সপ্তম, সে-সমাজের নিম্নতর কৃষিজীবী স্তরগুলি ছিল একান্ত অবজ্ঞাত, হতচেতন ও সংকীর্ণ; যে-সব উচ্চতর স্তরের হাতে ছিল রাষ্ট্র ও সমাজের নায়কত্ব তাহদের দৃষ্টিপরিধির মধ্যে এই স্তরগুলির কোনো স্থান ছিল না। স্বভাবতই সে-জন্য রাষ্ট্র ও সমাজ-নায়কদের প্রতি তাহদের কোনো বিশ্বাস ও আন্তরিক শ্ৰদ্ধা ছিল না, সচেতন দায়িত্ববোধও ছিল না। গুহ্য রহস্যময় গোপন ধৰ্মসম্প্রদায়গুলি সম্বন্ধেও এ-কথা সমান প্রযোজ্য। কাজেই ইহুদের মধ্যে বিপ্লব-বিদ্রোহের একটা বীজ সুপ্ত থাকিবে ইহা কিছু অস্বাভাবিক নয়। হয়তো সুনিহিত সুষুপ্ত এই বীজটি সম্বন্ধে ইহাদের মধ্যে কোনো সচেতনতা ছিল না; জল ঢালিয়া, উত্তাপ সঞ্চার করিয়া সেই বীজ হইতে গাছ জন্মাইয়া ফুল ও ফল ফলাইবার মত সচেতন নেতৃত্ব কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণী গ্রহণও করে নাই; করিলে কী হুইত বলা যায় না। বস্তুত, শ্রেণী-হিসাবে শ্রেণীচেতন ছিল না বলিয়া নেতৃত্ব দিবার মত শ্রেণী গড়িয়াও উঠে নাই। একটা বৃহৎ গভীর ব্যাপক সামাজিক বিপ্লবের ভূমি পড়িয়াই ছিল; কিন্তু কেহ তাহার সুযোগ গ্রহণ করে নাই। মুসলমানেরা না আসিলে কিভাবে কী উপায়ে কী হইত, বলিবার উপায় নাই। যাহা অনুকূল অবস্থায় একটা সামাজিক বিপ্লবের রূপ গ্রহণ করিতে পারিত তাহাই মুসলমানের রাষ্ট্ৰীয় অধিকার পাওয়ার ফলে অন্যতার খাতে বহিতে আরম্ভ করিল। এ-সমস্ত কথাই এই গ্রন্থের যথাস্থানে সবিস্তারে প্রমাণ-প্রয়োগ সহকারে বলিয়াছি; এখানে সংক্ষেপে ইঙ্গিতগুলি তুলিয়া ধরিলাম মাত্র।
কিন্তু ক্ষয় ও ক্ষতির কথা যদি বলিলাম, লাভের দিকটার কথাও বলি। যে গুহা রহস্যময় গোপন সম্প্রদায়গুলির কথা একটু আগেই বলিয়াছি তাহাদের মধ্যে সমাজের একটা শক্তিও প্রচ্ছন্ন ছিল। সে-শক্তি মানবতার এবং সাম্যভাবনার শক্তি। পুনরুক্তি করিবার প্রয়োজন নাই যে, এই ধৰ্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে, বিশেষভাবে সহজযানী প্রভৃতি বৌদ্ধ ও নাথসম্প্রদায় প্রভৃতির মধ্যে মানুষের বর্ণ ও শ্রেণীগত বিভেদ-ভাবনা প্রায় ছিল না বলিলেই চলে। তাহা ছাড়া, মানবতার একটা উদার আদর্শও ছিল ইহাদের মধ্যে সক্রিয়। এই উদার সাম্যম্ভাবনা ও মানবতার আদর্শের স্থান সমসাময়িক, অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শতকের ব্রাহ্মণ্য সমাজদর্শ ও সংস্থার মধ্যে কোথাও ছিল না। অথচ, ইহার, অর্থাৎ এই সাম্যম্ভাবনা ও মানবতার আদর্শেরও উপরই মধ্যযুগীয় বাঙলার বৃহত্তম ও গভীরতম ধর্ম ও সমাজ-বিপ্লবের অর্থাৎ চৈতন্যদেব প্রবর্তিত সমাজ ও ধর্মন্দােলনের প্রতিষ্ঠা। বস্তুত, দেশে দেশে যুগে যুগে মুক্ত মানব ও আদর্শের জন্যই সংগ্ৰাম করিয়াছে, এখনও করিতেছে, ভবিষ্যতেও করিবে। এই আদর্শেই মধ্যপর্বের হাতে আদিপর্বের শ্রেষ্ঠতম, বৃহত্তম উত্তরাধিকার।
লাভ ও শক্তির দিক
দ্বিতীয় উত্তরাধিকার, ভূমিনির্ভর, কৃষিনির্ভর সমাজ। ঐকান্তিক ভূমি ও কৃষিনির্ভরতার দুর্বলতার কথা নানাসূত্রে বলিয়াছি ; কিন্তু তাহার একটি গভীর শক্তিও আছে, এবং সে-শক্তি অনস্বীকার্য। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামকেন্দ্ৰিক কৃষিনির্ভর সমাজ প্রায় অনড়, অচল; তাহার জীবনের মূল মাটির গভীরে। সে-সমাজের সংস্কৃতি সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য। বিশেষভাবে যে-সমাজে যতদিন পর্যন্ত গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিই ধনোৎপাদনের একমাত্র বা অন্তত প্রধানতম উপায় সেখানে ততদিন পর্যন্ত সেই জীবন ও সংস্কৃতির কোনো পরিবর্তন ঘটানো সহজে সম্ভব নয়—যদি উৎপাদন পদ্ধতির বিবর্তন কিছু না ঘটে, এবং তেমন বিবর্তন প্রাচীন বাঙলায় কিছু ঘটে নাই। এই শক্তির বলেই ভারতীয়, তথা বাঙলার সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা আজও অক্ষুঃ, এবং এই শক্তিই জনসাধারণকে রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন, রাজবংশের সৃষ্টি ও বিলয়, যুদ্ধবিগ্রহ, ধর্মের ও সমাজের সংঘাত প্রভৃতি উপেক্ষা করিয়া নিজের দৈনন্দিন জীবনযাপন করিবার ক্ষমতা ও বিশ্বাস যোগাইয়াছে।
তৃতীয় উত্তরাধিকার, শক্তিধর্মের দিকে বাঙালীর ক্রমবর্ধমান আকর্ষণ। এ-তথ্য লক্ষণীয় যে, আদিপর্বের শেষের দিক হইতেই দুর্গা, কালী ও তারার প্রতিপত্তি বাড়িতেছিল, এবং এই তিন দেবীই যে শক্তির আধার, ঘনায়মান অন্ধকারে ইহায়াই যে একমাত্ৰ আশা ও ভরসা এ-বিশ্বাস যেন ক্রমশ বাঙালীচিত্তকে অধিকার করিতেছিল। বস্তুত, এই সময় হইতেই বাঙলায় ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ সাধনায় তান্ত্রিক শক্তিধর্মের প্রাধান্য সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে। ইহাও লক্ষ্য করিবার মত যে, মুসলমানাধিকারের কিছুকাল পরই শক্তিসাধক বাঙালীর অন্যতম বেদ কালিকাপুরাণ রচিত হয় এবং শক্তিময়ী কালী বাঙালীর অন্যতম প্রধান উপাস্যা দেবীরূপে প্রতিষ্ঠিতা হন। এয়োদশ-চতুর্দশ শতকের বাঙলার অন্যতম শ্মশানে কালীর উপাসনা করিয়াই বাঙালী ভয়-ভাবনার কিছুটা উর্ধের্ব উঠিতে, চিত্তে একটু সাহস ও শক্তি সংগ্ৰহ করিতে চেষ্টা করিয়াছে। এই কালীই তাহার চণ্ডী, এবং সমস্ত মধ্যপর্বে চণ্ডীর প্রতাপ দুৰ্জয়!
চতুর্থ উত্তরাধিকার, সৃজ্যমান বাঙলাভাষা। ক্রমবর্ধমান এই ভাষাই একদিক দিয়া ধীরে ধীরে জনসাধারণের মনকে মুক্তি দিতে আরম্ভ করিল। সংস্কৃতের সুদৃঢ় প্রাচীর যখন শিথিল হইল তখন জনসাধারণ আপন ভাষার মাধ্যমেই তাহদের চিস্তাভাবনা স্বপ্নকল্পনাকে রূপদান করিবার একটা সুযোগ পাইল। বস্তুত, বাঙলার ইতিহাসে এই সর্বপ্রথম দেশের লোক দেশী ভাষায় আপন প্রকাশ খুঁজিয়া পাইল ; ব্যাপকভাবে জনসাধারণের মন ও হৃদয়ের কথা শোনা গেল। মধ্যপর্বের গোড়ায় সেইজন্যই এই ভাষার প্রতি ব্ৰাহ্মণ এবং গোড়া ব্ৰাহ্মণ্য সমাজের একটা বিরাগ ও বিরোধিতা সক্রিয় ছিল, এবং সেই কারণেই এই ভাষার প্রতি মুসলমান রাষ্ট্রশক্তি কিছুটা আকৃষ্ট হইয়াছিল। এই ভাষাই মধ্যপর্বে বাঙালীর অন্যতম প্রধান শক্তিরূপে বিবর্তিত হইল।