আদিপর্বের বাঙালী যে-উত্তরাধিকার তাহার মধ্যপর্বের বংশধরদের হাতে তুলিয়া দিয়া গেল। তাহার মধ্যে প্রধান ও প্রথম উত্তরাধিকার এই চরিত্র ও জীবনদর্শন। মধ্যপর্বে ইতিহাসের আবর্তনে এই চরিত্র ও জীবনদর্শনের কোন দিকে কতখানি অদল বদল হইবে সেই আলোচনা আদিপর্বে অবাস্তুর, কিন্তু এই উত্তরাধিকার লইয়াই মধ্যপর্বের যাত্রারম্ভ, এ-কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
সদ্যোক্ত চরিত্রও জীবনদর্শন ছাড়া আর যাহা উত্তরাধিকার তাহা এক এক করিয়া তালিকাগত করা যাইতে পারে। ক্ষতির ও ক্ষয়ের অঙ্কের দিকটাই আগে বলি।
ক্ষতি ও দুর্বলতার দিক
মুহম্মদ বখতইয়ারের সফল নবদ্বীপাভিযানের ফলে গৌড়ে ও রাঢ়ে মুসলিম-আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হইল, সন্দেহ নাই; সঙ্গে সঙ্গে এ-তথ্যও নিঃসন্দেহে যে, পূর্ববঙ্গে স্বাধীন সেনবিংশ আরও প্রায় সার্ধশতাব্দী কলেরও বেশি রাজত্ব করিয়াছিলেন; তাহা ছাড়া, ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্বাধীন, এবং গৌড়ে-রাঢ়ে ও দেশের অন্যত্র প্রায় স্বাধীন সমস্ত হিন্দু রাজবংশের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আধিপত্য বহুদিন পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। কেশবসেন বোধহয় একাধিকবার যবন-রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধও করিয়া থাকিবেন। কিন্তু যে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা এবং তাহার চেয়েও বড় কথা, বাঙালী ও বাঙলাদেশ যে সর্বব্যাপী মহতী বিনষ্টির সম্মুখীন হইয়াছিল। সেই পরাধীনতা ও বিনষ্টির স্থাত হইতে বাচিতে হইলে যে চরিত্রবল, যে সমাজশক্তি এবং সুদৃঢ় প্রতিরোধ-কামনা থাকা প্রয়োজন সমসাময়িক বাঙালীর তাহা ছিল না। কারণ, দ্বাদশ শতকের বাঙলাদেশ পরবর্তী দুই শতকের হাতে যে-সমাজবিন্যাস উত্তরাধিকার স্বরূপ রাখিয়া গেল সেই সমাজ জাতি-বর্ণ এবং অর্থনৈতিক শ্রেণী উভয় দিক হইতেই স্তরে স্তরে অসংখ্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত; প্রত্যেকটি স্তর ও স্তরাংশ সুদৃঢ় প্রাচীরে নিশ্চিছদ্র করিয়া গাথা; এক স্তর হইতে অন্য স্তরে যাতায়াতে প্রায় দুর্লঙ্ঘ বাধা, এক স্তর স্তরের প্রতি অবিশ্বাস্যপরায়ণ, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একের স্বাৰ্থ অন্যের পরিপন্থী।
দ্বিতীয়ত, সে-সমাজের চরিত্র শিথিল। ব্যাপক সামাজিক দুর্নীতির কীট ভিতর হইতে সামাজিক জীবনের সমস্ত শাস ও রস শুষিয়া লইয়া তাহাকে ফাঁপা করিয়া দিয়াছিল। তখন রাষ্ট্রে, ধর্মে, শিল্পে, সাহিত্যে, দৈনন্দিন জীবনে যৌন অনাচার নির্লজ্জ কর্মপরায়ণতা, মেরুদণ্ডহীন ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাসঘাতকতা, রুচিতারল্য এবং অলংকারবাহুল্যের বিস্তার।
তৃতীয়ত, সে-সমাজ একান্তভাবে ভূমি ও কৃষিনির্ভর, এবং সেই হেতু উচ্চস্তরে ছাড়া বৃহত্তর বাঙালী সমাজ সাধারণভাবে দরিদ্র, এবং যেহেতু তাহার বিত্তশক্তি পরিমিত সেই হেতু বৃহত্তর সমাজের উদ্ভাবনী শক্তিও দুর্বল, জীবনের উৎসাহ ও উদ্দীপনা শিথিল।
চতুর্থত, সে-সমাজ, বিশেষত তাহার উচ্চতর স্তরগুলি একান্তভাবে ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন। এই আচ্ছন্নতায় দোষ ছিল না। যদি সেই ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টি প্রাগ্রসর সৃষ্টিপ্রেরণায় উদ্ধৃদ্ধ হইত। কিন্তু সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টি ধর্মশাস্ত্রের সুদৃঢ় বিধিবিধানে আঁটি করিয়া বাধা; সে-দৃষ্টি রক্ষণশীল এবং চলচ্ছক্তিহীন, অর্থহীন আচার বিচারের মরুবালিরাশির মধ্যে তাহা পথ হারাইয়াছে; অথচ, সামাজিক নেতৃত্বের বল্গার একটা রসি তাঁহাদেরই হাতে; আর একটা দিক রাজা বা রাষ্ট্রের হাতে এবং সেই রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত প্রভূতিদেরই প্রাধান্য। যাহারা এই সব ধর্মশাস্ত্রের রচিয়তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাহারাই আবার প্রধান রাজকর্মচারী।
পঞ্চমত, সে-সমাজ একান্তই ভাগ, অর্থাৎ জ্যোতিষনির্ভর; এবং যেহেতু ভাগ্যনির্ভর সেই হেতু সেই সমাজে প্রতিরোধের ইচ্ছা ও শক্তি অত্যন্ত শিথিলী, প্রায় নাই বলিলেই চলে। সমসাময়িক বাঙলার রাজা ও প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীরা অনেকেই নিজেরা জ্যোতিষ চর্চা করিতেন, দিনক্ষণ না দেখিয়া ঘর ছাড়িয়া এক পা বাহির হইতেন না; রাজসভার এবং উচ্চতর বর্ণ ও শ্রেণীর এই ভাগ্যনির্ভর মনোবৃত্তি ধীরে ধীরে বৃহত্তর সমাজদেহে বিস্তারিত হইয়া এবং দেশের সমস্ত সংগ্রাম ও প্রতিরোধকামনার মুলোচ্ছেদ করিয়া দিয়াছিল। মুসলমানাধিপত্যের সূচনা ও ক্রম বিস্তারকে দেশ ভাগ্যের অমোঘ লিখন বলিয়াই গ্ৰহণ করিতে শিখিয়াছিল; কাজেই প্রতিরোধ নিরর্থক!
যষ্ঠত, সে-সমাজে অসংখ্যা নরনারী ছিলেন যাঁহাদের ধর্মমত ও পথ এবং ধর্মের আচারানুষ্ঠান প্রভৃতি ছিল সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্য সমাজদার্শের পরিপন্থী। এই সৰ্ব্ব নরনারী এমন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন বাধ্য হইয়াই যাঁহাদের জীবনযাত্রা ছিল গোপন; লোকচক্ষুর অন্তরালে রাত্রির অন্ধকারে ছিল তাঁহাদের যত ক্রিয়াকর্ম। গুহ্য, গোপন, রহস্যময় ছিল বলিয়াই ইঁহারা অনেকের চিত্তকে আকর্ষণও করিতেন। এই ধরনের গুহ্য, গোপন, গোষ্ঠী সকল দেশে সকল কালেই সমাজশক্তির অন্যতম প্রধান দুর্বলতা, কারণ যে-শক্তি সমাজের নায়কত্ব করিতেছে তাহাকে দুর্বল করাই ইহাদের অন্যতম উদ্দেশ্য। কিন্তু, এই সব গুহ্য, গোপন গোষ্ঠীগুলির যে ধর্মমত ও পথ তাহা কোনো সামাজিক বা অর্থনৈতিক মুক্তির বাণী বহন করিয়া আনে নাই; কাজেই সামাজিক দিক হইতে এইসব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের বৈপ্লবিক সক্রিয়তা বিশেষ কিছু ছিল না। তাহা ছাড়া, গুহ্য রহস্যময় গোপনতার আড়ালে এই সব সম্প্রদায়ের ভিত্তির ও বাহিরে নানাপ্রকারের অসামাজিক যৌন আচারানুষ্ঠান এবং ধর্মের নামে নানা ব্যভিচারও বিস্তৃত লাভ করিতেছিল। তাহাও ভিতর হইতে সমাজকে পঙ্গু ও দুর্বল করিয়া দিয়াছিল, সন্দেহ কী?