য মর্যাদা লাভ করিতে পারে নাই। স্মৃতি-ব্যবহার-পুরাণ গ্রন্থাদিতে পরোক্ষভাবে কিছু কিছু সংবাদ লিপিবদ্ধ হইয়াছে মাত্র, ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য উচ্চতর বর্ণসমাজের সঙ্গে ইঁহাদের সম্বন্ধ নির্ণয়ের প্রসঙ্গে। তাহা ছাড়া, রাজসভা ও ধর্মগোষ্ঠী উভয়েরই লেখ্য ভাষা ছিল সংস্কৃত; অথচ, এই দেবভাষা যে প্রাকৃতজনের ভাষা ছিল তাহা তো সর্বজনস্বীকৃত; বাঙলার লিপিমালায়ও তাহার প্রমাণ বিক্ষিপ্ত। প্রাচীন বাঙলার প্রাকৃতজনের এই ভাষার বিশেষ কিছু পরিচয় আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই। স্বৰ্গত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়-কর্তৃক আবিষ্কৃত এবং অধুনা সুপরিচিত চর্যাগীতিগুলির ভাষা হয়তো দশম-দ্বাদশ শতকের এই প্রাকৃত ভাষা, কিন্তু সন্ধ্যাভাষায় রচিত এই দোহা ও গানগুলিকে ঐতিহাসিক উপাদানরূপে পুরোপুরি গ্রহণ করা সর্বত্র সম্ভব নয়। ধর্মের ইতিহাসে অবশ্য এই পদগুলির বিশেষ মূল্য আছে। ডাক ও খনার বচনগুলিতেও কিছু কিছু ইতিহাসের উপাদান আছে। পণ্ডিতেরা স্বীকার করেন যে, এই বচনগুলিতে সমাজের যে পরিচয় টুকরা টুকরা ভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তাহা নিঃসংশয়ে খ্ৰীষ্টীয় দশম অথবা একাদশ শতকের, কিন্তু ঐতিহাসিকের বিপদ এই যে, এই বচনগুলি বর্তমানে আমরা যে রূপে পাই, যে ভাষায় বর্তমানে ইহারা আমাদের হাতে আসিয়াছে, সে রূপ ও সে ভাষা এত প্রাচীন নয়। কাজেই মুখে মুখে প্রচলিত বচনগুলি পরবর্তী কালে ক্রমশ যখন লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তখন যে সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িক যুগের সমাজের পরিচয় কিছু কিছু তাহার মধ্যে ঢুকিয়া পড়ে নাই তাহার নিশ্চয়তা কি? শূন্যপুরাণ’, ‘গোপীচাদের গীত’, ‘সেখ শুভোদয়া, আদ্যের গম্ভীরা’, ‘মুর্শিদ্যা গান’, প্রাচীন রূপকথা ইত্যাদি সম্বন্ধেও এই সন্দেহ প্রযোজ্য, যদিও ইঁহাদের বিষয়বস্তু প্রাচীনতর কাল সম্পর্কিত। মধ্যযুগের আরো দুই-চারটি বাঙলা বই সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। আসল কথা হইতেছে, জনসাধারণ প্রাকৃতজনসুলভ ভাব ও ভাষায় তাহাদের দৈনন্দিন জীবনের যে-সব সুখ-দুঃখ, ক্ষুদ্র-বৃহৎ জীবন-সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ করিত গানে-গল্পে-বচনে-গাথায়-রূপকথায়, তাহ কেহ লিখিয়া রাখে নাই; লোকের মুখে মুখেই তাহা গীত ও প্রচারিত হইয়াছে এবং বহুদিন পরে তাহ হয়তো লিপিবদ্ধ হইয়াছে যখন প্রাকৃতজনের ভাষা লেখা-মর্যাদা লাভ করিয়াছে। কিন্তু মুশকিল হইতেছে, এইসব প্রমাণ স্বসম্পূর্ণ স্বয়ংসিদ্ধ প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করিবার উপায় নাই, যতক্ষণ পর্যন্ত সমসাময়িক প্রমাণদ্বারা তাহা সমর্থিত না হয়।
পূর্বেই বলিয়াছি প্রাচীন লিপিমালা এবং কিছু কিছু ধর্ম ও সাহিত্য গ্রন্থই বাঙালীর ইতিহাসের উপাদান এবং ইঁহাদের সাক্ষ্যই প্রামাণিক। এই লিপিগুলি সমস্তই সমসাময়িক; স্মৃতি, পুরাণ, ব্যবহার এবং কাব্য-গ্রন্থগুলিও প্রায় তাহাই। কোথাও কোথাও কিছু কিছু পরবর্তী অথবা পূর্ববর্তী প্রামাণিক লিপি ও গ্রন্থের সহায়তা আমি গ্রহণ করিয়াছি, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত সমসাময়িক প্রামাণিক সাক্ষ্যদ্বারা তাহা সমর্থিত না হইয়াছে ততক্ষণ আমার বক্তব্যের পক্ষে অনুমানের অধিক মূল্য কখনও আমি দাবি করি নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি বাঙলাদেশের সাক্ষ্যপ্রমাণই গ্রহণ করিয়াছি, তবে মাঝে মাঝে কোথাও কোথাও কোনো সাক্ষ্য বা উক্তি সুস্পষ্ট করিবার জন্য প্রতিবেশী কামরূপ অথবা বিহার অথবা ওড়িশার সাক্ষ্য-প্রমাণও উল্লেখ করিয়াছি। সেগুলি প্রমাণ বলিয়া স্বীকৃত না হইলেও একথা অনুমান করিতে বাধা নাই যে, বাঙলাদেশেও হয়তো অনুরূপ রীতি প্রচলিত ছিল।