বাঙালীর দায়াধিকার ও স্ত্রীধন
বাঙলার ব্যবহার-শাস্ত্ৰে দায়াধিকারের যে আদর্শ ও ব্যবস্থা বিশেষ ভাবে স্ত্রী-ধনের যে স্বীকৃতি ও বিধিব্যবস্থা জীমূতবাহনের দায়ভাগ-গ্রন্থে বর্ণিত এবং পরে রঘুনন্দন কর্তৃক ব্যাখ্যাত ও সমর্থিত তাহার পশ্চাতেও মাতৃতান্ত্রিক সমাজের এবং সেই পরিবার-বন্ধনের স্মৃতি বহমান। আর্য সমাজ ও পরিবার-ব্যবস্থার দায়ভাগ ব্যবস্থার প্রচলন নাই; সেখানে মিতাক্ষরার রাজত্ব।
০৭. মানবতার প্রতি প্ৰাচীন বাঙালীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ
যে হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার কথা এই মাত্র বলিলাম তাহারই রূপান্তরে পাইতেছি মানবতার প্রতি প্রাচীন বাঙালীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। এই যে দেবদেবীদেরও মাটির ধূলায় নামাইয়া পরিবার-বন্ধনের মধ্যে বাধিয়া তাহাদিগকে ইহগত মানবিক আবেগে দেখা ও পাওয়া, ইহার মধ্যে তো উষ্ণ মানবপ্রীতির আভাসই সুস্পষ্ট। সদুক্তিকর্ণামৃত, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়, প্রাকৃতপৈঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থে বাঙালীকবিকুল রচিত হরিভক্তি, গঙ্গাস্তব, শিবস্তোত্র প্রভৃতি বিষয়ক যে-সব শ্লোক ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং যাহাদের দুই-একটি এই গ্রন্থে উদ্ধার করিয়াছি তাহাদের বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগ একান্তই মানবিক রসে অভিসঞ্চিত। এই গ্রন্থগুলির বাঙালী কবি রচিত অসংখ্য প্রকীর্ণ শ্লোকে সাধারণ মানুষের সুখদুঃখের ও আনন্দবেদনার যে সূক্ষ্ম স্পর্শালু বোধ সুস্পষ্ট গোচর, চর্যাগীতির গুহ্য সংকেতময় অধ্যাত্ম পদগুলিতেও সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের নানা মানবী লীলার যে-পরিচয় তাহার মধ্যেও তো একই মানবিক আবেদন সমান প্রত্যক্ষ। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মৃৎফলকগুলি সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে, এবং কোনও কোনও প্রতিমা-ফলক সম্বন্ধেও। বাঙলার প্রতিমা-লক্ষণ শাস্ত্রশাসিত প্রতিমাশিল্পেও মানসিক ইন্দ্ৰিয়ালুতা এবং হৃদয়াবেগ যতটা ধরা পড়িয়াছে, এমন যেন আর কোথাও নয়। ধৰ্মগত এবং শাস্ত্রশাসিত ব্যাপারেও একান্ত মানবিক রসের সঞ্চার, মানবিক আবেগ ও আবেদনের অভিসিঞ্চন প্রাচীন বাঙলার সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন ভারতের অন্যান্য প্রান্তের সুবিস্তৃত সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যের অনেক স্থানে এই ধরনের মানবিক আবেদন প্রত্যক্ষ, বিশেষ ভাবে মহাভারতের নানা কাহিনীতে, ভাস ও কালিদাসের রচনায়। কিন্তু প্ৰাচীন বাঙলার ধর্মকর্মে শিল্পে ও সাহিত্যে এই মানবিক আবেদন যতটা বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট, সেখানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাট সুখদুঃখের প্রতিও গভীর অনুরাগ যে-ভাবে ধরা পড়িয়ছে, এমন আর কোথাও যেন নয়। বস্তুত, বাঙলার সাধনায় দেবতারা ধরা দিয়াছেন মানুষের বেশে, মানুষের মতো হইয়া; মানুষের মাপেই যেন দেবতার পরিমাপ। তাহার প্রমাণ এই গ্রন্থেই নানা স্থানে নানা সূত্রে সংগ্ৰহ করা হইয়াছে। মানবিকতার প্রতি বাঙালী চিত্তের এই আকর্ষণের আভাস প্রাচীন কালেই নানাদিকে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল।
মানবতার প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ উপনিষদ্ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বৈষ্ণব ভাগবদ্ধর্মেও এই শ্রদ্ধা ও অনুরাগের ধারা বহমান। মহাভারতেও তাঁহাই; সেখানে তো স্পষ্টই বলা হইয়াছে, মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর জীব আর কেহ নাই। কিন্তু সাধারণ ভাবে ও সামগ্রিক দৃষ্টিতে আর্য ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতি সাধনায় সর্বশ্রেষ্ঠ জীব এই মানুষের স্থান প্রধানত গৌণ। দেবতা ও শাস্ত্র সেখানে মানুষের প্রায় সমস্ত চিত্ত জুড়িয়া বিস্তৃত। যাহাই হউক, বাঙলাদেশে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে এবং বাঙালীর ধর্ম ও অধ্যািত্মসাধনায় মহাভারতের বাণী যেন আবার নূতন করিয়া শোনা গেল এবং সাধক কবি চণ্ডীদাসের কণ্ঠে তাহা মূর্তিলাভ করিলা : ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। কিন্তু চণ্ডীদাস বলিলেন সেই কথাই যাহা ছিল প্রাচীন বাঙালীর চিত্তের গভীরে, তাহার সাধনায়, বিশেষভাবে সহজযানী সিদ্ধাচার্যদের আদর্শ ও ভাবকল্পনায়। এই সিদ্ধাচার্যরা বর্ণ, শ্রেণী, ধর্ম ও আচারানুষ্ঠানের ভেদাভেদের উর্ধে মানুষের যে মানবমহিমা তাহার সুস্পষ্ট ঘোষণা জানাইয়াছেন। বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, আগম কোনও কিছুরই অভ্রান্ততায় ইহারা বিশ্বাস করিতেন না। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, মহাযান, মন্ত্রযান, জৈনধর্ম, নাথধর্ম কোনও কিছুতেই ইহাদের শ্রদ্ধা ছিল না; যোগী-সন্ন্যাসীদের প্রতি ছিল ইহাদের নিদারুণ অবজ্ঞা! বৈরাগ্য ইহারা সাধন করিতেন না, বলিতেন বিরাগাপেক্ষা পাপ আর কিছু নাই, সুখ অপেক্ষা পুণ্য নাই। শরীরের মধ্যেই অশরীরীর গুপ্তলীলা, এই মানবদেহেই মোক্ষের বাস, মানুষই সকল সাধনার পরমাদর্শ, পরমাশ্রয়। ভবিষ্য-পুরাণের ব্রাহ্মখণ্ডেও জাতিভেদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ যুক্তি দিয়া জাত-বর্ণের উর্ধের্ব মানুষের আপন মহিমারই জয়গান করা হইয়াছে। বজ্ৰসুচিকোপনিষদেও একুই ঘোষণা। দোহাকোষের টীকায় তো সুস্পষ্টই বলা হইয়াছে, সকল লোকই একজাতি, ইহাই সহজ ভাব। এই জাতি যে মানবজাতি তাহাতে আর সন্দেহ কি!
০৮. বাঙালী চিত্তের নীরস বৈরাগ্যবিমুখতা
এই উদার মানবতারই অন্যতম দিক হইতেছে। প্রাচীন বাঙালীর ঐহিক বস্তুনিষ্ঠ, মানবদেহের। প্রতি এবং দেহাশ্রয়ী কায়সাধনার প্রতি অপরিমেয় অনুরাগ, সাংসারিক জীবনের দৈনন্দিন মুহুর্তের ও পরিবার বন্ধনের প্রতি সুনিবিড় আকর্ষণ, রূপ ও রসের প্রতি তাহার গভীর আসক্তি। সাংসারিক জীবনের দৈনন্দিন মুহুর্তের প্রতি বাঙালীর অনুরাগ ময়নামতী-পাহাড়পুরের মৃৎশিল্পে, সদুক্তিকর্ণামৃত, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় এবং প্রাকৃতপৈঙ্গল গ্রন্থের নানা বিচ্ছিন্ন শ্লোকে, চর্যাগীতির পদগুলিতে, এবং তাহার লোকায়াত ধৰ্মকর্মের আচারানুষ্ঠানে বারবার অভিব্যক্তি। এই সুখ-দুঃখময় জীবনের প্রতি একটা গভীর আসক্তি প্রাচীন বাঙলীর প্রতিমাশিল্পের ও সাহিত্যের ইন্দ্ৰয়স্পর্শালুতা এবং হৃদয়বেগের মধ্যেও ধরা না পড়িয়া পারে নাই। এই আসক্তি ও আবেগ হইতেই আসিয়াছে ঐহিক বস্তুনিষ্ঠা এবং নীরস বৈরাগ্যের প্রতি বিরাগ ও অশ্রদ্ধা। প্রাচীন সাহিত্যের নানা স্থান হইতে এই ইহনিষ্ঠার অনেকগুলি শ্লোকসাক্ষ্য নানাসূত্রে উল্লেখ করিয়াছি। যে-বৈরাগ্য দুঃখের আকর বলিয়া মানব সংসারের প্রতি মানুষের চিত্তকে বিমুখ করিয়া দেয়, মানবজীবনের বিচিত্রলীলাকে মায়া বলিয়া তুচ্ছ করিতে শেখায়, পঞ্চভূতনির্মিত ও পঞ্চেন্দ্ৰিয়সমৃদ্ধ এই দেহকে ক্লেদকৃমিকীটের আবাস বলিয়া ঘূণা করিতে এবং দেহকে নানা উপায়ে ক্লিষ্ট ও নির্যাতন করিতে শেখায় সেই নীরস বৈরাগ্যের প্রতি কোনও শ্রদ্ধা বা আকর্ষণ বাঙালীর নাই, আজও নাই, মধ্যযুগেও ছিল না, এবং যতদূর ধরিতে বুঝিতে পারা যায়, প্রাচীনকালেও ছিল না। যাহার সৃষ্টির ধারা হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার দিকে, নীরস বৈরাগোর প্রতি তাহার সেই শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ থাকিতে পারে না। বস্তুত, প্রাচীন বাঙালীর ধর্মসাধনায় এই ধরনের নীরস বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসের স্থান যেন কোথাও নাই। বিশুদ্ধ স্থবিরবাদী বৌদ্ধধর্ম বাঙলাদেশে প্রসার লাভ করিতে পারে নাই। দিগম্বর জৈনধর্মের কিছু প্রসার এদেশে ছিল বটে, কিন্তু খাবুই সংকীর্ণ গোষ্ঠীর মধ্যে এবং তাঁহারা কখনও সাধারণভাবে বাঙালীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে পারেন নাই। সহজযানী সিদ্ধাচার্যরা তো তাহাদের ঠাট্টা-বিন্দুপই করিয়াছেন। ব্ৰাহ্মণ্যধর্মী একদণ্ডী ত্ৰিদণ্ডী সন্ন্যাসীরাও ছিলেন; তাহারাও যে খুব সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিলেন, এমন মনে হয় না। মহাযানী শ্রমণ ও আচার্যদের যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা ছিল, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহারা তো নীরস বৈরাগী ছিলেন না, মানবজীবন ও মানবসংস্কারকে অস্বীকারও করিতেন না। নিজেরা সংসার জীবনযাপন তাহারা করিতেন না। এ-কথা সত্য, কিন্তু সমস্ত প্ৰাণী৷ জগতের প্রতি তাহদের করুণা এবং মৈশ্ৰীভাবনা তাহদের জীবন ও ধর্মসাধনাকে একটি অপর্ব স্নিগ্ধ রসে সমৃদ্ধ করিয়াছিল। আর, বজ্রযানী, মন্ত্রযানী, কালচক্রযানী এবং সহজযানীদের ধর্মসাধনার ভিত্তিতেই তো ছিল দেহযোগ বা কায়সাধনা, এবং তাহার পথ ও উদ্দেশ্যই হইতেছে এই দেহ এবং দেহস্থিত ইন্দ্ৰিয়াকুলকে আশ্রয় করিয়া দেহ-ভাবনার উর্ধের্ব উন্নীত হওয়া। নাথধর্ম, কাপালিকধর্ম, অবধূতমাৰ্গ, বাউলমাৰ্গ প্রভৃতি সমস্তই মোটামুটি একই ভাবকল্পনা ও সাধনপদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত। কাজেই ইহাদের সন্ন্যাস বা বৈরাগ্য নীরস, ইহুবিমুখ আত্মনিপীড়নের বৈরাগ্য নয়; দেহবন্ধনের মধ্যেই ইহাদের মোক্ষ বা বৈরাগসাধনা, ইন্দ্ৰিয়ের আশ্রয়ে অতীন্দ্ৰিয়ের উপলব্ধি, আসক্তির মধ্যেই নিরাসক্তির কামনা-দেহকে, ইহাসক্তিকে অস্বীকার করিয়া নয় কিংবা তাহা হইতে দূর সরিয়া গিয়াও নয়। জীবনরস রসিকের যে পরম বৈরাগ্য সেই রূপ ও রসসমৃদ্ধ বৈরাগ্য, গৃহীমানের পরম বৈরাগাই প্রাচীন বাঙালীর চিওহরণ করিয়াছিল; সেই হেতুই বাংলাদেশে বজ্ৰযান-মন্ত্রযান-কালচক্ৰযান-সহজযান-নাথধর্ম প্রভৃতির এত প্রসার ও প্রতিপত্তি এবং সেইজন্যই বৈষ্ণব সহজিয়া সাধক-কবিদের ধর্ম, আউল-বাউলদের ধর্ম এবং দেহাশ্ৰিত তন্ত্রধর্মের প্রতি, দেহযোগের প্রতি, ইহযোগের প্রতি বাঙালীর এত অনুরাগ।