বস্তুত, সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই প্রকৃত জনসাধারণের ইতিহাস। প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসই এই গ্রন্থের মুখ্য আলোচ্য বলিয়াও ইহার নামকরণ করিয়াছি ‘বাঙালীর ইতিহাস’। রাজা ও রাষ্ট্র এই সমাজবিন্যাসে যতটুকু স্থান অধিকার করে ততটুকুই আমি ইহাদের আলোচনা করিয়াছি। এই সমাজবিন্যাসের বস্তুগত ভিত্তি, সমাজের বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণী, সমাজে ও রাষ্ট্রে তাহদের স্থান, তাহাদের দায় ও অধিকার, বর্ণের সঙ্গে শ্রেণীর ও রাষ্ট্রের সম্বন্ধ, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্বন্ধ, সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি ইত্যাদি সমস্তই প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের, তথা জনসাধারণের ইতিহাসের আলোচনার বিষয়। এই সমাজবিন্যাসের ইতিহাস-রচনার কতকটা পরিচয় পাওয়া যায় জার্মান পণ্ডিত ফিক্ (Fick)- রচিত বুদ্ধদেবের সমসাময়িক উত্তর-পূর্ব ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’- গ্রন্থে (Die Sociale Gielderung in Nordostlichen zu Buddhas Zeit)। অবশ্য, জাতকের অসংখ্য গল্পে এবং প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে তদানীন্তন সমাজবিন্যাসের যে চিত্র আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়, প্রাচীন বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের উপাদানে সে স্পষ্টতা বা সম্পূর্ণতা একেবারেই নাই। তবু, সমাজতাত্ত্বিক রীতিপদ্ধতি অনুযায়ী প্রাচীন বাঙলার ঐতিহাসিক উপাদান সযত্বে বিশ্লেষণ করিলে আজ মোটামুটি একটা কাঠামো গড়িয়া তোলা একেবারে অসম্ভব হয়তো নয়। বর্তমান গ্রন্থে তাহার চেয়ে বেশি কিছু করা হইতেছে না, বোধ হয় সম্ভবও নয়। বাঙলাদেশে ঐতিহাসিক উপাদান আবিষ্কারের চেষ্টা খুব ভালো করিয়া হয় নাই। এক পাহাড়পুর নানাদিক দিয়া প্রাচীন বাঙলার জনসাধারণের ইতিহাসে অভিনব আলোকপাত করিয়াছে; কিন্তু, তেমন উদ্যম অন্যত্র এখনও দেখা যাইতেছে না। বেশির ভাগ উপাদানের আবিষ্কার আকস্মিক এবং পরোক্ষ। তবু, ক্রমশ নূতন উপাদান সংগৃহীত হইতেছে, এবং আজ যাহা কাঠামো মাত্র, ক্রমশ আবিষ্কৃত উপাদানের সাহায্যে হয়তো এই কাঠামোকে একদিন রক্তে-মাংসে ভরিয়া সমগ্র একটা রূপ দেওয়া সম্ভব হইবে।
উপাদান সম্বন্ধে সাধারণ দুই-একটি কথা
সমাজবিন্যাসের অথবা বৃহত্তর অর্থে সামাজিক ইতিহাস রচনার একটা সুবিধাও আছে, রাষ্ট্রীয় ইতিহাস রচনায় যাহা নাই। রাষ্ট্রীয়, বিশেষভাবে রাজবংশের, ইতিহাসে সন-তারিখ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য। কোন রাজার পরে কোন রাজা, কে কাহার পুত্র অথবা দৌহিত্র, কোন যুদ্ধ কবে হইয়াছিল ইত্যাদির চুলচেরা বিচার অপরিহার্য। সন-তারিখ লইয়া সেইজন্য প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস আলোচনায় এত বিতর্ক। এই ইতিহাসে ঘটনার মূল্যই সকলের চেয়ে বেশি এবং সেই ঘটনার কালপরম্পরার উপরই ইতিহাসের নির্ভর। সামাজিক ইতিহাস-রচনায় এই জাতীয় ঘটনার মূল্য অপেক্ষাকৃত অনেক কম; সন-তারিখের মোটামুটি কাঠামোটা ঠিক হইলেই হইল, যদি না। কিছু রাষ্ট্রীয় অথবা সামাজিক বিপ্লব-উপপ্লব সমাজের চেহারাটাই ইতিমধ্যে একেবারে বদলাইয়া দেয়। তাহার কারণ সহজেই অনুমেয়। সামাজিক বর্ণবিভাগ, শ্রেণীবিভাগ, ধনোৎপাদন ও বণ্টন-প্রণালী, জাতীয় উপাদান, ভূমিব্যবস্থা, বাণিজ্যপথ ইত্যাদি, এক কথায় সমাজবিন্যাস রাজা বা রাজবংশের হঠাৎ পরিবর্তনে রাতারাতি কিছু বদলাইয়া যায় নাই; অন্তত প্রাচীন বাঙলায় বা ভারতবর্ষে তাহা হয় নাই। প্রাচীন পৃথিবীতে সর্বত্রই এইরূপ। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৃহৎ কিছু একটা বিপ্লব-উপপ্লব সংঘটিত হইলে সমাজবিন্যাসও হয়তো বদলাইয়া যায়; কিন্তু তাহাও একদিনে, দুই-দশ বৎসরে হয় না। বহুদিন ধরিয়া ধীরে ধীরে এই বিবর্তন চলিতে থাকে, সমাজপ্রকৃতির নিয়মে। অবশ্য, বর্তমান যুগে ভৌতিক বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে এই বিবর্তন অত্যন্ত দ্রুত সংঘটিত হইয়া থাকে। কিন্তু এই সব আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত তাহ ধীরে ধীরেই হইত। আর্যদের ভারতাগমন প্রাচীন কালের একটি বৃহৎ সামাজিক উপপ্লবের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যাইতে পারে। অনার্য অথবা আর্যপূর্ব সমাজবিন্যাস ছিল একরকম, তারপর আর্যেরা যখন তাহদের নিজেদের সমাজবিন্যাস লইয়া আসিলেন, তখন দুই আদর্শে একটা প্রচণ্ড সংঘাত নিশ্চয়ই লাগিয়াছিল। সেই সংঘাত ভারতবর্ষে চলিয়ছিল হাজার বৎসর ধরিয়া, এবং ধীরে ধীরে তাহার ফলে যে নূতন ভারতীয় সমাজবিন্যাস গড়িয়া উঠিয়াছিল তাহাই পরবর্তী হিন্দুসমাজ। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে যখন লৌহধাতুর আবিষ্কার হইয়াছিল, তখনও এইরকমই একটা সামাজিক বিপ্লবের সূচনা হয়তো হইয়াছিল, কারণ এই আবিষ্কারের ফলে ধন-উৎপাদনের প্রণালী বদলাইয়া যাইবার কথা, এবং তাহার ফলে সমাজবিন্যাসও। কিন্তু এই পরিবর্তনও একদিনে হয় না। প্রাচীন বাঙলায় ঐতিহাসিক কালে— প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা আমি বলিব না, তাহার কারণ সে সম্বন্ধে স্পষ্ট করিয়া আমরা এখনও কিছুই জানি না— এমন কোনও সামাজিক উপপ্লব দেখা দেয় নাই। যুদ্ধবিগ্রহ যথেষ্ট হইয়াছে, ভিন্নদেশাগত রাজা ও রাজবংশ বহুদিন ধরিয়া বাঙলাদেশে রাজত্বও করিয়াছেন, মুষ্টিমেয় সৈন্য ও সাধারণ প্রাকৃতজন নানা বৃত্তি অবলম্বন করিয়া এদেশে নিজেদের রক্ত মিশাইয়া দিয়া বাঙালীর সঙ্গে এক হইয়াও গিয়াছেন, কিন্তু এইসব ঐতিহাসিক পরিবর্তন বিপ্লবের আকার ধারণ করিয়া সমাজের মূল ধরিয়া টানিয়া সমাজবিন্যাসের চেহারাটাকে একেবারে বদলাইয়া দিতে পারে নাই। অদল-বদল যে একেবারে হয় নাই তাহা নয়, কিন্তু যাহা হইয়াছে, তাহা খুব ধীরে ধীরে হইয়াছে, এখানে-সেখানে কোন কোন সমাজ-অঙ্গের রং ও রূপ একটু-আধটু বদলাইয়াছে, কোনও নুতন অঙ্গের যোজনা হইয়াছে, কিন্তু মোটামুটি কাঠামোটা একই থাকিয়া গিয়াছে। অদল-বদল যাহা হইয়াছে তাহা প্রাকৃতিক ও সমাজবিজ্ঞানের নিয়মের বশেই হইয়াছে। কাজেই, রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের অজ্ঞাত যুগ সামাজিক ইতিহাসের দিক হইতে একেবারে অজ্ঞাত নাও হইতে পারে। পূর্বের এবং পরের সমাজবিন্যাসের ইতিহাস যদি জানা থাকে তাহা হইলে মাঝখানের ফাকটা কল্পনা ও অনুমান দিয়া ভরাট করিয়া লওয়া যাইতে পারে, এবং তাহা ঐতিহাসিক সত্যের পরিপন্থী না হওয়াই স্বাভাবিক | প্রাচীন বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসেও একথা প্রযোজ্য।