বাঙলীর দেবায়তনে দেবীদের প্রাধান্য
সাম্প্রতিক বাঙলার বিচিত্র ধর্মকর্মানুষ্ঠানের গভীরে একটু দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যাইবে, এদেশে দেবতাদের চেয়ে দেবীদের সমাদর ও প্রতিষ্ঠা বেশি; মধ্যযুগেও তাঁহাই ছিল। প্রাচীন বাঙলা সম্বন্ধে এ-কথা হয়তো সমান প্রযোজ্য নয়; কারণ, প্রতিমা-সাক্ষ্যে দেখা যায়, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় দেবায়তনে দেবমূর্তির সংখ্যাই বেশি। তবু, মধ্যপর্ব ও সাম্প্রতিক পর্বে দেবীদের যে প্রাধান্য তাহার সূচনা যেন আদিপর্বেই দেখা দিয়াছিল। আদিম কৌম সমাজের মাতৃকাতন্ত্রের দেবীদের প্রাধান্য কৌম সমাজে তো ছিলই; বিচিত্র নামে তাহারা নানাস্থানে পূজাও লাভ করিতেন। পরে যখন আর্য-ব্রাহ্মণ্য পুরুষপ্রকৃতি ধ্যান সুপ্রতিষ্ঠিত হইল তখন সেই মাতৃকাতন্ত্রের দেবীরা প্রকৃতি বা শক্তিরূপিণী বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে, বিশেষভাবে দুর্গ ও তারার সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গেলেন। যাহাই হউক, আদিপর্বের শেষ পর্যায়ে দেখিতেছি। দুর্গ, তারা, ষষ্ঠী, হারীতী, মনসা, মারীচী, চুণ্ডা, পৰ্ণশবরী প্রভৃতি, বিশেষভাবে দুর্গ ও তারা ক্রমশ সমাদৃতা ও সুপ্রতিষ্ঠিত হইতেছেন এবং তারার ধ্যানে তাঁহাকে একই সঙ্গে বেদমাতা অর্থাৎ সরস্বতী, গিরিজ অর্থাৎ উমা বা দুর্গ, পদ্মাবতী এবং বিশ্বমাতা বলিয়া আহ্বান করা হইয়াছে। এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যুকৃত্যুর প্রধান আদিম মাতৃতাত্মিক কৌম সমাজান্দর্শের এবং কৌম মানসের পুনঘোষণা, সন্দেহ কি!
নারী বা মাতৃকাতন্ত্র
প্রাচীন বাঙলার প্রতিমা-সাক্ষ্যে দেখা যায়, উমা-মহেশ্বরের যুগল মূর্তিরূপ এবং শিবের বৈবাহিক বা কল্যাণসুন্দর রূপ সমসাময়িক বাঙালীর চিত্তহরণ করিয়াছিল। তাহা ছাড়া দুৰ্গা বা দেবীও নানা রূপ ও নানা নামে পূজা লাভ করিতেছিলেন। শিব-গৌরীর বিবাহ-প্রসঙ্গ লইয়া মধ্যযুগীয় বাঙলা-সাহিত্যে যে-ধরনের পারিবারিক ও সংসারগত ভাবকল্পনা বিস্তৃত তাহার আভাসও প্রাচীনকালেই পাওয়া যাইতেছে। ইহাদের মধ্যে একদিকে যেমন সমসাময়িক বাঙালীর হৃদয়াবেগ ও চিত্তের স্পর্শালুতা প্রত্যক্ষ গোচর তেমনই অন্যদিকে বাঙালী চিত্তে নারীর প্রাধান্য ও নারীভাবনার প্রসারও সমান প্রত্যক্ষ। আর, বিজযান-সহজযান প্রভৃতি ধর্মের কায়সাধন তো নারী বা শক্তি ছাড়া সম্ভবই নয়। তাহা ছাড়া, রাধাকৃষ্ণের রূপ ও ধ্যান-কল্পনার মধ্যেও এই নারীভাবনা অনিবাৰ্য্যভাবে সক্রিয়; অর্থাৎ, কোনও দেবতাই যে দেবী ছাড়া সম্পূর্ণ নহেন, নর যে নারী ছাড়া সম্পূর্ণ নহে কেবল তাঁহাই নয়; সে-ভাবনা তো পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য দেবায়তন-কল্পনার মধ্যেই ছিল, কিন্তু নারীকে শক্তিস্বরূপিনী বলিয়া দেখা ও ভাবা, সৃষ্টিরহস্যের মূল বলিয়া কল্পনা করা:- ইহার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ, সংসারগত ইন্দ্ৰিয়ালুতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত অনস্বীকার্য এবং এই ইঙ্গিত প্রাচীন-ভারতের, বিশেষভাবে বাঙলায় সৃষ্টি এবং আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের দান। কৃষ্ণ-রাধা কল্পনার রাধাই হইতেছেন শিবের শক্তি, বজ্রযানীর নিরাত্মা, সহজযানীর শূন্যতা, কালচক্রযানীর প্রজ্ঞা। এই কৃষ্ণ-রাধার কল্পনা তো একান্তই প্রাচীন বাঙলার শেষ পর্যায়ের রচনা; বস্তুত, বাঙালী চিত্তের গভীরে যেন সেই অনার্য আদিম তমসাচ্ছন্ন তন্ত্রসাধনার নিগূঢ় কামনা; তাহার তাড়নাতেই যেন সমস্ত ধর্মমতের গড়ন। সংখ্যাধ্যান-কথিত পুরুষ-প্রকৃতি কল্পনার এই যে তান্ত্রিক রূপান্তর, সনাতন আর্য মানসে ইহার আবেদন স্বল্প, অথচ বাঙলাদেশে এই ভাবনা অত্যন্ত সত্য ও ব্যাপক। গোপন দেহযোগ বা কায়সাধন, নারীসাধন, শবসাধন, শূন্যধ্যান, দেহতত্ত্বের অভিনব ব্যাখ্যা, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মেরই শাক্ত তান্ত্রিক রূপে ভীষণ ও ভয়াল সাধন-পদ্ধতি মৃত্যুঃ সর্বত্রই অধ্যায় জীবনের একটি বিশেষ ভঙ্গি বর্তমান বাহা আর্য ব্রাহ্মণ ধর্ম অনুপস্থিত।
বাঙালীর হৃদয়াবেগ। প্ৰাণধর্ম ও ইন্দ্ৰিয়ালুতা।
প্রাচীন বাঙালীর হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার ইঙ্গিত তাহার প্রতিমা-শিল্পে এবং দেবদেবীর রূপ-কল্পনায় ধরা পড়িয়াছে। এ-কথা অন্যত্র বলিয়াছি, একটু আগেও ইঙ্গিত করিয়াছি। মধ্যযুগের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে সহজিয়া সাধনায়, বাউলদের সাধনায় যে বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগের প্রসার, তাহার সূচনা দেখা গিয়াছিল আদি পর্বেই এবং তোহা শুধু বৌদ্ধ বজ্রযানী-সহজযানীদের মধ্যেই নয়, তান্ত্রিক শক্তি সাধনার মধ্যেই নয়, বৈষ্ণব সাধনায়ও বটে। এই হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতা যে বহুলাংশে আদিম নরগোষ্ঠীর দান তাহা আজিকার র্সাওতাল, শবর প্রভৃতিদের জীবনযাত্রা, পূজানুষ্ঠান, সামাজিক আচার, স্বপ্নকল্পনা, ভয়-ভাবনার দিকে তাকাইলে আর সন্দেহ থাকে না। আর্য ব্ৰাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ ও জৈন সাধনাদর্শে কিন্তু এই ঐকাস্তিক হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার এতটা স্থান নাই। সেখানে ইন্দ্ৰিয়-ভাবনা বস্তুসম্পর্কবিচুত, ভক্তি জ্ঞানানুগ, হৃদয়াবেগ বুদ্ধির অধীন। বস্তুত, বাঙলার অধ্যাত্ম সাধনার তীব্র আবেগ ও প্রাণবন্ত গতি সনাতন আর্য ধর্মে অনুপস্থিত।
এই হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতা প্রাচীন বাঙালী জীবনের অন্য দিকেও ধরা পড়িয়াছে। মধ্যযুগে দেখিতেছি, দেবই হউন, আর দেবীই হউন, বাঙালী যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে তাহদের মর্ত্যের ধূলায় নামাইয়া পরিবার-বন্ধনের মধ্যে র্বাধিতে এবং ইহগত সংসার-কল্পনার মধ্যে জড়াইতে, হৃদয়াবেগের মধ্যে তাঁহাদের পাইতে ও ভোগ করিতে, দূরে রাখিয়া শুধু পূজা নিবেদন করিতে নয়। এই কামনার সূচনা আদি পর্বেই দেখা যাইতেছে। ষষ্ঠী, মনসা, হারাতী, কৃষ্ণ-যশোদা প্রভৃতির রূপ কল্পনায়ই যে এই ভাবনা অভিব্যক্তি তাঁহাই নয়; কার্তিকের শিশুলীলা বর্ণনা, পিতা শিবের বেশভূষা অনুকরণ করিয়া শিশু-কর্তিকের কৌতুক, দরিদ্র শিবের গৃহস্থলীর বর্ণনা, নেশাগ্ৰস্ত শিবের সংসারে উমার দুঃখ এবং জামাতা ও কন্যারূপে শিব ও গৌরীকে সমস্ত হৃদয়াবেগ দিয়া আপন করিয়া বাধা, সপরিবারে বিষ্ণু ও শিবকে প্রত্যক্ষ করা প্রভৃতির মধ্যেও একই ভাবনা সক্রিয়।