কাজেই, রাজা, রাষ্ট্র, রাজপাদোপজীবী, শিল্পী, বণিক, ব্যবসায়ী, শ্রেষ্ঠী, মানপ, ভূমিবান মহত্তর, ভূমিহীন কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবক, সমাজশ্রমিক, ‘অকীর্তিতান্ আওণ্ডালান্’ প্রভৃতি সকলকে লইয়া প্রাচীন বাঙলার সমাজ। ইঁহাদের সকলের কথা লইয়া তবে বাঙালীর কথা, বাঙালীর ইতিহাসের কথা। এই অর্থেই আমি ‘বাঙালীর ইতিহাস’ কথাটি ব্যবহার করিতেছি। বাঙালী-সমাজও এই বৃহত্তর অর্থেই বুঝিতেছি।
অথচ এই অর্থে বাঙলার অথবা বাঙালীর ইতিহাস সম্বন্ধে মনীষী ঐতিহাসিকেরা সকলেই কিছু একেবারে সজাগ ছিলেন না, এ কথা সত্য নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কথা আগে বলিয়াছি; তাঁহার মন দেশকালধৃত ইতিহাসের এই সমগ্ররূপ সম্বন্ধে সচেতন ছিল বলিয়া মনে হইতেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের বহুদিন পরে আর-এক-বাঙালী ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতেও এই বাঙালীর ইতিহাসের কল্পনা ধরা দিয়াছিল। ‘গৌড়রাজমালা’ গ্রন্থের ভূমিকায় স্বৰ্গত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় মহাশয় লিখিয়াছিলেন, ‘রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়পরাজয়—ইহার সকল কথাই ইতিহাসের কথা। তথাপি কেবল এইসকল কথা লইয়াই ইতিহাস সংকলিত হইতে পারে না। বাঙালীর ইতিহাসের প্রধান কথা—বাঙালী জনসাধারণের কথা।’ এই বাঙালী জনসাধারণের কথা এযাবৎ বাঙলার ইতিহাসে সম্যক কীর্তিত হয় নাই।
২. উপরোক্ত অর্থে বাঙালীর ইতিহাস কেন রচিত হইতে পারে নাই
প্রথম অধ্যায়। ইতিহাসের যুক্তি
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । উপরোক্ত অর্থে বাঙালীর ইতিহাস কেন রচিত হইতে পারে নাই
কেন হয় নাই তাহার কারণ খুঁজিতে খুব বেশি দূর যাইতে হয় না। উনবিংশ শতকের শেষপাদে এবং বিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় পাদে ঐতিহাসিক গবেষণার যে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বাঙলাদেশে, তথা ভারতবর্ষে প্রচলিত সে পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আমরা পাইয়াছি সমসাময়িক যুরোপীয়, বিশেষভাবে ইংরেজি ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণার রীতিপদ্ধতি ও আদর্শ হইতে। এই আদর্শ পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, এবং রাজা ও রাষ্ট্রই এই গবেষণার কেন্দ্র। সামাজিক চেতনা এই আদর্শ ও পদ্ধতিকে উদ্বুদ্ধ করে নাই। স্থলদৃষ্টিতে দেখা যায়, রাষ্ট্রই সকল ব্যবস্থার নিয়ন্ত; যেদিকে তাকানো যায়, সেইদিকেই রাষ্ট্রের সুদীৰ্ঘবাহু বিস্তৃত, ইহাই দৃষ্টি আকর্ষণ করে; এবং সেই রাষ্ট্রও কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা বিশেষ ব্যক্তি-সমষ্টিকেই যেন আশ্রয় করিয়া আছে, ইহাই সর্বজনগোচর হয়। অথচ, সেই রাষ্ট্রের পশ্চাতে যে বৃহত্তর সমাজ এবং সমাজের মধ্যে যে বিশেষ বিশেষ স্বার্থের লীলাধিপত্য তাহা সহজে চোখে ধরা পড়ে না। সমাজবিকাশের অমোঘ নিয়মের বশেই যে রাজা ও রাষ্ট্রের সৃষ্টি এ কথা উনবিংশ শতকের ইংরেজি ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণা স্বীকার করে নাই। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রেও তেমনই তখনও পর্যন্ত ইংলন্ডে এবং যুরোপেও অধিকাংশ পণ্ডিত মহলে ফরাসী বিপ্লবের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের, কার্লাইলের বীর ও বীরপূজাদর্শের বিজয়-পতাকা উড়িতেছে। এদেশে আমরা তাহার অনুকরণ করিয়াছি মাত্র। ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দৃষ্টি সেইজন্যই বিশেষভাবে রাজা ও রাষ্ট্রের দিকেই আকৃষ্ট হইয়াছে, এবং সমাজ সম্বন্ধেও তথ্য যখন আহৃত ও আলোচিত হইয়াছে, তখন সমাজ অত্যন্ত সংকীর্ণ অর্থেই গ্রহণ ও প্রয়োগ করা হইয়াছে। কিন্তু উনবিংশ শতকের তৃতীয় পাদ হইতেই যুরোপের কোথাও কোথাও, বিশেষভাবে অস্ট্রিয়া ও জার্মানীতে, কিছুটা ফরাসী দেশেও, সমাজবিকাশের বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক গবেষণার সূত্রপাত হয়, এবং তাহার ফলে সর্বত্র পণ্ডিতসমাজ এ কথা স্বীকার করিয়া লন যে, ধনোৎপাদনের প্রণালী ও বণ্টন-ব্যবস্থার উপরই বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন কালের বৃহত্তর সমাজ-সংস্থান নির্ভর করে, বিভিন্ন বর্ণ, শ্রেণী ও স্তর এই ব্যবস্থাকে আশ্রয় করিয়াই গড়িয়া ওঠে। এই ব্যবস্থাকে রক্ষণ ও পালন করিবার জন্যই রাজা ও রাষ্ট্র প্রয়োজন হয়; এবং এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করিবার জন্যই একটি বিশেষ সংস্কৃতির উদ্ভব ও পোষণের প্রয়োজন হয়। সমাজ-বিকাশের এই বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা ক্রমশ সমগ্র যুরোপে ছড়াইয়া পড়ে, এবং বিগত প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যেও এই ব্যাখ্যার প্রভাব দেখা দেয়। য়ুরোপে যাহা উনবিংশ শতকের শেষ পদেই আরম্ভ হইয়াছিল, এবং যাহার ঢেউ কতকটা বঙ্কিমচন্দ্রের চিত্ততটে আসিয়া আঘাত করিয়াছিল, বিংশ শতকের প্রথম মহাযুদ্ধের পর হইতে ইংলন্ডেও তাহর প্রবর্তনা দেখা দেয়। ইহার কিছুদিন আগে হইতেই সমাজ, সামাজিক ধন, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের সম্বন্ধ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সংস্কৃতি প্রভৃতির পারস্পরিক সম্বন্ধ ইত্যাদি লইয়া প্রামাণিক গ্রন্থ ইংলন্ডেও রচিত হইতেছিল; কিন্তু জনতত্ত্ব ও সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার প্রসার ও প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই নূতন ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপ ক্রমশ আরো সুস্পষ্ট হইতেছে। আমাদের দেশের ঐতিহাসিক আলোচনা-গবেষণায় এই ইঙ্গিত আজ বিংশ শতকের দ্বিতীয় পাদেও ধরা পড়িল না! এইজন্যই আজ পর্যন্ত বাঙালীর বা ভারতবাসীর যথার্থ ইতিহাস রচিত হইতে পারিল না।