প্রাচীন বাঙলায় আর্যপ্রবাহ ক্ষীণ
ইহার কারণ একাধিক। প্রথমত, বাঙলাদেশ প্রত্যন্ত দেশ বলিয়া আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবাহ এত দূরে আসিয়া পৌঁছতে সময় লাগিয়াছে। দ্বিতীয়ত, বহুদিন পর্যন্ত বাঙলাদেশের প্রতি আর্যমানসের একটা উন্ন্যাসিকতা, একটা ঘূণা ও অবজ্ঞার ভাব সক্রিয় ছিল। এদেশে আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার পরও সে উন্নাসিকতা একদিনে, একেবারে কাটিয়া যায় নাই, তাহার কারণ, যে সংকীর্ণ সীমার মধ্যে এই ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার সেই ধর্ম ও সংস্কৃতির শুচিতা রক্ষার একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা। তৃতীয়ত, বাঙলার স্থানীয় আদিম, কৌমাবদ্ধ মানবসমোজও বহুদিন পর্যন্ত আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি খুব শ্রদ্ধিতচিত্ত ছিল না, বরং সক্রিয় বিরোধিতাও করিয়াছে, যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে সে-স্রোত ঠেকাইয়া রাখিতে। তাহার পর পরাভব যখন অনিবার্য হইয়াছে তখনও সেই মানবসমাজ একেবারে স্রোতে গা ভাসাইয়া দেয় নাই; নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধন পরিত্যাগ করিয়া আর্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধন পুরোপুরি মানিয়া লয় নাই, বরং দিনের পর দিন ধরিয়া বুঝাপড়া করিয়া একটা সমন্বয় গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছে। মধ্যগাঙ্গেয় ভারত যে-ভাবে আর্য, বিশেষভাবে আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পুরাপুরি মানিয়া লইয়াছে বাঙলাদেশ সে-ভাবে তাহা করে নাই। ভারতবর্যের বুকে যে কয়টি অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও প্রসার লাভ করিয়াছে তাহার প্রত্যেকটিই মধ্যগাঙ্গেয় ভারতের অর্থাৎ আর্যাবর্তের সীমার বাহিরে। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম প্রভৃতি যে বর্তমানে বিহারের সীমার মধ্যে উদ্ভূত হইয়াছিল এবং পরবর্তী কালে তন্ত্রধর্ম, বজ্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান, কালচক্ৰযান প্রভৃতির উদ্ভবও যে আর্যাবর্তের সীমার বাহিরে, ইতিহাসের এই ইঙ্গিত তুচ্ছ করিবার মতন নয়। বস্তুত, বাঙলাদেশ আর্যধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও, ব্ৰাহ্মণ ও উচ্চতর দুই একটি সম্প্রদায়ের বাহিরে এই ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধন শিথিল, তাহার প্রতি শ্ৰদ্ধা কুষ্ঠিত। চতুর্থত, বাঙলাদেশে নানা নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে, প্রচুর রক্তমিশ্রণের ফলে এবং নানা ঐতিহাসিক কারণে জাতিভেদ-বৰ্ণভেদের বৈষম্য আর্যাবর্ত বা দক্ষিণ ভারতের মতো এত কঠোর হইয়া উঠিতে পারে নাই; বস্তুত, বাঙলার সমাজবন্ধনে তথাকথিত শূদ্র জাতির লোকদেরই প্রাধান্য। আজও বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্যের সংখ্যা স্বল্প। বৰ্ণবিন্যাসে ও সামাজিক আচার-বিচারে যাহা কিছু কঠোরতা বা আর্য ব্রাহ্মণ্য সনাতনত্বের যে আদর্শ বাঙলায় আজও সক্রিয় তাহা প্রধানত দক্ষিণী সেনা-বংশীয় রাজাদের প্রভাবে ও আনুকূল্যে এবং গৌণত মধ্যভারতীয় আর্য ব্ৰাহ্মণ্যাদর্শের প্রেরণায়।
সনাতনত্বের প্রতি বাঙালীর বিরাগ
এই সব কারণে বাঙালীর ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধনে এমন কতগুলি বৈশিষ্ট্য গড়িয়া উঠিয়াছে যাহা মধ্যগাঙ্গেয় ভারত, অর্থাৎ আর্য-ভারত হইতে পৃথক। আর্য ভারতবর্ষ সনাতনত্বের আদর্শে স্থির ও অবিচল, সমস্ত আচারানুষ্ঠান, অধ্যাত্ম সাধনা, সমাজ ও পরিবারবন্ধন প্রভৃতি সমস্তই সেখানে শাস্ত্ৰ দ্বারা শাসিত। আৰ্য-ভারত রক্ষণশীল, যাহা সে পাইয়াছে তাহা সে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে চায়। মধ্যগাঙ্গেয় ভারতের মন তাই বহুলাংশে পরিবর্তন বিমুখ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া যে মধ্যগাঙ্গেয় ভারতের ধর্মে, রাষ্ট্রে বা সমাজে কোনও বৈপ্লবিক আলোড়ন দেখা দেয় নাই, বা দিলেও তাহা সার্থক রূপ পরিগ্রহ করিতে পারে নাই, ইতিহাসের এ-তথ্য বিস্ময়কর, কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। ইহার প্রধান কারণ, আর্য ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের সনাতনী ও রক্ষণশীল মনোভাব। বাঙলাদেশে হইয়াছে তাহার বিপরীত। মহাযানী বৌদ্ধধর্মের বোজযানী-মন্ত্রযানী-কালচক্রযানী ও সহজযানী রূপান্তর; সহজযানো সহজ মানবতার এবং প্ৰাণধর্মের আবেদন; ব্রাহ্মণ্য শক্তিধর্মের তান্ত্রিক রূপান্তর; বৈষ্ণবধর্মে বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগের সঞ্চার; শিব ও উমার ভাবকল্পনায় পারিবারিক জামাতা-কন্যার রূপ ও আবেগ সঞ্চার; দুর্গা, তারা, ষষ্ঠী, মারীচী, পর্ণশবরী প্রভৃতি মাতৃকাতন্ত্রের দেবীদের প্রতি শ্রদ্ধা, আবেগ ও অনুরাগ; শিব ও বিষ্ণুর মতন দেবতাকেও ঘনিষ্ঠ মানব সম্বন্ধে বাধিয়া তাহাদের প্রতি পারিবারিক আত্মীয়তার এবং মানবী লীলার আবেগ সঞ্চার, তান্ত্রিক কায়াসাধনের প্রতি অনুরাগ এবং সেই সাধনের রীতিপদ্ধতি; শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞানচর্চায় বুদ্ধি ও যুক্তি অপেক্ষা প্ৰাণধর্ম ও হৃদয়াবেগের প্রাধান্য; বাঙলার ব্যবহার-শাস্ত্ৰে দায়াধিকারের আদর্শ ও ব্যবস্থা; বাঙলার পরিবার ও সমাজবন্ধন প্রভৃতি সমস্তই আৰ্যমানসের দিক হইতে বৈপ্লবিক ও সনাতনত্বের বিরোধী। দুঃসাহসী সমন্বয়, স্বাঙ্গীকরণ ও সমীকরণ যেন বাঙালীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; সনাতনত্বের প্রতি একটা বিরাগ যেন বাঙলার ঐতিহ্য ধারায়। ইহার মূল প্রধানত বাঙালীর জনগত ইতিহাসে, কিছুটা তাহার ভৌগোলিক পরিবেশে, তাহার নদনদীর ভাঙা গড়ায়, কিছুটা ইতিহাসের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যে। বাঙালীর বৃত্তি যথার্থতি বৈতসী; যে-আদর্শ, যে-ভাবস্রোতের আলোড়ন, ঘটনার যে-তরঙ্গ যখন আসিয়া লাগিয়াছে, বাঙলাদেশ তখন বেতস-লতার মতো নুইয়া পড়িয়া অনিবার্য বোধে তাহাকে মানিয়া লাইয়াছে এবং ক্রমে নিজের মতো করিয়া তাহাকে গড়িয়া লইয়া, নিজের ভাব ও রূপদেহের মধ্যে তাহাকে সমন্বিত ও সমীকৃত করিয়া লইয়া আবার বেতস লতার মতোই সোজা হইয়া স্ব-রূপে দাঁড়াইয়াছে। যে দুর্মর অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি বেতস গাছের, সেই দুর্মর প্রাণশক্তিই বাঙালীকে বার বার বাঁচাইয়াছে।