অরূপের ধ্যান ও বিশুষ্ক বন্ধ্যা জ্ঞান-সাধনায় বাঙালীর অরুচি।
বেদান্ত চর্চায় বাঙালীর বিরাগ
বস্তুত অরূপের ধান এবং বিশুষ্ক জ্ঞানময় অধ্যাত্ম সাধনার স্থান বাঙালী চিত্তে স্বল্প ও শিথিল। বাঙালী তাহার ধ্যানের দেবতাকে পাইতে চাহিয়াছে রূপে ও রসে মণ্ডিত করিয়া; তাঁহর সন্ধান বিশুদ্ধ বিশুষ্ক জ্ঞানের পথে ততটা নয় যতটা রূপের ও রসের পথে, অর্থাৎ বোধ ও অনুভবের পথে। প্রাচীন বাংলার ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধ প্রতিমা-শিল্পে, যে-সব ধর্মকে বাঙালী হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করিয়াছে সেই সব ধর্মের মধ্যে এবং যে-ভাবে গ্রহণ করিয়াছে তাহার মধ্যে এই উক্তির প্রমাণ প্রত্যক্ষ। বাঙালীর ভক্তি যে জ্ঞানানুগ নয়, হৃদয়ানুগ, আবেগপ্রধান, তাহা সম্পষ্ট ধরা পড়িয়াছে বাঙালী কবির দেবস্তুতি রচনায়, তাহা সদুক্তিকর্ণামৃতেই হউক, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় বা প্রাকৃতপৈঙ্গলেই হোক, রাজকীয় লিপিমালায়ই হোক আর সাধনস্তোত্রেই হোক। আর, প্রাচীন বাংলার প্রতিমাশিল্পের ইন্দ্ৰিয়ালুতা এবং আবেগবাহুল্য তো একান্তই সুস্পষ্ট। সে-শিল্পসাধনা একান্তই রূপের ও রসের সাধনা। লোকায়াত ধর্মের আচারানুষ্ঠান সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে; সে-ক্ষেত্রে তো অরূপ ও বিশুষ্কজ্ঞান-সাধনার কোনো প্রশ্নই উঠিতে পারে না। আর, মহাযান হইতে বিবর্তিত যত ধৰ্মমত ও পথ তাহদের সব ক’টির সাধনা তো একান্তই রূপ ও রসাশ্রয়ী। এ-তথ্য লক্ষণীয় যে, বিশুদ্ধ মহাযানী বিজ্ঞানবাদ বা মধ্যমিক দর্শন বাংলাদেশে বিশেষ প্রসার লাভ করিতে পারে নাই! ব্ৰাহ্মণ্য সাধনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সেই সব মত ও পথই চিত্তের নিকটতর করিয়া গ্রহণ করিয়াছে যাহার প্রধান আশ্রয় রূপ ও রস, অর্থাৎ পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্য ধর্ম ও ভাবকল্পনার ধারা। ঠিক এই কারণেই বেদান্ত চর্চায় এবং বৈদাস্তিক সাধনায় প্রাচীন বাঙালীর যেন অরুচি। ইহার অর্থ এ-নয় যে, বেদ-বেদান্তের চর্চা ও সাধনা বাংলাদেশে একেবারে ছিল না; ছিল বই কি, লিপিমালায় কিছু কিছু প্রমাণও আছে। কিন্তু সে-চৰ্চা ও সাধনা বাংলাদেশে সমাদৃত হয় নাই, প্রতিষ্ঠাও লাভ করিতে পারে নাই। বেদান্ত ও ন্যায়বৈশেষিক দর্শনের চর্চায় শুকশিষ্য, শঙ্করাচার্যের পরামগুরু গৌড়পাদ, ন্যায়কন্দলী রচয়িতা শ্ৰীধরভট্ট, উদয়ন প্রভৃতি কয়েকজন প্রখ্যাত পণ্ডিত অল্পবিস্তুর সর্বভারতীয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই; কিন্তু এ-তথ্য লক্ষণীয় যে, গৌড়পাদকারিকা সাংখ্যকারিকা বা ন্যায়কন্দলী বাংলাদেশে সমাদর লাভ করে নাই। ন্যায়কন্দলীর মত গ্রন্থের একটি টীকাও যে বাংলাদেশে রচিত হয় নাই, এ-তথ্যের ইঙ্গিত লক্ষণীয়। তাহা ছাড়া, প্ৰবোধচন্দ্ৰোদয়-নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে আছে, দক্ষিণ-রাঢ়িবাসী জনৈক ব্ৰাহ্মণ কাশীতে গিয়া সেখানে বেদান্তচর্চার বাহুল্য দেখিয়া বিদ্রুপ করিয়া বলিতেছেন, প্রত্যক্ষাদি প্রমাণ দ্বারা অসিদ্ধ বিরুদ্ধার্থজ্ঞাপক বেদান্ত যদি শাস্ত্ৰ হয়, তাহা হইলে বৌদ্ধারা কী অপরাধ করিল! মীমাংসার চর্চাও বাংলাদেশে হইত; শ্ৰীধরভট্ট, উদয়ন, অনিরুদ্ধ, ভবদেব-ভট্ট, হল্যায়ুধ প্রভৃতির নাম তো ভারত প্ৰসিদ্ধ। অনিরুদ্ধ ও ভবদেব দুইজনই কুমারিল ভট্টের মীমাংসা সম্বন্ধীয় মতামতের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। তাহার উপর গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে, মীমাংসা সম্বন্ধীয় গ্রন্থ বাংলাদেশে বেশি। রচিত হয় নাই; এবং গৌড়মীমাংসক বলিতে উদয়ন শুধু শ্ৰীধরভট্টকেই চিহ্নিত করিয়া থাকুন আর গৌড়ীয় মীমাংসাশাস্ত্ৰজ্ঞ সকল পণ্ডিতকেই বুঝাইয়া থাকুন, উদয়ন ও গঙ্গেশ উপাধ্যায় যে বলিতেছেন, গৌড়মীমাংসক যথার্থ বেদজ্ঞানবিরহিত ছিলেন, এ-তথ্যের ইঙ্গিত একেবারে নিরর্থক নয়। বস্তুত, শুধু ধর্মসাধনায় নয়, ব্যাপকভাবে অধ্যাত্মিসাধনার ক্ষেত্রে বিশুষ্ক, যুক্তিধর্মী, বন্ধ্যা জ্ঞানচর্চা বাঙালীর চিত্তকে সমগ্রভাবে আকৃষ্ট করিতে পারে নাই।
বাঙালীর সৃজন প্রতিভার মূল উৎস। শক্তি ও দুর্বলতা
অথচ, প্রাচীন বাঙালী নিছক জ্ঞানের চর্চা করে নাই, বুদ্ধির অস্ত্ৰে শান দেয় নাই, এ-কথাও সত্য নয়। মহাযান বৌদ্ধ ন্যায়ের চর্চায় বাংলাদেশ সর্বভারতীয় খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। ব্যাকরণ চর্চা, অভিাধান চর্চা, চিকিৎসা বিদ্যা ও ধর্মশাস্ত্র চর্চা ও রচনায় সর্বভারতীয় বিদ্যার ভাণ্ডারে প্রাচীন বাংলাদেশের দান তুচ্ছ করিবার মতো নয়। ন্যায়, ব্যবহার ও ধর্মশাস্ত্ৰ, ব্যাকরণ ও অভিধান চর্চা তো একান্তই নিছক জ্ঞান ও যুক্তিক্ষমতার চর্চা এবং সেই ক্ষমতার বলেই প্রাচীন বাঙালীর বুদ্ধি একটা শাণিত দীপ্তিও লাভ করিয়াছিল, যে-দীপ্তি ধরা পড়িয়ছে। ন্যায়ের তর্কে, ধর্ম ও ব্যবহার শাস্ত্রের যুক্তিতে, ব্যাকরণের ও অভিধানের নূতন ও মৌলিক সত্র রচনায়। সে-দীপ্তিই দেখিতেছি। মধ্যযুগে নব্যান্যায়ের চর্চায় এবং সাধারণভাবে বাঙালীর ন্যায় ও ব্যবহারকুশলতায়। কিন্তু আসল কথা হইতেছে, বাঙালী তাহার এই বৃদ্ধির দীপ্তিকে সৃষ্টিকার্ষে নিয়োজিত করে নাই। যেখানে জীবনকে গভীরভাবে স্পৰ্শ করিয়া নবতর গভীরতর জীবনসৃষ্টির আহবান সেখানে, অর্থাৎ শিল্প ও সাহিত্য-সাধনায়, ধর্ম ও অধ্যাত্ম-সাধনায় সে মননের উপর নির্ভর করে নাই, বুদ্ধি ও যুক্তির নৌকায় ভর করে নাই। বরং সেখানে সে আশ্রয় করিয়াছে তাহার সহজ প্রাণশক্তি, হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতাকে, এবং ইহাদেরই প্রেরণায় উদ্ধৃদ্ধ হইয়া সে যাহা সৃষ্টি করিয়াছে তাহা বৃদ্ধিকে তত উদ্রিক্ত করে না যতটা স্পর্শ করে হৃদয়কে, প্রাণকে। এই প্ৰাণধর্ম, হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতাই বাঙালীর সৃষ্টি-প্রতিভার মূল, ইহারাই তাহার শক্তি, ইহারাই আবার তাহার দুর্বলতাও।
০৯. প্রাচীন বাঙালীর সৃষ্টির ধারায় গভীর মনন, প্রশস্ত ভাবনা-কল্পনার অভাব
প্রাচীন বাঙালীর সৃষ্টির ধারায় গভীর মনন, প্রশস্ত ভাবনা-কল্পনার অভাব